মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের যাত্রা হয় ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর। এরই মধ্যে ২৫ বছর পেরিয়েছে ব্যাংকটি। দীর্ঘ সময় পর ব্যাংকটির লোগো পরিবর্তন করা হয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। এর আগে ঢাকা ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ছিলেন তিনি। এমটিবির লোগো পরিবর্তন, ব্যবসা এবং ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন বিষয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওবায়দুল্লাহ রনি

সমকাল : এমটিবি প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পার হয়েছে। এমডি হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 

মাহবুবুর রহমান : এই ব্যাংক যারা শুরু করেছিলেন, তারা সবাই সমাজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। বিভিন্ন ব্যাংকে সেবা নিতে গিয়ে তারা এক সময় চিন্তা করলেন, একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয়। সেই চিন্তা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ব্যাংকের উদ্যোক্তা চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন স্কয়ার গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী। উদ্যোক্তাদের মধ্যে শেল্‌টেক, এসিআই, এবিসি, ব্রিটানিয়া, আবুল হোসেন কোম্পানি, স্বদেশ গ্রুপের মতো বিখ্যাত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা রয়েছেন। শুরু থেকেই সুশাসন নিশ্চিত করা তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তারা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরই সিদ্ধান্ত নেন, একজন দুই বছরের বেশি চেয়ারম্যান থাকবেন না। এভাবে ঘুরে ঘুরে সবাই চেয়ারম্যান হন। অনেক ব্যাংকের পর্ষদে দেখা যায় এ নিয়ে নানা ঝামেলা হয়। অনেক সময় একই ব্যক্তি বছরের পর বছর চেয়ারম্যান থেকে যান। 
এমটিবির পরিচালনা পর্ষদে আরেকটি ব্যতিক্রম হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী চেয়ারম্যানের গাড়িসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রাপ্য হলেও এই ব্যাংকের কোনো চেয়ারম্যান সেই সুবিধা নেন না। আরেকটি বিষয় হলো, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে তারা ক্ষমতায়ন করেছেন। ব্যাংক পরিচালনায় তারা কোনো হস্তক্ষেপ করেন না। ব্যাংক পরিচালনায় যেসব নীতির দরকার তা নিয়ে আলোচনা করেন। কীভাবে গ্রাহকসেবা আরও উন্নত করা যায় এবং আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক করা যায়, এসব নিয়েই তারা ভাবেন। দেশে ও দেশের বাইরে মিউচুয়ালি কীভাবে আস্থা অর্জন করা যায়, এ চিন্তা থেকেই নাম দেওয়া হয় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।

সমকাল : ২৫ বছরে আপনাদের বড় অর্জন কোথায়? 

মাহবুবুর রহমান : ২৫ বছরে সবচেয়ে বড় অর্জন একটি ব্র্যান্ড হিসেবে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে এমটিবি। ব্যালান্স শিটের আকার বিবেচনায় সমসাময়িক কিছু ব্যাংকের তুলনায় হয়তো এই ব্যাংক ছোট। এর অন্যতম কারণ, আমরা কখনও আগ্রাসী ছিলাম না। তবে মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। যে কারণে এই ব্যাংক নিয়ে কখনও বড় ধরনের নেতিবাচক কোনো বিষয় সামনে আসেনি। ভালো তদারকির কারণে গত পাঁচ বছরে যেসব ঋণ বিতরণ হয়েছে, তার মধ্যে খেলাপি হয়েছে দেড় শতাংশের কম।

সমকাল : দীর্ঘ সময় পর কেন লোগো পরিবর্তনের প্রয়োজন হলো?

