সরকার আসে সরকার যায় ভাগ্য বদলায় না তাদের
Published: 1st, February 2025 GMT
দীর্ঘদিনেও খালের ওপর নির্মাণ হয়নি সেতু। এ কারণে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন সাঁকো দিয়ে পারাপার হচ্ছেন ৯ গ্রামের মানুষ। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার বদল হলেও এখানকার মানুষের ভাগ্য বদলায়নি।
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার সরস্বতীর চরের খালের ওপর নির্মিত কাঠেরপুল এলাকার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। এই সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন তিতাস ও মেঘনা উপজেলার ৯ গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
সাঁকো পার হতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিতাস উপজেলার সাতানী ইউনিয়নের প্রথম সরস্বতীর চরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত কাঠালিয়া নদী। সেখান থেকে একটি খাল উৎপন্ন হয়ে দ্বিতীয় সরস্বতী চরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সাতানী গ্রাম এলাকায় গিয়ে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খালটি আবার মিলিত হয়েছে কাঠালিয়া নদীতে। এই খাল মূলত প্রথম সরস্বতীর চর ও দ্বিতীয় সরস্বতীর চরকে দুই ভাগ করেছে। এই খালের ওপর নির্মিত সাঁকো দিয়ে প্রথম সরস্বতীর চর, দ্বিতীয় সরস্বতীর চর ও মেঘনা উপজেলার কাশিপুর, কাঠালিয়া, লক্ষণখোলা, সেনের চর, রাধানগর, পাড়ারবন্ধ, ব্রাহ্মণচরের ২৫ হাজার লোক কুমিল্লা শহর ও তিতাসের বাতাকান্দি বাজারে যাতায়াত করেন।
জানা গেছে, সরস্বতীর চরের খালের ওপর ১৫ বছর আগে বাঁশের সাঁকোর বদলে কাঠের সাঁকোটি নির্মাণ করা হয় গ্রামবাসীর টাকায়। এই সাঁকোর অবস্থা এখন জরাজীর্ণ। পার হতে গেলে দোল খায়, যে কোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিকল্প উপায় না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই সাঁকো পারপার হতে হচ্ছে গ্রামবাসীর। এই সাঁকো পারাপার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ বৃদ্ধরাও।
দ্বিতীয় সরস্বতীর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মরিয়ম খাতুন জানায়, স্কুলে যাওয়ার পথে সাঁকো পার হওয়ার
সময় ভয় লাগে। মনে হয়, কখন যেন সাঁকো থেকে পড়ে যেতে হয়। সাঁকো দিয়ে যাওয়ার সময় নড়বড় করে। গ্রামের অনেকে সাঁকো পার হওয়ার ভয়ে স্কুলে যেতে চায় না।
প্রথম সরস্বতীর চরের ৭০ বছর বয়সী মজিবুর রহমান জানান, এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০০ বছরেও আগে। কিন্তু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। সরকার বদল হয়েছে অনেকবার, তাদের ভাগ্য বদলায়নি। এই স্থানে নির্মাণ হয়নি সেতু। জীবদ্দশায় সেতু দেখে যেতে পারবেন কিনা সংশয় তাঁর।
দ্বিতীয় সরস্বতীর চরের কৃষক মোবারক হোসেন বলেন, ‘এ বছর ২০ বিঘা জমিতে ভুট্টা, আলু চাষ করেছি প্রথম সরস্বতীর চরে। জমিতে সার নিতে অনেক কষ্ট হয়। শ্রমিক দিয়ে সার নিতে হয়, ঠিকমতো শ্রমিকও পাওয়া যায় না।’ তাঁর ভাষ্য, যখন ফসল আনার সময় হয়, তখন কষ্ট আরও বেড়ে যায়। শ্রমিক দিয়ে পরিবহনের কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। এই খালের ওপর একটি সেতু নির্মাণ করলে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ অনেক কমে যাবে।
কথা হয় দ্বিতীয় সরস্বতীর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, খালের ওপর কাঠের সাঁকোটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা রয়েছে। সাঁকো দিয়ে শিক্ষার্থীরা আসতে ভয় পায়। প্রায়ই তারা নিজেরা গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে যান। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের দিয়ে যান। এই সাঁকো পার হতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই আহত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। দ্রুত একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
তিতাস উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের ভাষ্য, সরস্বতীর চরের খালের ওপর সাঁকোর স্থানে ৩০ মিটার একটি সেতু নির্মাণের জন্য
প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বরাদ্দ পাবেন বলে আশা তাঁর। বরাদ্দ পেলেই সেতু নির্মাণকাজ শুরু করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: খ ল র ওপর উপজ ল র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মোগল শাহজাদার মসজিদ, এখন চলে ‘গরিবের দানে’
