খুঁড়িয়ে চলছে জিকে সেচ প্রকল্প, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক
Published: 1st, February 2025 GMT
দিন দিন কমে আসছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতা। এক সময় ৪ জেলার ১৩টি উপজেলার ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হলেও এখন তার আওতা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে নির্মিত দেশের বৃহত্তম এ সেচ প্রকল্প নিয়ে নানা সমস্যা হচ্ছে। এক বছর ধরে দুটি সেচ পাম্প বিকল, খালগুলো ভরাট ও বেদখল, সংস্কার না হওয়া ও লোকবল সংকটে খুঁড়িয়ে চলছে কার্যক্রম।
সম্প্রতি জিকে প্রকল্পের আধুনিকায়নে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও সেটি আলোর মুখে দেখেনি। প্রকল্পটি পাস হয়ে বাস্তবায়ন হলে জিকের সেচ সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি ফসল উৎপাদন বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, খরাপ্রবণ এলাকা হওয়ায় কুষ্টিয়া অঞ্চলে ষাটের দশকে ভেড়ামারার মসলেমপুরে পদ্মা নদীতীরবর্তী এলাকায় পাম্প স্টেশন গড়ে তোলা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার ১৩টি উপজেলা দিয়ে প্রধান খাল খনন করা হয়। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খালের পাশাপাশি ৪৬৭ কিলোমিটার সেকেন্ডারি খাল আছে। এ ছাড়া টারশিয়ারি খাল আছে ৯৯৫ কিলোমিটার। তবে এসব খালের বড় অংশ বেদখল হয়ে গেছে। অনেক খাল ভরে গেছে ঝোপ-ঝাড়ে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মরফলজি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, ‘মূলত পদ্মার পানি ব্যবহার করে সেচ প্রকল্পটি সচল রাখা হয়। দুটি মৌসুমে পানি সরবরাহ করা হয়। রবি মৌসুমে বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদ হয়। খরিপ-২ মৌসুমে আমন ধানসহ ফসল উৎপাদনের জন্য পানি দেওয়া হয়।
ভেড়ামারায় জিকের প্রধান পাম্প স্টেশন। তিনটি বড় পাম্প আছে এই স্টেশনে। তবে দুটি পাম্প এক বছর ধরে নষ্ট। একটি পাম্প সচল থাকলেও সেটি চালানোর জন্য পদ্মায় পানির লেভেল কমপক্ষে ৪.
মরফলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রইচ উদ্দিন বলেন, পাম্প চালাতে হলে পানির উচ্চতা ৪.২ মিটারের ওপর থাকতে হবে। এর কম হলে পাম্প স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তাদের প্রস্তুতি আছে সেচ দেওয়ার। তবে সেটি পানির ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত যৌথ সমীক্ষার মাধ্যমে আমরা ভারত থেকে পানি পেয়ে থাকি। চুক্তি অনুযায়ী পানি পেলেও যে পরিমান পানি পদ্মায় থাকে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
পাম্প স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ২০০৯ সালে জাপানের একটি কোম্পানী থেকে ৩টি বড় পাম্প এনে স্থাপন করা হয়। তবে গত বছর তার দুটি বিকল হয়ে পড়ে। অন্যটি পানির অভাবে গত বোরো আবাদের সময় বন্ধ রাখতে হয়। জাপানের প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তারা পরিদর্শন করেছেন। কিছু যন্ত্রাংশ ইতোমধ্যে আনা হয়েছে। বাকি যন্ত্রাংশ বন্দরে এসেছে। ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে পাম্প মেরামত শেষে সচল করা সম্ভব হবে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে একসময় ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হলেও বর্তমানে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাচ্ছেন কৃষকরা। তাও বিভাজন করে দিতে হয়। একটি জেলা পেলে আরেক জেলার কৃষকরা পান না।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বরিয়া গ্রামের কৃষক আফসার উদ্দিন বলেন, ‘গত বোরো মৌসুমে ধান রোপণের আগে জানতে পারি, জিকে খালে পানি আসবে না। তখন বিকল্প উপায় না থাকায় অনেক জমি অনাবাদি রাখেন কৃষক। এবারও পানি পাব না বলে জানতে পেরেছি। তাই ধানের বদলে পেঁয়াজ ও ভুট্টা আবাদ করেছি, যাতে পানি কম লাগে।’
