গণশুনানিতে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন অভিযুক্তরা
Published: 1st, February 2025 GMT
জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ আয়োজনকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ লোকজনের ভাঙচুরের ঘটনায় গণশুনানি হয়েছে। শনিবার বেলা ১১টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় অভিযুক্তরা ‘অনুতপ্ত’ হয়ে ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ চান। তারা ভবিষ্যতে মেয়েদের খেলায় বাধা দেবেন না বলেও অঙ্গীকার করেন।
আজ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দেবী চন্দ সরেজমিন তদন্তের জন্য আক্কেলপুরে আসেন। উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত গণশুনানিতে তিনি তিলকপুরের স্থানীয় আলেম সমাজ, খেলার আয়োজক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, গণমাধ্যমকর্মী ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় ভুল বোঝাবুঝি কারণে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে ক্ষমা চান তিলকপুর বাচ্চাহাজী কওমি মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক।
মাঠে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। নিন্দা জানায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ঘটনা তদন্তে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত টিমের প্রধান উপসচিব দেবী চন্দ, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মনির হোসেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম, আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম শনিবার বিকালে ঘটনাস্থল তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ পরিদর্শন করেন।
গণশুনানিতে তিলকপুর বাচ্চাহাজী কওমি মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক হাফেজ মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘নারীদের ফুটবল খেলার বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে এমন ঘটনা ঘটেছে। আমরা অনুতপ্ত।’
তদন্ত কর্মকর্তা দেবী চন্দ বলেন, যারা ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমরা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। প্রতিবেদন দাখিলের পর সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মাঠে ভাঙচুরের প্রতিবাদ ও খেলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে জয়পুরহাট শহরে মানববন্ধন হয়েছে। শনিবার শহরের পাঁচুর মোড় চত্বর এলাকায় নারী-পুরুষ খেলোয়াড় ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর অংশগ্রহণে এ মানববন্ধন হয়। এ সময় বক্তব্য দেন নারায়ণগঞ্জ একাডেমি থেকে আসা জয়পুরহাট মহিলা ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড় রাজ্ঞীময়ী, জয়পুরহাট মহিলা ফুটবল ক্লাবের কোচ কানাই দাস, ক্লাবের সহসভাপতি জনি, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চন্দন, জেলা বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল ওহাব প্রমুখ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ টবল ত লকপ র তদন ত ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
বিজয় যখন কড়া নাড়ছে
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। দেশবাসীসহ বিশ্ব জানতে পারে, জাতিগত গণহত্যার মধ্যেই চলেছিল পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এখানে সে সময়ের একটি আলোচিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
আত্মসমর্পণের আগে
ঢাকায় বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরের বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। আকস্মিক সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে নিবিড় পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি এলিট নিধনের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটা অবশ্যই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তান হাই কমান্ডের পূর্ণ জ্ঞাতসারে ঘটেছে।
এসব মৃতদেহের আবিষ্কার ঢাকা শহরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, পাল্টা হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকার মূল শহরের পাশের রায়েরবাজারে কতগুলো বিচ্ছিন্ন গর্তে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আমি নিজে ৩৫টি গলিত দেহ দেখেছি। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগে নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে। ঢাকায় অপহরণ করা এ ধরনের লোকের সংখ্যা অন্তত ১৫০ হতে পারে।
ইউপিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান হৃদ্রোগ চিকিৎসক ফজলে রাব্বী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী রয়েছেন। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকা ধানমন্ডির বাইরে একটি ইটখোলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল কর্দমাক্ত জলাশয়ে শোভা পাচ্ছে। স্থানটি লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ ঢাকার শত শত মানুষ মাটির বাঁধ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে, তাদের অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের।
বিশিষ্টজনদের অপহরণ করে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালেই। পাঞ্জাবি সেনাদের কয়েকটি স্কোয়াড নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে নির্ধারিত পুরুষ ও নারীকে সশস্ত্র পাহারায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সম্ভবত রায়েরবাজার ইটখোলায় এনে মাটির বাঁধের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, যাতে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নিচের জলাশয়ে পড়ে যান।
ড. আমিনুদ্দিন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান, অক্সফোর্ডের পিএইচডি। পাকিস্তানি সেনারা যখন তাঁকে তুলে নেয়, সেই মঙ্গলবার সকাল সাতটায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যায়। নাজিউর রহমান বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকেও যেতে হচ্ছে, খুঁজে দেখি।’ ততক্ষণে তিনিও উলের মাফলার দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছেন।
গতকাল আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম, ততক্ষণে ইটভাটার এই খবর তেমন ছড়ায়নি। জনতা উত্তেজিত, তবে আচরণে অদ্ভুত কোমলতা। ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গাড়িতে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।
সেদিনও অনেক গোলাগুলি হয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি তখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাঙালিরা অভিযোগ করছে, বিহারি এই বিদেশিরা বহু বছর আগে মুসলমান হিসেবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তারা বাঙালি হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সাহায্য করেছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম, এ কারণেই সেখানে বেসামরিক বিহারিদের হত্যা করা হয়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড যশোরের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ একটি ব্যাপার। কাজেই একধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারায় সেনানিবাসে বন্দী পাকিস্তানি সেনারা এখনো সশস্ত্র, যদি প্রয়োজন পড়ে! ঢাকা যখন জেনে যাবে পাকিস্তানি সেনারা কত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তখন দেখা দেবে সত্যিকারের সংকট। যা-ই ঘটুক, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া বাঙালিদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এভাবে খেলাচ্ছলে অপ্রয়োজনে, উন্মত্তের মতো খুন করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য।
যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরও বেশি ভয়ংকর।
গত মঙ্গলবারের অনেক আগেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। যেসব কর্মকর্তা এই পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরাও তা অবশ্যই জানেন। কাজেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ধসিয়ে দেওয়া। বহুদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।
ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ: এম এ মোমেন
দ্য সানডে টাইমস, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১১, পুনর্মুদ্রিত