মাহবুবুর রহমান : এখন তারুণ্যের সময়। তরুণরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এসব কারণে আমরা চিন্তা করলাম গতিশীলতার বিষয়টি। আমরা লোগোতে যে লাইন ব্যবহার করেছি, এটা দিয়ে গতি বোঝানো হয়েছে। রঙিন করার কারণ, বাংলাদেশের বড় একটি অংশ তরুণ। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের মতো করে কিছু করার ধারণা থেকেই লোগোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আশা করা যায়, মানুষ নতুন লোগো গ্রহণ করবে। সবার কাছে ভালো লাগবে।

সমকাল : সেবার ধরনেও নতুন কিছু আসছে?

মাহবুবুর রহমান : মিউচুয়াল ট্রাস্ট শুরু থেকেই ভালো মানের সেবা দিয়ে আসছে। এরপরও ভালোর শেষ নেই। গ্রাহক ঘরে বসে কীভাবে সব ধরনের সেবা নিতে পারেন, আমরা সেদিকে যাচ্ছি। এমটিবি নিউ অ্যাপে একজন মানুষের যত ধরনের সেবা দরকার, প্রায় সবই আছে। আগামী জুনের মধ্যে সঞ্চয়পত্র সার্টিফিকেট, ট্যাক্স ফাইলসহ যত ধরনের স্টেটমেন্ট দরকার, তা অ্যাপে পাওয়া যাবে। জুনের মধ্যে ছোট ঋণের আবেদনও করা যাবে। করপোরেট গ্রাহকদের জন্য ‘এমটিবি ই ব্যাংক’ নামে আলাদা অ্যাপ রয়েছে। সেখান থেকে সব ধরনের পরিশোধ ও কালেকশন করা যায়। আগামী মার্চের মধ্যে এলসির আবেদনও এখান থেকে করা যাবে। সবচেয়ে বড় বিষয়, দুটি অ্যাপই এমটিবির কর্মীরা তৈরি করেছেন। এতে আর ১০টা থেকে ৪টা ব্যাংকিং করতে হবে না। গ্রাহকের নিজের সময় অনুযায়ী রাত ৮টায় কাজ করবেন। এভাবে গ্রাহককে ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে। ফিনটেকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ৫০ হাজার, ১ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সাপ্লাই চেইন অর্থায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকারীদের অর্থায়ন করা হবে। গ্রামীণফোনের ডিস্ট্রিবিউটররা এখন রাত ১২টায় দরকার হলেও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নিয়ে এজেন্টদের ‘টপআপ’ দিতে পারেন।

সমকাল : ঋণ বিতরণে কোন খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এমটিবি?

মাহবুবুর রহমান : চার বছর আগে মোট ঋণের ৯০ শতাংশ ছিল করপোরেট। এখন তা ৮০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ১২ শতাংশ এসএমই এবং রিটেইল ৮ শতাংশ। এসএমই ও রিটেইল মিলিয়ে ৪০ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা ‘ডে লাইট’ নামে একটি ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চেয়েছি। 
এর মাধ্যমে গ্রাহক সকালে ঋণ নিয়ে বিকেলে পরিশোধ করবেন। এই ঋণ নেবেন বাদাম, চটপটি বিক্রেতার মতো গ্রাহক। কোনো ধরনের সিকিউরিটিজ ছাড়াই এ ঋণ দেওয়া হবে। 

সমকাল : সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাত এখন কেমন চলছে?

মাহবুবুর রহমান : কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে এক ধরনের চাপ ছিল। মাঝে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ১৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আগামীতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে গভর্নর সতর্ক করেছেন। প্রভিশনিং নীতিমালায় পরিবর্তন এসেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ও মুনাফা দুটিই চাপে থাকবে। এ বছর বৈদেশিক মুদ্রাবাজার থেকে বেশি আয় আশা করা যাচ্ছে না। আবার সুদহারও অনেক বাড়ানো যাবে না। যদিও আমানতের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আবার মূল্যস্ফীতি 
এখন একটা বড় ইস্যু। ফলে বছরটা সবার জন্যই কঠিন যাবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কী হয়, তার ওপরও নির্ভর করছে অর্থনীতির পরিস্থিতি।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ধরন র স গ র হক এই ব য দরক র সমক ল ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

