গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও আর্থসামাজিক সংস্কার
Published: 1st, February 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তাদের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়ে শুধু প্রস্তাবই পেশ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে। তারপরও জরুরি সমস্যাগুলো সমাধানে তাদের মনোনিবেশ করতে হবে। তাদের একটি প্রধান কাজ হবে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সূচক বা বেঞ্চমার্কগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা। ঘাড়ের ওপর পড়ে যাওয়া জরুরি সমস্যাগুলোর সমাধান করে জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়াও এ সরকারের দায়িত্ব। সুতরাং আমার মতে, তাদের মূল দায়িত্ব হবে সঠিক ও স্বল্পসংখ্যক পদক্ষেপ গ্রহণ করা (ফিউয়ার অ্যান্ড বেটার)। প্রত্যাশিত এসব কাজ তারা কতদূর করতে পেরেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা এখানে করব।
এ ছাড়া সরকারের টাস্কফোর্স ও কমিশনগুলো নানা রকম সৃজনশীল ও অপ্রচলিত (ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড ইনোভেটিভ) সংস্কার প্রস্তাব ইতোমধ্যে জমা দিয়েছে। কিছু সুপারিশ প্রণয়নের কাজ চলমান। অর্থনীতির হালহকিকতের ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তার বিভিন্ন তথ্য নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা রয়েছে। এগুলো সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক কিছু মন্তব্য এ প্রবন্ধে তুলে ধরা হবে।
শ্বেতপত্রে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত একটি গ্রন্থের মডেল ও স্টাডি ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার অতীতে যতখানি সরকারি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি। সম্প্রতি এই মডেলের কিছুটা সমালোচনা ও মার্জনা করে ফরেইন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের সাবেক ডেপুটি প্রধান অর্থনীতিবিদ নিক লি মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়ার আগে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ওই দাবি যদি সঠিকও হয় তাহলেও দেশটির দীর্ঘদিন ধরে অর্জিত জিডিপি হয়তো কমতে পারে কিন্তু একেবারে মুছে যাবে না।
সম্প্রতি রেহমান সোবহান মন্তব্য করেছেন, দুর্নীতি ও বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আসলে কীভাবে চরম দারিদ্র্যহার কমল এবং মানব উন্নয়ন সূচকগুলোতে উন্নতি অর্জিত হলো– সেটি বর্তমান উন্নয়নবিদদের তলিয়ে দেখা দরকার। কিছুই অর্জিত হয়নি– এ কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি যেটুকু অর্জন সম্ভব ছিল, তা যে অনেকখানি দুর্নীতি ও বৈষম্যের কারণে অর্জন করা সম্ভব হয়নি– এটি আজ সবাই স্বীকার করেন।
বোঝা যাচ্ছে, আগামী যে বাজেট অন্তর্বর্তী সরকার প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, তাতে তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে:
১.
২. বাজেটে যে প্রচণ্ড রাজস্ব ঘাটতি থাকবে তা কীভাবে পূরণ করা হবে?
৩. ব্যক্তি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হার যথাসম্ভব ধরে রাখা যায় কীভাবে তার উপায় উদ্ভাবন, অর্থাৎ বিনিয়োগ আবহাওয়ার উন্নতি করে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কীভাবে অব্যাহত রাখবেন?
৪. মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা দুই-ই কাটিয়ে অর্থনীতিতে কীভাবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা আনবেন?
