সন্তানদের নিয়ে মাইক হাতে বিচার চেয়ে কাঁদলেন তৌহিদের স্ত্রী
Published: 1st, February 2025 GMT
‘আমার স্বামীর তো কোন অপরাধ ছিল না। কোনো সন্ত্রাসীও নয়। সেনাবাহিনী আমাকে আশ্বস্ত করেছিল আমার স্বামীকে কিছুই করবে না। আমার বিশ্বাসও ছিল তাদের ওপর। যে সেনাবাহিনী জুলাই আগষ্টে জনতার পক্ষে ছিল তারাই তার পুরো শরীরে এমন নিষ্ঠুর নির্যাতন ও কারেন্টের শক দিয়ে হত্যা করলো। চার সন্তানকে কেন এতিম করা হলো। আমি এর বিচার চাই।’ কুমিল্লায় যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার পর হাসপাতালে মারা যাওয়া যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের (৪৫) মরদেহ নিয়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনে এসব কথা বলেন তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার। পাশে একটি অ্যাম্বুলেন্সে রাখা ছিল মরদেহ। এ সময় মাইক হাতে নিয়ে কেঁদে কেঁদে স্বামীর বিচার চান তিনি। মা যখন তাদের বাবার বিচার চেয়ে বক্তব্য রাখছিলেন তখন পাশে দাঁড়ানো চার সন্তানও কাঁদছিলেন। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। সচেতন এলাকাবাসীর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে স্বজন ও এলাকার সহস্রাধিক মানুষ সমবেত হয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন তিনি।
ঘটনার রাতে (বৃহস্পতিবার) তৌহিদুরের সঙ্গে প্রতিবেশী লুৎফুর রহমানকেও আটক করা হয়। মানববন্ধনে হাজির হয়ে তিনি বলেন, ঘটনার রাত থেকে পুলিশে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত তৌহিদুলকে নির্যাতন করা হয়। তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না। সকালে গোমতীতে নামিয়ে গোসল করানোর পর নামাজ পড়তে বলা হয়েছিল। আমি নামাজ পড়েছি, তৌহিদ দাঁড়াতে পারেনি।’
তৌহিদুলের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘সেনাবাহিনীর পোশাক ছাড়াও ওই রাতে কিছু লোক সিভিলে ছিল। তাদের মুখ ঢাকা ছিল। তারা বলেছিল আমার স্বামীকে ফেরত দেওয়া হবে। সে নাকি অস্ত্র ব্যবসা করে। ভোর থেকে আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অনেকের কাছে গিয়েছি, মোবাইলে কথা বলেছি। তাকে পাইনি। সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার পর আবারও সেনাবাহিনীর লোকজন তাকে (স্বামী) গাড়িতে রেখে আমাদের ঘরে তল্লাশি করেছে। তখন আমার স্বামী অনেকটা অচেতন ছিল। পরে হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর আমাদের খবর দেওয়া হয়।’
মানবন্ধনে তৌহিদুলের ভাগ্নি প্রফেসর মাহবুবা উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত দফায় দফায় আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সেনা আইনে বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। আমাদের একটি বিশ্বাস ও গর্বের স্থান সেনাবাহিনী। এভাবে একটি মানুষকে নির্যাতন করে মারা হলো। দেশে আইন ও বিচার বলে কি কিছুই নেই? আমরা যদি ন্যায়বিচার না পাই তাহলে বিধি অনুসারে আইনগত পদক্ষেপ নেব।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুমিল্লা মহানগর শাখার সদস্য সচিব রাশেদুল হাসান বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আমরা এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। সেনাবাহিনী জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনে জনতার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করেছে। এভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু আমাদের কষ্ট দেয়। আশা করি, ওই ব্যক্তির পরিবার এর বিচার পাবে।’
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যৌথবাহিনীর পরিচয়ে কিছু সেনা সদস্য ও সিভিলে থাকা ব্যক্তি তৌহিদকে বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তিনি জেলার আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবি ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের মৃত মোখলেছুর রহমানের ছেলে ও ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চার দিন আগে বাবা মারা যাওয়ার খবরে বাড়ি আসেন। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তাঁকে কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
তৌহিদের স্ত্রী ও স্বজনদের অভিযোগ- মরদেহ গোসল করানোর সময় তাঁর শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।
শনিবার দুপুরে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এ ঘটনায় থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের পর সন্ধ্যায় মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের পর দুপুরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
