এবার গুলশান-১ গোলচত্বর অবরোধ তিতুমীর শিক্ষার্থীদের, ভোগান্তি
Published: 1st, February 2025 GMT
সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিসহ সাত দফা দাবিতে রাজধানীর গুলশান-১ নম্বর গোলচত্বর অবরোধ করেছেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা। শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা সেখানে অবস্থান নেন। এতে মহাখালী থেকে গুলশান-১ এ যাওয়ার বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কের উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই সড়কে চলাচলকারী মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন।
এদিকে টানা তৃতীয় দিনের মতো আজ সড়ক অবরোধের কারণে গুলশান, বাড্ডা, মহাখালী ও তেজগাঁও অঞ্চলের বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে ফলে এই সড়কে চলাচলকারী মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিশেষ করে অফিসফেরত মানুষকে দীর্ঘসময় যানজটে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
এর আগে ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে মহাখালীতে সড়ক অবরোধ করেন। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর আবার কলেজের সামনে ফিরে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে তারা গুলশান-১ নম্বর চত্বরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।
আন্দোলনকারীদের একজন শিক্ষার্থী জাহিদ রানা বলেন, আমরা ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়াসহ সাত দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। আমার ভাইয়েরা এ নিয়ে অনশন করে যাচ্ছে, অথচ প্রশাসন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাই আমরা পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এখানে সড়ক অবরোধ করেছি।
এখানে কতক্ষণ সড়ক অবরোধ করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে কেউ এসে বিষয়টি সুরাহা না করছেন, ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে।
এসময় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে শোনা গেছে। তারা বলছেন, ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘তিতুমীর আসছে, রাজপথ কাঁপছে’, ‘শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য, চলবে না চলবে না’, ‘অধ্যক্ষের সিন্ডিকেট, মানি না মানবো না’, ‘আমাদের সংগ্রাম, চলছে চলবে’।
এসময় যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় মহাখালী আমতলী এলাকায় জলকামানসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত ত ম র কল জ অবর ধ সড়ক অবর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
একলা রাতের অন্ধকারে
আমি কি পাস করেছিলাম কখনও, ফেল-এর কথা লিখব? জীবনের যত সংকট, পরীক্ষার নামান্তর যদি হয়, ফেলই তো করেছি সারাবেলা। হয়তো খুব টেনেটুনে উতরে গেছি দুয়েকবার, তা দিয়েই চলছি, তা নিয়েই চালিয়ে নিচ্ছি। আর তা দিয়ে কেটেছে বেলা, চলেছে পরিণতিতে। একবার স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলে আমার এক শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, এত ভাবনার কী আছে? ফলাফল তো দুটি– হয় পাস, নয় ফেল। যে কোনো একটা তো হবেই। তাই তো যে কোনো একটা তো হবেই– হয় পাস, নয় ফেল। হয় জীবন, না-হয় মৃত্যু। দুয়ের বাইরে তো জীবন ও জগতে কিছু নেই; সাদা আর কালো দুটি রঙে রাঙিয়ে নিয়েছি চেতনার রং। পান্নাকে করেছি সবুজ, চুনিকে রাঙিয়েছি। ধূসর যা কিছু অস্পষ্ট পাস আর ফেইলের মাঝামাঝি কিছু অস্তিত্ব কই তার? তবু এই জীবন আর মৃত্যু নিয়ে মানুষের কী অক্লান্ত দৌড়ঝাঁপ। অতর্কিতে পাওয়া এক জীবন মানুষ হারাতে পারে অতর্কিতে। তবু কত ভালোবাসা প্রতিটি মুহূর্তের জন্য। কত চুলচেরা হিসাব। হারলাম, না জিতলাম। জিততেই হবে। প্রত্যেকের এ এক অবাস্তব দৌড়। দৌড়...