কাঠগড়ায় বিনোদন সাংবাদিকতা

ষ্টুডিও পাড়ায় দেখা হলেই নায়ক-প্রযোজক সোহেল রানা বলতেন, আপনারা এ সপ্তাহে আমাকে নিয়ে কী নিউজ লিখছেন? আমরা আদৌ তাকে নিয়ে কোনো নিউজ করব কিনা বা তাকে নিয়ে করার মতো কোনো নিউজ আছে কিনা তা মাথায় না রেখেই প্রশ্নটি আসত। তখন গুছিয়ে কোনো জবাব দিলে সেটা তার পছন্দ হতো না। তিনি বলতেন, না না এসব না। ছবির ঘটনা নিয়ে নিউজ অহরহ হয়। আপনারা বরং ববিতার সঙ্গে আমার প্রেম নিয়ে লিখুন। তার কথা শুনে হাসি এলেও মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে হতো। প্লটও তিনি বলে দিতেন। আমরা যখন এসব বিষয় ববিতার কাছে উপস্থাপন করতাম তখন ববিতা হাসতেন আর বলতেন, তারকা বলে কথা! আলোচনায় তো কোনো না কোনোভাবে থাকতে হবে। 

এই ঘটনা থেকে আমি দুটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। একটি হলো শিল্পী ও সাংবাদিকদের মধ্যে সম্পর্ক। এই সম্পর্ক প্রেম, বিয়ে বা দোস্তির সম্পর্ক নয়। নায়িকাদের উদ্দেশ্য ছিল সাংবাদিকদের কাছ থেকে তাদের সম্পর্কে লেখা অর্থাৎ নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন এবং প্রশংসা করে প্রতিবেদন আদায় করে নেওয়া (যাকে বলে ইতিবাচক প্রতিবেদন লেখা)। দ্বিতীয়টি হলো, তারকারা সব সময় নিউজে থাকতে চাইতেন। এর কারণ হলো, মাধ্যমটির নাম ছায়াছবি। দর্শক হলো তারকাদের ছায়ার খদ্দের। তারা সিনেমা হলে গিয়ে একজন সোহেল রানা বা ববিতাকে সরাসরি পেতেন না, গাটের অর্থ ব্যয় করে তাদের ছায়াকে দেখতে যেতেন। এজন্য তাদের একটা বাজারমূল্য তৈরি করতে হয়। তারা চাইতেন কীভাবে নিজেকে সংবাদে উপস্থাপন করা হলে দর্শকের অন্তরে তাদের নাম গেঁথে যাবে। এজন্য তারা খবর না থাকলেও নানা গুজব-গুঞ্জন, সত্য-মিথ্যা সাজিয়ে নিজেদের উপস্থাপন করতেন। লক্ষ্য হলো দর্শকের অন্তরে স্থান করে নেওয়া, সেটা যে কোনো উপায়েই হোক না কেন। আর তা প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম হলো সংবাদপত্র বা সাময়িকী। 

পক্ষান্তরে এখন যারা অভিনয় করেন, তারা ক্যামেরার সামনে এসে কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি যা বলবেন তা সরাসরি পরিবেশন হলে তারা খুশি হন। ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশন ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে তাদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হলে তারা মনে করেন অনেকের কাছে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এসব ভার্চুয়াল বিষয়গুলো সেখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আগে তারকাদের নিয়ে যে প্রতিবেদন হতো, তাতে তারকার কথার গাথুনির জন্য সাংবাদিকের একটা বিশ্লেষণ থাকতো। আর সেটাই ছিল পাঠকদের কাছে বিবেচনার বিষয়। এখনকার তারকারা সেটা পান না। কারণ নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারকারাই নিজেদেরকে নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করেন। কোনো সাংবাদিক তাদের উপস্থাপন করেন না। এখন অহরহ ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যাকে কেউ চেনেন না তার ক্ষেত্রেও শব্দটি দেদার ব্যবহার হচ্ছে। তাতে শব্দটি মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলেছে। এর ধারাবাহিকতায় আরো কিছু শব্দ আছে। 

