বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতায় ভারতের দায়
Published: 1st, February 2025 GMT
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ভিন্ন মেরূকরণ ঘটছে। গত ১১ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকায় এসে যদিও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সচিবের সঙ্গে দেখা করে সম্পর্কোন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তাতে বরফ খুব বেশি গলেছে বলা যাবে না। দুই দেশের সম্পর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে উৎকণ্ঠা বিরাজমান, তা দূর করার জন্য আরও অনেকদূর যেতে হবে।
ওই সফরের সময় রীতি অনুযায়ী যৌথ সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও তা দেখা যায়নি। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র সচিব
সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। এটি বার্তা দেয় যে ভারত একটি বিশেষ অবস্থায় আলোচনার টেবিলে এলেও কিছু ‘রিজারভেশন’ রয়ে গেছে। পরবর্তী সময়েও ভারতীয় সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ‘সীমিত’ রেখে তারা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। তারা এও বলতে চায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো চুক্তির মধ্যে আসবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসে।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকেই ভারত জোরালোভাবে বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে দেখার কথা বলা হলেও তাঁর আইনি সহায়তার বিষয়ে গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছে ভারত।
অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ছেদ বা বিভেদ তৈরি করেছে। শেখ হাসিনা যেসব বিবৃতি দিচ্ছেন, সে বিষয়ে ভারতের কোনো সমর্থন নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা দেখছি, গত সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে যে ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কি সে বিষয় ভারতের সঙ্গে আলোচনায় যথাযথভাবে তুলে ধরেছে?
যেমন– বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে শেখ হাসিনাকে একটি পুতুল সরকারে পরিণত করেছিল ভারতই। এ কারণে বাংলাদেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। গত দেড় দশকে বাংলাদেশে যে ধরনের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেটি জনগণের কাছে কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এর ফলে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ সৃষ্টি হয়েছে। এ গণঅভ্যুত্থানে দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা আত্মাহুতি দিয়েছেন। অনেকেই অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। ভারত কি এর দায় এড়াতে পারে?
গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কটি মূলত দুই দেশের জনগণের সম্পর্ক না হয়ে শুধু সরকারপ্রধানদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। সুনির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, সরকার গঠন করা হয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন শেখ হাসিনা চক্রান্ত, অনিয়ম, কারচুপির মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন। গুম, হত্যাকাণ্ড, দমন-নিপীড়ন ও অত্যাচারের মাধ্যমে তিনি স্বৈরশাসন বজায় রেখেছেন। জনগণের সম্পদ ও ব্যাংক লুটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। এমন জঘন্যতম দুর্নীতি ও অত্যাচার সহজ হয়েছে কেবল মোদি-
হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। দেশে পুলিশ প্রশাসন, আমলাসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে অনুগত ও অদক্ষদের নিয়োগ দিয়ে বিতর্কিত ও নষ্ট করা হয়েছে। যার ফলে বিরোধী মত ও বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ করলে তা সহজেই এসব তল্পিবাহককে দিয়ে প্রতিহত ও নির্মূল করা হয়েছিল। এর দায় মোদি-হাসিনার সম্পর্কের ওপরও যে বর্তায়, তা কীভাবে অস্বীকার করবে ভারত?
এটাও মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘু সংকট দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহাসিক সংকট। দেশভাগের সময় থেকেই এর সূচনা এবং এখনও চলছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, এমনকি নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সংকট রয়েছে। বাংলাদেশ বরং সব সময়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এসেছে।
বস্তুত বাংলাদেশ কখনোই সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। এমনকি ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদে হামলা ঘিরে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল, তখনও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছিল। এ বিষয়টি ভারতকে ভুলে গেলে চলবে না।
মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তখনই, যখন উভয় দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের সরকার গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত সহযোগিতা করতে পারত। গত সাড়ে ১৫ বছর তা অনুপস্থিত ছিল।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের জনগণের সরকারের একটি বলিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলাই মূলত দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মূল সূচনা বিন্দু হতে পারে।
ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক পরর ষ ট র সরক র র জনগণ র কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সেনাবাহিনীকে নিয়ে আনন্দবাজারের সংবাদ মিথ্যা: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। প্রতিবেদনের বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এটি শুধুই একটি বলিউডি রোমান্টিক কমেডি।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ফ্যাক্টস ফেসবুকে তাদের ভেরিফায়েড পেজে এক পোস্টে লিখেছে- ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলিউডের রোমান্টিক কমেডির চেয়েও বাস্তবতার সাথে কম মিল রয়েছে।’
প্রেস উইং ফ্যাক্টস আরো বলেছে, ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ কৌশল ব্যবহার করছে, যা দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রক্সি হিসেবে কাজ করা শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেওয়া এবং বাংলাদেশের জনগণ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসম্মান করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের যে জনগণ ও প্রতিষ্ঠানগুলো গত জুলাই-আগস্টে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে, তাকে টার্গেট করা হচ্ছে।
আরো পড়ুন:
গ্রিন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগে নবীনবরণ অনুষ্ঠিত
নিটার ১৪তম ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন, নবীন শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতার আহ্বান
হাইব্রিড যুদ্ধের অংশ হিসেবে তথ্য পরিচালনা বা ‘অপতথ্য’ ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে লক্ষ্যবস্তুকে অভ্যন্তরীণ এবং তার স্বাভাবিক বন্ধু ও মিত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।
বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা সাধারণত একেবারে মনগড়া একটি গল্প দিয়ে শুরু হয়, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি বা প্রমাণ থাকে না, বরং নামহীন ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বানানো হয় এবং তা বন্ধুত্বপূর্ণ বা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
প্রেস উইং ফ্যাক্টস উল্লেখ করে-‘যদি গল্পটি যথেষ্ট চটকদার হয়, তাহলে অন্যান্য সংবাদমাধ্যম এটি তুলে নেবে এবং প্রচারের ফলে এটি বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘একপর্যায়ে, যারা বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান কিন্তু বিশদ বিশ্লেষণের সময় পান না, তারাও এই গল্পটি সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারেন, যা মূলত একজন প্রোপাগান্ডাবিদের কল্পনাপ্রসূত ধারণা ছাড়া আর কিছুই না।’
ফ্যাক্টস আরো উল্লেখ করেছে, মিথ্যা প্রচারণা ও অপতথ্যে বিশ্বাস করে মানুষ যখন যার বিরুদ্ধে প্রচার হচ্ছে, তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, তখন তা পুরোপুরি সফল হয়।
এই ক্ষেত্রে, প্রতিপক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের নিজস্ব সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনার আকাঙ্ক্ষা। আর স্বেচ্ছায় এই মিথ্যা প্রচারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে আনন্দবাজারের প্রতিবেদন বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই; এটি শুধুই একটি বলিউডি রোমান্টিক কমেডি।
ফ্যাক্টস আনন্দবাজারের উদ্দেশে বলেছে, ‘আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কি প্রকৃত সাংবাদিকতা করবেন, যেখানে সত্য ঘটনা অনুসন্ধান করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, নাকি মিথ্যা প্রচারণার অংশ হিসেবে মিথ্যা গল্প ছড়িয়ে একটি বন্ধুপ্রতীম দেশের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবেন?’
ঢাকা/এসবি