যার–তার মসজিদ নয়। শাহজাদার মসজিদ। যেনতেন প্রকারের শাহজাদা তিনি নন, ভারত সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ আজম, মসজিদটি তৈরি করেছিলেন তিনি। প্রায় ৩৫০ বছরের পুরোনো এই শাহজাদার মসজিদে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন আমজনতা। প্রতিবছরের মতো এবারেও খতম তারাবিহর জামাত হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার মুসল্লি তারাবিহর জামাতে অংশ নিচ্ছেন। মসজিদটি ‘লালবাগ মসজিদ’ নামে পরিচিত।
মোগল যুগের ঢাকার বিখ্যাত স্থাপনা— যাকে ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীকও বলা যেতে পারে, সেই লালবাগ কেল্লার ভেতরে মসজিদটির অবস্থান। লালবাগ কেল্লার ইতিহাস অনেকেরই জানা। সুবাদার শায়েস্তা খানের প্রথম দফা সুবাদারির পর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর তৃতীয় পুত্র শাহজাদা মোহাম্মদ আজমকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান।
মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইতে লিখেছেন, শাহজাদা ঢাকা এসেছিলেন ১৬৭৮ সালের ২৯ জুলাই। তবে বাংলাপিডিয়ার মতে ২০ জুলাই। ঢাকায় তিনি বেশিকাল কাটাননি। ১৬৭৯ সালে তিনি চলে যান। তবে এই সময়ের মধ্যেই তিনি ঢাকার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে গেলেন এক অনন্য স্থাপনার জন্য। সেটি ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’। পরে এই কিল্লা বা দুর্গটি এলাকার নামানুসারে ‘লালবাগ কেল্লা’ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
শাহজাদা আজম পিতার নামানুসারে এই দুর্গ নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। তবে মসজিদটি তাঁর সময়ে নির্মিত হয়েছিল। শাহজাদা চলে যাওয়ার পরে শায়েস্তা খান ১৬৭৯ সালে দ্বিতীয় দফায় সুবাদার হয়ে ঢাকায় আসেন। তিনি এখানেই বসবাস ও তাঁর বিচারকাজ পরিচালনা করলেও দুর্গটির নির্মাণকাজ শেষ করেননি। এর পেছনের করুণ কাহিনিও অনেকের জানা। সুবাদারের পরমাসুন্দরী কন্যা ‘ইরান দুখত’ তথা বিবি পরীর বিয়ের ঠিকঠাক ছিল শাহজাদা আজমের সঙ্গে। কিন্তু দুর্গ নির্মাণকালেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। অনেকের অনুমান এ কারণে দুর্গটিকে সুবাদার শায়েস্তা খান ‘অপয়া’ মনে করতেন বলে এটি আর শেষ করা করেনি।
মোগলরীতি অনুসারে দুর্গ মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট। মাঝেরটি বড় আর পাশের দুটি একটু ছোট সম–আকারের। চার কোণে চারটি বুরুজ। গম্বুজগুলো মসজিদের ভেতরে অষ্টকৌণিক ড্রামের আকারে নির্মিতচন্দনের দরজা, সোনার গম্বুজসুবাদার শায়েস্তা খান লালবাগ দুর্গের কাজ শেষ করেননি বটে, কিন্তু প্রিয় কন্যার কবরের ওপর মোগলরীতির এক অনিন্দ্যসুন্দর সৌধ নির্মাণ করেন—যেটি এখন ‘পরী বিবির মাজার’ নামে পরিচিত। সৌধটি নির্মাণের জন্য সুবাদার সুদূর জয়পুর থেকে সাদা মার্বেল পাথর, রাজমহল থেকে বিশেষ ধরনের পাথর ও বর্তমান উত্তর প্রদেশের চুনার থেকে বেলে পাথর আনিয়েছিলেন। এর দরজা ছিল চন্দনকাঠের আর গম্বুজটি ছিল সোনায় মোড়ানো, সেসব বহু আগেই লুটপাট হয়ে গেছে।
শাহজাদার মসজিদলালবাগ দুর্গের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর ভেতরের প্রধান তিনটি স্থাপনা মাঝখানে একই সরল রেখা বরাবর। পূর্ব প্রান্তে দ্বিতল দিওয়ান ও হাম্মামখানা, মাঝখানে পরী বিবির মাজার ও পশ্চিম প্রান্তে দুর্গ মসজিদ। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ বইতে উল্লেখ করেছেন শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালে ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। তবে এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এ এইচ দানি তাঁর ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন, কথিত আছে শাহজাদা মোহাম্মদ আজম এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন। মসজিদের নির্মাণ কৌশল থেকে এ সত্য প্রমাণিত হয়। বাংলাপিডিয়াতেও বলা হয়েছে, শাহজাদা আজম দুর্গ অভ্যন্তরে দু–একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যমোগলরীতি অনুসারে দুর্গ মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট। মাঝেরটি বড় আর পাশের দুটি একটু ছোট সম–আকারের। চার কোণে চারটি বুরুজ। গম্বুজগুলো মসজিদের ভেতরে অষ্টকৌণিক ড্রামের আকারে নির্মিত। ভেতরে পাতার নকশা করা। দেয়ালগুলোতে খিলান এবং আয়ত ও বর্গক্ষেত্রের নকশায় অলংকৃত। পশ্চিমে দেয়ালে তিনটি মেহরাব। উত্তর ও দক্ষিণের দরজা দুটি নকশা করা লোহার জাল দিয়ে এখন বন্ধ করা। পূর্বদিকে তিনটি দরজা। বড় দরজাটি মূল মেহরাব বরাবর। দরজা ও মেহরাব নকশা করা খিলানযুক্ত অর্ধগম্বুজ আকারের। পূর্ব ও পশ্চিমের দেয়ালে তিনটি করে রয়েছে ছয়টি কুলুঙ্গি। পুরো মসজিদের সামনে এবং দুই পাশের দেয়াল ‘বন্ধ খিলান’ নকশায় অলংকৃত।
লালবাগ মসজিদের ভেতরের একাংশ। উত্তর ও দক্ষিণের দরজা দুটি নকশা করা লোহার জাল দিয়ে এখন বন্ধ করা