আমাদের দেশে বিনোদন সাংবাদিকতা পেশাদারি মনোভাব নিয়ে শুরু হয় ষাটের দশকে। বিনোদন সাংবাদিকতা হলো সাংবাদিকতার একটি ধারা, যা মূলত বিনোদন ব্যবসায় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের সংবাদ সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরি ও গণমাধ্যমে প্রকাশ পর্যন্ত সম্পাদিত কার্যক্রম নির্দেশ করে থাকে। এ ধারা বিনোদন শিল্প সংশ্লিষ্টদের বাইরেও সাধারণ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সমালোচনা, সংগীত সাংবাদিকতা, ভিডিও গেম সাংবাদিকতা এবং সেলিব্রিটি সম্পর্কিত প্রচলিত সংবাদভিত্তিক কার্যক্রম বিনোদন সাংবাদিকতার অন্তর্ভুক্ত। তবে সেই সময়টাতে এ সাংবাদিকতা ‘চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা’ বা ‘সংস্কৃতি সাংবাদিকতা’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়। আশির দশক থেকে সাংবাদিকতায় তারকাপ্রথা জেঁকে বসতে শুরু করে। ষাট থেকে আশির দশক এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে প্রধান বিনোদন ছিল সিনেমা। বিনোদনে তারকাপ্রথা থাকলেও সুলভ টেকনোলজির অভাবে সাংবাদিকতায় তারকানির্ভরতা সহজ ছিল না। প্রথম পর্যায়ে ব্লক করে ছবি ছাপতে হয়েছে। পরে অফসেট পদ্ধতিতে প্রয়োজন হয়েছে ছবির পজিটিভ করা। নব্বইয়ের দশক থেকে প্রিন্ট টেকনোলজি আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় ডেস্কটপ পাবলিশিংয়ের কল্যাণে।

সাংবাদিকতায়ও ধীরে ধীরে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়তে থাকে উপস্থাপনার বৈচিত্রের কারণে। একবিংশ শতকে সাংবাদিকতা বড় ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়েছে। গণমাধ্যমের করপোরেট মালিকানা, মুনাফার লক্ষ্যে পাঠকের অধিকার খর্ব, নৈতিকতায় ধ্বস, সাংবাদিকতার শত বছরের ঐতিহ্য কল্যাণকামিতার সঙ্গে আপস- এসব কারণে মানুষ সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা অনলাইন পোর্টালের খবর সহজে বিশ্বাস করতে চান না। আর আজকের বিনোদন সাংবাদিকতাও গণমাধ্যমের মুনাফা অর্জনের অংশীদার। বিনোদনের বিষয়ভিত্তিক গভীরতার চেয়ে বাজার কাটতি ব্যক্তিনির্ভরতাই ভর করেছে এ ক্ষেত্রটিতে। সাংবাদিকতার মৌলিক উপাদান দায়িত্বশীলতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে বিনোদন সাংবাদিকতার শুরু চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করেই।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হই তখন ফেসবুক, ইউটিউব তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য সিনেমার পাশে এসে যুক্ত হয় ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার বা ভিসিআর। এ মাধ্যমটি বাংলাদেশে আসার পরপরই শুরু হয় এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। ঢাকার রায় সাহেব বাজার বা রাইশা বাজারে একটি কাঠ ব্যবসার দোকান বন্ধ করে দিয়ে সেখানে চলতো ভিসিআর-এর বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। একই এলাকার আরেকটি স্থান ছিল নিষিদ্ধপল্লীর পাশের একটি ভবনে। সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে দিয়ে চলতো ভিসিআর। একটি ভিডিও ক্যাসেটে তিন বা সাড়ে তিন ঘণ্টার পুরো একটি ছবি। এদেশের দর্শকের বেশি আকর্ষণ ছিল ভারতীয় হিন্দি ছবি। তখনই দর্শক অনেক বেশি পরিচিত হয়েছে ভারতীয় তারকাদের সঙ্গে। এছাড়াও ঢাকার বাজারে আসত উল্টোরথ নামে একটি সাময়ীকী। তাতে ভারতীয় তারকাদের অনুপুঙ্খ পাওয়া যেত। যাহোক, ভিডিও ব্যবসা এতোটাই রমরমা হয়ে উঠেছিল যে রাজধানী ঢাকার আনাচে-কানাচে সেটা বিনা বাধায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে উঠলো পর্নোগ্রাফি। রাত বারোটা পর্যন্ত মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমা প্রদর্শন শেষ করার পর শুরু হতো পর্ণোগ্রাফি ছবির প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আপত্তি ওঠে। 