দৌড়...। যেন জেতাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। হারা যদি হয় ফেইলের নামান্তর, ফেল করা যাবে না কিছুতেই। জেতার লক্ষ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত জীবন শেষে ফল হাতে নিয়ে আবিষ্কৃত হয় অজস্র ফেইলে ভরে আছে জীবনের রিপোর্ট কার্ড। সবাই যদি জেতেই কেবল, হারবে কে? অথবা কে আছে এমন খালি জিতেই গেছে? কোনো না কোনোভাবে কোথাও না কোথাও তার ফেল অনিবার্য নিয়তি। তবু মানুষ বাস্তবতা ভুলে প্রতিটি মুহূর্তকে মেপে নিতে চায় পাস-ফেইলের দাঁড়িপাল্লায়। আর আমার এই না মাপা পর্যবসিত হয় বোকামিতে। যারা আমাকে বোকা বলে, জীবন আর অনুভবের মধ্যবর্তী সংযোগ সুতোয় বসে আমি বরং আমার ফেলকেই উদযাপন করি পরম স্বস্তিতে।
আমি কি কখনও ফেল করেছিলাম, ফেইলের কথা লিখব। প্রথম ফেল। আসলে পাস-ফেল কি কেবলই একাডেমিক শ্রেণিকক্ষের পরিমাপক? স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার সময় প্রথম যখন প্রথম হয়ে গেলাম, তখনও এর মর্যাদা বুঝিনি। কাইদাজম, বাড়ির কাছের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে এই নামেই ডাকতাম তখন; বড় হতে হতে জানলাম আসলে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে স্কুলটির নাম ছিল কায়েদ-এ-আজম। ৩০ লাখ প্রাণ ঝরে গেছে, পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছে নতুন দেশ, স্বাধীন পতাকা, সার্বভৌম সীমানা। তবু নাম আঁকড়ে আছে লোকমুখে, বিকৃত হয়েও। সেই কাইদাজম স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কেবল নামটি মনে আছে তাঁর, বিভাদি। শহরের একমাত্র দাঁতের ডাক্তার অনিল দাদুর স্ত্রী, পারিবারিক সম্পর্কের খাতিরেই বোধকরি আমাকে এক পোটলা চীনাবাদাম কিনে দিয়েছিলেন। অমূল্য সেই পোটলা নিয়ে আমার নৃত্য দেখে কে। নাচতে নাচতে মায়ের হাতে গুঁজে দিয়েছি সেই বাদামের পোটলা, জীবনের প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত উপহার। অথচ এর চেয়ে অনেক অনেক মূল্যবান লাল কালিতে ‘১ম’ লেখা টুকরো কাগজটা আমি বুঝিনি তখনও।
পরে বড় হতে হতে জানা হয়েছে জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে, সাফল্য কিংবা ফুটানির প্রয়োজনে ক্লাসে প্রথম হতে হয়। জীবনের পরীক্ষায় পাস করতে হয়। যে পাস করে সময় তার পাসের গাথা নানা রং বাহারে লিখে রাখে, পৌঁছে দেয় ভবিষ্যতের কাছে। কিন্তু ফেল যে করে তার কাছে কেউ জানতে চায় না ফেইলিউরের কারণ। পৃথিবীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় না পরাজিতের কোনো গাথা। তার জন্য কোনো করুণা নেই। মায়া নেই। আক্ষেপ নেই, ক্ষমা নেই। সে ইরেজ হয়ে যায় সময়ের পাতা থেকে।