নিঃসন্দেহে এগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং ও পুঞ্জীভূত কঠিন সমস্যা। এর জন্য যেসব জরুরি নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন, বিশেষত আর্থিক খাত, জ্বালানি খাত, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বাজার
ব্যবস্থাপনায় যেসব আশু জরুরি সংস্কার শুরু করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে, তা অন্তত শুরু না করতে পারলে জনগণের মনে প্রয়োজনীয় বিশ্বাস, আস্থা বা ‘স্বস্তি’ ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং গোলযোগ ও সামাজিক বিরোধ আরও বাড়বে, যার সুস্পষ্ট লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে।
সুশাসন ও শৃঙ্খলার জন্য যেসব বিষয় জরুরিভাবে নিশ্চিত করা দরকার সেগুলো হচ্ছে–
১. জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকালে নিহত-আহতদের একটি সুস্পষ্ট সঠিক তালিকা প্রণয়ন, চিকিৎসা প্রদান এবং পুনর্বাসন।
২. যেসব পুলিশ, শিক্ষা কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য কমবেশি অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদের নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ন করে অপরাধের ধরন অনুসারে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।
৩. মব ভায়োলেন্স বন্ধ করে সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ নিতে পারলে দেশে কিছুটা শৃঙ্খলা ইতোমধ্যে ফিরে আসত। পুলিশও কাজে ফিরে আসতে আস্থা পেত।
৪. আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণগ্রহীতা, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা, বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতিকর দেশি-বিদেশি চুক্তির কমিশনভোগী, মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে চিহ্নিত
দুর্নীতিবাজদের নাম এবং অপরাধ প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. সর্বোপরি শ্বেতপত্রে যে বড় অঙ্কের টাকা পাচারের কথা বলা হয়েছে, সেটি কীভাবে উদ্ধার হবে তা বলা কঠিন। বর্তমানে বিদেশি ভাড়া করা কোম্পানি ও দুদকের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা চলছে। এর ফলে শত্রুদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং নতুন বেকারত্ব সৃষ্টি হতে পারে। আমি এ অভিযান থামিয়ে দিতে বলছি না; সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বলছি।
৬. আশু যে কাজটি এখনও করে ওঠা যায়নি, তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। নিম্নবিত্ত বিশেষত শিল্পশ্রমিক, কৃষক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের প্রকৃত আয়ের সুরক্ষা প্রদান করে তাদের দ্রব্যমূল্যের আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত।
৬. বাজারে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী কারা, আদৌ তাদের চিহ্নিত করে ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য
মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা, সে প্রশ্ন আছে। তবে ক্রেতা সমবায় ও বিক্রেতাদের সমবায় তৈরি, রেশন, ওপেন মার্কেট অপারেশন ও খাদ্যের বিনিময়ে কাজ, গ্রাম-শহরে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা স্কিম চালু করা ইত্যাদি সুযোগ এখনও উন্মুক্ত।
উপসংহারে বলব, বাংলাদেশে যে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার পরিপূরক হিসেবে রাজনীতিতে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব ও ফ্যাসিস্টসুলভ প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা থেকে রাতারাতি মুক্তি পাওয়া কঠিন। তবে অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বহুদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কীভাবে নিদেনপক্ষে একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা ১৯৯০ সালেই এরশাদকে হঠানোর পর ২৮টি টাস্কফোর্স রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন। সেখানে ভালো ভালো সুপারিশ ছিল। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তৎকালীন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সেগুলো প্রণয়নে কোনো বাড়তি অর্থ খরচ না করেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, এগুলো প্রথমে বিএনপি সরকার এবং পরে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি।