কৃষক মশিউর রহমান বলেন, আগে এ মাঠের কৃষকরা জিকের পানি দিয়ে ধান আবাদ করতেন। এক বিঘা জমিতে সারাবছর ধান আবাদ করতে খরচ হয় মাত্র ২৮০ টাকা। পানি না পাওয়ায় এখন শ্যালো মেশিনে পানি দিয়ে আবাদ করতে ৩-৪ হাজার টাকা লাগছে। তাও বেশি গরম পড়লে তেমন ওঠে না।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রশিদুর রহমান বলেন, ৪টি জেলায় জিকের খাল বিস্তৃত। আগে অনেক লোকবল ছিল। তখন খাল বেদখল হতো কম। লোকবল না থাকায় অনেক স্থাপনা ও খাল বেদখল হয়েছে। স্থাপনা নির্মাণ ছাড়াও বাড়িঘর করা হয়েছে। সংস্কার না হওয়াতেই এমন অবস্থা। উচ্ছেদের জন্য তালিকা করা হচ্ছে।
জিকের পাম্প হাউস আধুনিকায়নসহ খাল সংস্কারের জন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার টাকা কাটছাঁট করে সেটি ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় করার পরামর্শ দিয়েছে। কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বলেন, প্রকল্পের আওতায় দুটি বড় ও ৫টি ছোট পাম্প স্থাপন করা হবে। খাল সংস্কারসহ গাছ লাগানো হবে। নতুন পাম্প স্থাপন করা হলে পদ্মার পানি ৩ সেন্টিমিটারের নিচে নামলেও পানি সরবরাহ সচল থাকবে।
জিকে সেচ ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের সভাপতি সাফায়েত হোসেন পল্টু বলেন, গত বছর খালে পানি সরবরাহ না করায় অনেক সমস্যা হয়। অনেক জমি অনাবাদি ছিল। সেচ সরবরাহ সচল রাখা হলে ফসল উৎপাদন বাড়বে। পরিবেশও রক্ষা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প স চ প রকল প পদ ম র প ন প রকল প র সরবর হ র জন য ব দখল
এছাড়াও পড়ুন:
সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জনসহ ২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত মামলায় সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান ও ঢাকা উত্তরার বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শাহীনুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ মো. নজরুল ইসলাম অভিযোগপত্র পর্যালোচনা শেষে এ আদেশ দেন।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) বিকালে সাতক্ষীরা জজ কোর্টের দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান দিলু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আসামি ডা. তৌহিদুর রহমান সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের মৃত তফছির উদ্দিনের ছেলে। অপর আসামি মো. শাহীনুর রহমান মাগুরা জেলা সদরের কাদিরাবাদ গ্রামের একেএম ছিদ্দিকুর রহমানের ছেলে।
আরো পড়ুন:
সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
নড়াইলে গ্রাম আদালতে ৬৪১ মামলা নিষ্পত্তি
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মামলাটি করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, অনুমোদন ছাড়াই বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ব্যতীত সাতক্ষীরা ইনস্টিটিউট ও হেলথ টেকনোলজিতে (নলতা) ইকুইপমেন্ট সামগ্রী, আসবাবপত্র , বইপত্র সাময়িকী ও খেলাধুলার সামগ্রী কেনার জন্য ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখার পরিচালক বরাবর চিঠি পাঠান তৎকালীন সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ও সাতক্ষীরা ইনস্টিটিউট ও হেলথ টেকনোলজির সাবেক অধ্যক্ষ ডা. তৌহিদুর রহমান। অধিদপ্তরের প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যতীত নলতা আইএইচটিতে চাহিদা বরাদ্দ পাওয়ার আগেই খেলাধুলা সামগ্রীসহ অন্যান্য সামগ্রী কেনার জন্য বিধি বহির্ভূতভাবে বাজারদর কমিটি, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ও সার্ভে কমিটি গঠন করে ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহ্বান করেন ডা. তৌহিদুর রহমান।