সাংবাদিকতার জগতে পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন কবি রফিক আজাদ। তিনি আমাকে ডেকে ভিসিআর ও পর্নোগ্রাফি নিয়ে সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায় একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখে দিতে বললেন। এই সময়টাতে আমি কাজ করতাম সাপ্তাহিক ‘দি নিউ নেশন’ পত্রিকায়। যেমন সম্পাদকীয় নির্দেশ, ঠিক তেমনি কাজ। ভিসিআর প্রদর্শনীর স্থান ও পরিবেশ বোঝার জন্য পরপর দুইদিন আমি সেখানে কাটালাম। তারপর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখলাম। তার শিরোনাম ছিল ‘ভিসিআর কি চলচ্চিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী?’। রফিক আজাদ আমার কাছ থেকে লেখাটি নিয়ে সম্পাদনার জন্য দিলেন কবি আতাহার খানকে। তিনি লেখাটি দেখে প্রেসে পাঠিয়ে দিলেন। আমার মনে সে কি আনন্দ- বাংলায় আমার লেখা একটি প্রথম সারির সাময়ীকীর প্রচ্ছদ হচ্ছে! নিশ্চয়ই এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি দিয়ে আমার ক্যারিয়ারে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কারণ এই নতুন প্রযুক্তিটি নিয়ে এটাই ছিল বড় ধরনের লেখা। এজন্য আমাকে ‘গার্ডিয়ান’ ও ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার বেশ কিছু প্রতিবেদন পড়তে হয়েছিল। একটি প্রতিবেদনে পেয়েছিলাম শতাব্দীর শেষ দিকে আসছে আকাশ সংস্কৃতি। মানুষ তখন ২৪ ঘণ্টা টেলিভিশন দেখতে পারবে। এ লেখাটিও আমি ‘রোববার’র জন্য অনুবাদ করেছিলাম। 

যাহোক রোববার পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ থেকে ডাক পেলাম। আমার শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক চিন্ময় মুৎসুদ্দী বিচিত্রার তখনকার বিনোদন প্রতিবেদক অনুপম হায়াতকে দিয়ে আমাকে খবর পাঠালেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করার পর তিনি আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে আমাকে নিয়ে গেলেন বিচিত্রা সম্পাদক প্রয়াত শাহাদৎ চৌধুরীর কাছে। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ইংরেজী এবং বাংলা দুই ধরনের লেখাই আমি পড়েছি। তোমাকে আমার কাছে আধুনিক মন-মানসিকতার বলে মনে হয়েছে। তুমি বিচিত্রায় আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু কর। আশাকরি তুমি খুবই ভালো করবে। তোমাকে মাথায় রেখেই আমি ‘আনন্দ বিচিত্রা’ শুরু করব। আমার সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করে এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আমাকে চিন্ময়দার হেফাজতে ছেড়ে দিলেন। বিনোদন সাংবাদিকতায় আমি যেটুকু পরিচিতি পেয়েছি সেটুকু এই বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা থেকেই পেয়েছি।