প্রশ্ন তাই থেকেই যায়, এবারও এই রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার না হলে অথবা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার বিকল্প শক্তি জনগণের মধ্যে তৈরি না হলে সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর অগ্রসর হবে? ভবিষ্যৎ যত অনিশ্চিতই মনে হোক, দেশে যেন অন্তত মুক্তিযুদ্ধের মতো মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো নতুন বাগ্বিতণ্ডা-গৃহযুদ্ধ না হয়।
এম এম আকাশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত প রণয়ন র জন য র জন ত ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের পাহাড়
মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের একটি পাহাড়। বহু বছর পর এমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এর মানে তারানাকি মাউঙ্গা (মাউন্ট তারানাকি) নিজের মালিকানা কার্যকরভাবে পাবে। এটি পরিচালনায় একসঙ্গে কাজ করবে স্থানীয় উপজাতি, ইউয়ি এবং সরকারের প্রতিনিধিরা। খবর বিবিসির
এই আইন প্রণয়নের লক্ষ্য উপনিবেশ আমলে তারানাকি অঞ্চলে ভূমি বাজেয়াপ্ত, অবিচারের শিকার হওয়া মাওরিরা ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
আলোচনার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পল গোল্ডস্মিথ বলেছেন, ‘অতীতের ভুলের কারণে যে বেদনা রয়ে গেছে, তা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। যাতে ইউয়িদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে তাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা সহায়তা করতে পারি।’
গত বৃহস্পতিবার জীবন্ত সত্তা ঘোষণার তারানাকি মাউঙ্গা কালেক্টিভ রিড্রেস বিলটি নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাস হয়। তাতে পর্বতটি একটি আইনি নাম পেয়েছে এবং এর আশপাশের চূড়া ও জমিকে দেওয়া হয়েছে সুরক্ষা।
পর্বত, পূর্বপুরুষ, জীবিত প্রাণীসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে মাওরি বিশ্বদর্শন রয়েছে, সেটির স্বীকৃতি মিলেছে বিলটি পাসের মধ্য দিয়ে।
রাজনৈতিক দল থে পাথি মাওরির (মাওরি পার্টি) সহ-নেতা ডেবি নারওয়ে-প্যাকা বলেন, ‘আমাদের মাউঙ্গা টুপুনা (পূর্বপুরুষের পর্বত) অবিচার, অজ্ঞতা ও ঘৃণার শৃঙ্খল থেকে আজ মুক্তি পেয়েছে।’
নারওয়ে প্যাকা নিউজিল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে আটজন তারানাকি ইউয়িদের মধ্যে একজন, যার কাছে পর্বতটি পবিত্র। এলাকাটির আরও শত শত মাওরি নাগরিক বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে উপস্থিত হয়েছিলেন বিলটির আইনি রূপান্তর দেখতে।
বিবিসি লিখেছে, পর্বতটি আর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এগমন্ট’ নামে পরিচিত হবে না, যে নামটি ১৮ শতকে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পরিব্রাজক জেমস কুক। এখন এটি ‘তারানাকি মাউঙ্গা’ নামে পরিচিত হবে। আর চারপাশ ঘিরে থাকা জাতীয় উদ্যানটিও পাবে মাওরি নাম।
যে চুক্তির মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আদিবাসীরা জমি ও সম্পদের নির্দিষ্ট অধিকার পেয়েছিল; সেই ওয়েটাঙ্গি চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ক্ষতিপূরণের সর্বশেষ প্রয়াস তারানাকি মাউঙ্গা বন্দোবস্ত।
১৮৬০ এর দশকে তারানাকি পর্বত এবং স্থানীয় মাওরিদের কাছ থেকে ১০ লাখেরও বেশি একর জমি বাজেয়াপ্তের ঘটনায় সরকারের তরফে ক্ষমা প্রার্থনার অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই বন্দোবস্তকে।
পল গোল্ডস্মিথ স্বীকার করেছেন যে, ‘চুক্তি লঙ্ঘনের অর্থ হল হোয়ানু (বৃহত্তর পরিবার), হাপু (উপ-উপজাতি) এবং তারানাকির ইউয়ির ব্যাপক পরিসরের ক্ষতি; যা বহু দশক ধরে অপূরণীয় হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি আরও বলেন, পর্বতটিতে প্রবেশাধিকার আর পরিবর্তন হবে না এবং নিউজিল্যান্ডের সব বাসিন্দা এই জায়গাটি পরিদর্শন করতে পারবে এবং আগামী প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্দান্ত এ জায়গাটি উপভোগ করতে পারবে।
নিউজিল্যান্ডে এর আগেও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি পাওয়ার নজির রয়েছে। ২০১৪ সালে উরেওয়েরা বন প্রথম এই জাতীয় মর্যাদা অর্জন পায়। এরপর ২০১৭ সালে এমন স্বীকৃতি পায় হোয়াংগানুই নদী।