২০১৮ সালের ১৫ মে ডা. তৌহিদুর রহমান রহমান ঢাকার উত্তরার বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজকে ১০টি ফুটবল, ২৫টি ক্রিকেট ব্যাট, ২১টি ক্রিকেট বল, ২০টি ক্রিকেট প্যাড, ১১টি ক্রিকেট হেলমেট, ১০টি ক্রিকেট গ্লাভস, ১৫টি ক্রিকেট স্টাম্প, পাঁচটি ২০ কেজি ওজন সেট, পাঁচটি ৫ ইঞ্চি স্টিক, পাঁচটি ৪ ইঞ্চি স্টিক, পাঁচটি ৩ ইঞ্চি স্টিক, পাঁচটি ১৪ কেজি ডাম্বেল, একটি ট্রিসেফ বার, ৫৬ পিস মাল্টি জাম, পাঁচটি চায়না আপ মেশিন, পাঁচটি ট্রেড মিল, চারটি সিট আপ বেঞ্চ, ছয়টি টিটি বোর্ড, ১০টি বাস্কেট বল, ১০টি ব্যাডমিন্টন সেট, পাঁচটি দাবা সেট, ১৫টি হ্যান্ডবল, ১০টি ভলিবল, ক্লাইন চেষ্ট প্রেস-এর চারটি স্মিথ মেশিন, কেবল ওয়ারের ২০টি লাফ দড়ি, পাঁচটি হ্যামার স্ট্রেনথ, পাঁচটি ইলেকট্রিকাল ট্রেনার এক্সসারসাইজ বাইক ও পাঁচটি ৫৬ ইঞ্চি ক্যারাম বোর্ড সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ প্রদান করেন।
পরবর্তীতে বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজ ২০১৮ সালের ২৪ মে মালামাল সরবরাহ করে ওই বছরের ১০ জুন ৫০ লাখ টাকার বিল দাখিল করে। ডা. তৌহিদুর রহমান রহমান বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. শাহীনুর রহমানকে ২০১৮ সালের ১০ জুন বিল পাশ করে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস বরাবর পাঠান। সে অনুযায়ী, হিসাবরক্ষণ অফিস সরকারি কর্তণ বাদে বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ২০১৮ সালের ১৪ জুন ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার চেক ইস্যু করে। পরে বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শাহীনুর রহমান টাকা তুলে নেন।
অভিযোগ অনুসন্ধানকালে কেনা ক্রীড়া সামগ্রীর সঠিক মূল্য একটি টিমের মাধ্যমে যাচাই করার জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ক্রীড়া অধিদপ্তর, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিচালককে অনুরোধ করে। ২৬ সেপ্টেম্বর নলতা আইএইচটি ও ম্যাটস এর কেনা ক্রীড়া সামগ্রীর মূল্য নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুদকের তদন্তকারী টিম ১০ অক্টোবর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের সরবরাহকৃত ক্রীড়া সামগ্রীর মূল্য ২৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫০ টাকা। প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ৫ লাখ ৫০ হাচার টাকা কেটে নিয়ে ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। এক্ষেত্রে বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজকে ২০ লাখ ৬১ হাজার ৬৫০ টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ডা. তৌহিদুর রহমান রহমান ও মো. শাহীনুর রহমান পরস্পর যোগসাজশে ২০ লাখ ৬১ হাজার ৬৫০ টাকা আত্মসাৎ করে অপরাধ করেছেন।
আদালতে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান দিলু বলেন, “গত ২৮ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমানের দায়েরকৃত অভিযোগপত্রটি পর্যালোচনা শেষে বিচারক মো. নজরুল ইসলাম অভিযুক্ত দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়ে ১৬ মার্চ শুনানির ধার্য দিন নির্ধারণ করে দেন। সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।”
ঢাকা/শাহীন/মাসুদ