বিনোদন সাংবাদিকতার সংবাদ কক্ষে আমার প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এই সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে কখনো আনন্দে সময় কেটেছে, কখনো বেদনাবিধুর। কিন্তু পরিস্থিতি যেমনটাই হোক না কেন কখনো সম্পাদকীয়-নীতি থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি। সাংবাদিকতাকে বলা হয় থ্যাংকসলেস জব। অনেক থ্যাংকস পেয়েছি যাদের নিয়ে লিখেছি তাদের কাছ থেকে। কিন্তু আমাদের সময়ে কখনো হাতে খাম তুলে দেওয়া হতো না। সাংবাদিকতার মর্যাদা এতো উঁচু স্তরে ছিল যে, কেউ সেটা করতে সাহস পায়নি। এখন বিষয়টা একেবারে ডালভাত। আমার জানা মতে একজন সাংবাদিক তারকাদের কাছ থেকে ঠিকা নেন, তিনি লিখে আট-দশ পত্রিকায় ছেপে দেবেন, তাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের একটা অর্থ দিতে হবে। লেখা ছাপাও হয় কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় বা যেগুলো ইন-হাউজ পত্রিকা। তারকার লাভের মধ্যে এটুকু লাভ হয়, তিনি ছাপার অক্ষরের টুকরোটি কেটে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে পারেন। আর সেখানে লিখতে পারেন ‘থ্যাঙ্ক ইউ অমুক ভাই’।

কিছু সাংবাদিককে এখন দেখা যায়, তারা ছবি বা নাটকের লোকেশনে যান। দ্রুত গতিতে কিছু ছবিও তোলেন। তারপর বলতে শুরু করেন, ভাই আমি খাব না। যাতায়াত ভাড়াটা দিয়ে দেন আমি বা আমরা চলে যাই। প্রশ্ন হচ্ছে, সব কিছুরই ইতি এবং নেতিবাচক দিক আছে। বিদেশে বিনোদন সাংবাদিকতা বা তারকা প্রমোটিং এজেন্সি আছে। আমাদের দেশেও সে রকম কিছু গড়ে উঠতে পারে। এছাড়া আর বিকল্প কি হতে পারে?

তারকা সন্ধান বা প্রমোটিংয়ের জন্য আনন্দ বিচিত্রা ‘ফটোসুন্দরী’ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। তার ফসল হিসেবে চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছে মৌসুমী এবং পপি। কিন্তু আনন্দ বিচিত্রা শাবনূরকে সরাসরি আনলেও আনন্দ বিচিত্রার হাত ধরেই শাবনূর তারকা হয়ে উঠেছিলেন। সেখানে মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছি আমি। অনেকেই বলে থাকেন তারা শাবনূরকে নিয়ে এসেছেন, আমি শুনেও না শোনার ভান করি। কথা বলি না। একবার বিনোদন বিচিত্রার ঈদ সংখ্যার একটি লেখার জন্য সাংবাদিক শাহ আলমগীর মৌসুমীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তার ক্যারিয়ারে কোন কোন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল। মৌসুমী তাকে এক ডজন সাংবাদিকের নাম বলেছিলেন। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই তিনি দু’চার লাইন করে বলে গিয়েছেন। আমার নামটি এসেছে প্রতিবেদনের শেষ দিকে। বিনোদন বিচিত্রার দুই পৃষ্ঠা ধরে আমার কথা লেখা হয়েছিল। প্রবাদ আছে যেমন কর্ম তেমন ফল। আজকে যারা বিনোদন সাংবাদিকতায় রয়েছেন তাদের উপরই বিনোদন সাংবাদিকতার মর্যাদা নির্ভরশীল। আশাকরি, তারা বিনোদন সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষা করবেন এবং পেশাদার সাংবাদিকতার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে আগামী প্রজন্মের কাছে অহঙ্কার হয়ে বেঁচে থাকবেন। নতুন বা বিনোদন সাংবাদিকতা কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান হয়েই থাকবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