ওসি জানান, ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করার অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তৌহিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা ছিল। এছাড়া আর কোনো অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ছাত্রদল বাংলা ‘সিনেমার শাবানা’ নয়: ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলামকে (পারভেজ) হত্যার প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবিতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। আজ সোমবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এই মানববন্ধন হয়।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী নেতা-কর্মীরা কালো ব্যানার ও কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক প্রকাশ করেন। এ সময় তাঁদের হাতে ‘গুম–হত্যা আর খুন, মানি না মানব না’, ‘যে হাতে বই ছিল তা আজ রক্তে রাঙা, সংস্কারের নামে চলছে খুন আর দাঙ্গা’, ‘কাটতে হবে দোসর লেজ, আমরা আছি পারভেজ’সহ নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম। যেখানে আমরা সমন্বয়ের চেষ্টা করেছি। কিন্তু কারা এ ব্যানারকে কলুষিত করতে চায়? আজ থেকে আপনাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলবে না, আপনাদের ছাত্র আন্দোলন বৈষম্যমুখী হয়ে পড়েছে।’
ছাত্রদল বাংলা সিনেমার শাবানা নয় উল্লেখ করে সংগঠনটির এই নেতা বলেন, ‘আড়াই ঘণ্টা একটা চলচ্চিত্রে শাবানা খুব কষ্ট-দুঃখ করে। তবে যখন তার ভালো সময় আসে, তখন তিনি ক্ষমা করে দেন। আমাদের সামনের সারির নেতৃত্ব যদি আহত বা নিহত হয়, আমরা শাবানার মতো ক্ষমা করতে পারব না। আমাদেরও রক্ত গরম হয়, আমাদেরও শরীর গরম হয়।’
শিক্ষার্থীরা একটি ট্রমার (মানসিক আঘাত) মধ্যে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের দেয়াল থেকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আমরা চুপ করে ছিলাম। আমরা মনে করেছি, শিক্ষার্থীরা যেহেতু একটি ট্রমার মধ্যে আছে, আমরা যদি প্রতিক্রিয়া দেখাই, তাহলে ভুল–বোঝাবুঝি হবে। কিন্তু এখন আনাচকানাচে নামে-বেনামে মঞ্চ তৈরি হয়েছে।’
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন। ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীর নামে ‘মবোক্রেসি’ (বিশৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ কাজ) চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীর নামে মবোক্রেসি চালু করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করতে চাইছে। ৫ আগস্টের পর ছাত্রদলের রক্তে ক্যাম্পাস রঞ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর কেউ যদি ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চায়, তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, ছাত্রদল কোনো গুপ্ত সংগঠন নয়।’
সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিচয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধীর ব্যানারে ছাত্রলীগের পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন নাহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধীর ব্যানারে আর কোনো ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন করা হলে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে কঠোর হব।’
মানববন্ধনে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাসুম বিল্লাহ, সহসভাপতি আনিসুর রহমান খন্দকার, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন শাওন প্রমুখ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের বিক্ষোভ ও মানববন্ধন
জাহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল এবং সদস্যসচিব শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কর্মসূচি পালন করা হয়।
বিক্ষোভ মিছিলটি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে শুরু হয়ে শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে বিজ্ঞান অনুষদ চত্বর ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ভাষাশহীদ রফিক ভবনের সামনে এসে সমবেত হয়। বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘তুমি কে, আমি কে, পারভেজ পারভেজ’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে ভাষাশহীদ রফিক ভবনের নিচে মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম মামুন বলেন, ‘আমরা দ্রুত পারভেজ হত্যার বিচারের দাবি জানাচ্ছি এবং যারা হত্যাকারী, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ রকম হত্যাকাণ্ড আর না ঘটে, সে জন্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।'
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম হত্যার বিচার দাবিতে আজ সোমবার দুপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের বিক্ষোভ ও মানববন্ধন