আমি পাস করেছিলাম কবে যে প্রথম ফেইলের গল্প লিখব। জীবন তো অসংখ্য ফেইলের সমাহার। তবু প্রথম ফেল! জ্যামিতি বক্সে বেতনের টাকা রেখে ক্লাসে ঘোষণা দিয়েছিলাম– এই আমার ব্যাগে কিন্তু টাকা আছে, কেউ নিও না। ফের বারান্দা থেকে ক্লাসে ফিরতেই দেখি টাকা নেই। জ্যামিতি বক্সসহ উধাও। ভয় পেয়েছিলাম বাবার বকাকে। কিন্তু আমাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে সেদিন কিচ্ছুটি বলেননি তিনি। পরদিন সন্ধ্যায় বুঝিয়ে বলেছিলেন, এই দুনিয়া কতটা কঠিন। আমি যে সরলতায় বিশ্বাস করি, আমি না করে গেলে আমার টাকা কেউ নেবে না; সেই সরলতা দিয়ে দুনিয়া চলে না। হ্যাঁ, ফেল তারাই করে, যারা বিশ্বাস করে। সরলতা দিয়ে জটিল পৃথিবী দেখে। আমার জীবনের প্রথম ফেল বোধহয় সেটাই। সেই সরল বিশ্বাসকে হারানো। জীবনকে দেখার দর্শনে ধাক্কা লাগা।
সেই কৈশোরে জানা হয়েছিল জীবন এবং জগৎ সরল নয়, যেমন সরল করে আমি ভাবি। তাই বলে কি জটিল জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে জটিল করে তুলতে পেরেছিলাম যে আমার প্রথম ফেলই শেষ ফেল হবে। পরের জন্য কাষ্ঠাহরণ যাহার স্বভাব– আমি সেই নবকুমার। এই একটু কায়দা করে, চালাকি করে, জটিল করে কেবল পাসের পর পাস করে যাব, নিজেকে এভাবে কেঁচেগণ্ডূষ করা যায় না। কেউ কেউ চাইলেও পারে না। সরল বোকামি অন্তর্গত রক্তে বাস করে। চাইলেই উপড়ানো যায় না। আমিও পারিনি। ফেইলের পর ফেল করে গেছি। বুঝেও ফেল করেছি, না বুঝেও ফেল করেছি। প্রতিটি ফেলকেই ভেবেছি প্রথম ফেল। কিন্তু আত্মদহন হয়নি। ফেইলের ক্ষতিতে ভেঙেচুরে গেছি। জীবনজুড়ে মাশুল দিতে দিতে প্রতিদিন ফেলগুলো দেখি, নিজেকে করুণা করি, বাহবাও দিই। ফেল করেছি, কিন্তু দিন শেষে নিজের কাছে নিজের কিছু কৈফিয়ত নেই। হেরেছি। পরাজিত হয়েছি। ক্ষতি মেনে নিয়েছি। কিন্তু আত্মদহন নেই। সব সময় নিজের সরল বিশ্বাসের কাছেই বিশ্বস্ত থেকেছি। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেইলে আগুন জ্বেলেছি বারে বারে। একলা রাতের অন্ধকারে আলো পেয়েছি ঠিক। পথ হারাইনি।
আমার পুতুলের শাড়ি চুরি করা খেলার সাথীটিকে চোর বলতে পারিনি। আমার পরীক্ষার খাতা দেখে ডিসিপ্লিন রচনা লেখা বন্ধুটি আমাকে না জানা প্রশ্নের উত্তর বলে না দিলে আমি তাকে প্রতারক বলতে পারিনি। আমার নোট নিয়ে পরীক্ষা পাস করা সহপাঠী স্বীকার না করলেও আমি তাকে অকৃতজ্ঞ বলতে পারিনি। প্রেমিকের চাতুর্য ধরতে পেরেও বুঝতে না পারার ভান করে আমি নির্বিকার থেকেছি। সংসারে নিজেকে বিলিয়ে দিতে দিতে ভেবেছি এই ভবিতব্য। প্রতিটি দিন সংগ্রামমুখর। যুদ্ধক্লান্ত। অথচ বাইরের দুনিয়া দেখে আমার বাহ্যিক অবয়ব, অজানা কারণে সেখানে এই যুদ্ধ ক্লান্তি কোনো ছায়া ফেল-এ না। এটাই বোধকরি আমার জিতে যাওয়া। সোকল্ড সাফল্য নামক পাসের খাতায় নাম না লিখেও নিজেকে ফেল না ভাবা, ব্যর্থতার গ্লানি বহন না করা। হ্যাঁ, কোথাও পাস করতে পারিনি। অথচ পারতাম। কী না হতে পারতাম! নিজের প্রকৃতিপ্রদত্ত যোগ্যতা, সামর্থ্য কিংবা পার্থিব সুযোগ একটু কায়দা করে ব্যবহার করা গেলেই জাতে ওঠা যেত, ওঠা যেত সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়। যাকে এই সমাজ-সংসার সাফল্য বলে। পাসের অন্য নাম।
অথচ বোকার মতো, সরলতার মতো আমি জীবনভর ‘ফেল’ করেই গেলাম। ফেইলে ফেইলে ভরা আমার জীবন। কোথাও কোথাও দিন শেষে ফেইলিউরের অপর নাম পাস। নিজের কাছে নিজের পাস। জীবনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো যে স্বভাব, সে স্বভাবে অবশেষে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় নিজেকে। সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে জীবন থেকে বিচ্যুত হওয়া। আমি জীবন থেকে বিচ্যুত হইনি। ফেল করে নিজের কাছে নিজে জিতে গেছি। প্রতিবার প্রতিটি ফেলকে ভেবেছি প্রথম ফেল।
‘আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার, জীর্ণ করে একে কোথায় নেবে?’ v