জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরোলেও শৃঙ্খলা ফেরেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। নিয়মিত কাজের বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ে বদলি-পদায়ন এখনও চলছে। ৫ আগস্টের পর প্রতিদিন স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পদে আসছে নতুন মুখ। গত ছয় মাসে বদলি ও পদায়ন পেয়েছে ঝড়ের গতি। এ সময়ে ৩ হাজার মেডিকেল অফিসার ও ৫০০ কর্মচারীর চেয়ার রদবদল করা হয়েছে। এত স্বল্প সময়ে অতীতে এমন বদলি হয়নি অধিদপ্তরে। বদলি হওয়া অনেক চিকিৎসক জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মস্থলে যোগ দেননি। নতুন করে উপজেলা পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকদের ঢাকায় আনা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে উপজেলা পর্যায়ে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।

এই অস্বাভাবিক বদলিকে কেন্দ্র করে ড্যাব নেতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর একটি চক্র অর্থ লেনদেন করেছে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার করা এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির অনুসন্ধানে অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তা ও পাঁচ কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। 

নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের সেবা নিশ্চিত, কাজে গতি ফেরাতে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাস্থ্য খাত গড়ে তুলতে এই বদলি। এখন হাসপাতালে শৃঙ্খলা ফেরাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

তবে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে মেডিকেল অফিসারের মধ্যে বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মেডিকেল অফিসার ডা.

মেহেদী হাসান, ড্যাবের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শাখার সভাপতি ও মেডিকেল অফিসার ডা. ফারুক হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. মাহবুব আরেফিন রেজানুর রঞ্জু ও মেডিকেল অফিসার ডা. মনোয়ার সাদাতের নাম এসেছে। অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের মধ্যে তিনজনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি একজনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেবে অধিদপ্তর।
এ ছাড়া কর্মচারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পার-২-এর সেকশন অফিসার সোহেল রানা, হাফিজুর রহমান, রেজাউল ইসলাম, জিয়াউল হক ও আমিনুল হকের বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। এসব বদলিতে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই পাঁচজনের কেউই বদলি বাণিজ্যের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

এ বিষয়ে মেডিকেল অফিসার ডা. ফারুক হোসেন সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বদলির সঙ্গে আমি সংশ্লিষ্ট ছিলাম। বঞ্চিতদের সুযোগ দিতে বদলিগুলো করা হয়েছে। যে কারণে তালিকায় আমার নাম আসতে পারে। আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি মিথ্যা।

ডা. মাহবুব আরেফিন রেজানুর রঞ্জু বলেন, বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের বদলির জন্য সুপারিশ করেছি। আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি সত্য নয়, এটি অপপ্রচার।
অভিযোগের বিষয়ে ডা. মনোয়ার সাদাত বলেন, আমরা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সব বদলি করেছি। এখানে আর্থিক লেনদেনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। মেডিকেল অফিসার ডা. মেহেদি হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতাকর্মীর দখলে ছিল স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদ। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অধ্যক্ষ, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, সিভিল সার্জন, জেলা বা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকের পদে ছিলেন মূলত স্বাচিপের নেতা, সদস্য ও অনুসারীরা। এসব পদ থেকে তাদের সরানো হয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি চিকিৎসকদের দ্বন্দ্ব এখনও চলমান। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউটের গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে বিরোধ চলছে। 

কর্মস্থলে অনুপস্থিত আওয়ামী লীগপন্থিরা
আওয়ামী লীগপন্থি অধিকাংশ চিকিৎসক এখনও কর্মস্থলে যোগদান করেননি। কয়েকজন চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। আবার কাউকে ওএসডি করা হয়েছে। কারও কর্মস্থলে যোগ দিতে বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে বা হচ্ছে। যেমন, রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে একজন সহকারী অধ্যাপককে রংপুর মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। রংপুর মেডিকেলের কিছু চিকিৎসক প্রকাশ্য ঘোষণা দেন, ঢাকা থেকে বদলি হওয়া চিকিৎসককে কাজে যোগ দিতে দেবেন না। পরে তাঁকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। সেখানেও তাঁকে যোগদানে বাধা দেওয়া হচ্ছে। একই ঘটনা ঘটেছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন অধ্যাপকের ক্ষেত্রে। ওই অধ্যাপককে বদলি করা হয় যশোরে। যশোর থেকে একদল চিকিৎসক ঘোষণা দিয়ে এর বিরোধিতা করেন। আওয়ামী লীগপন্থি অনেক চিকিৎসক আবার ঢাকায় আনা হচ্ছে টাকার মাধ্যমে। এমনই এক চিকিৎসক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহীদ। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) কাজ করতেন। বিভিন্ন সময় বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের মারধর করেছেন তিনি। জুলাই বিপ্লবের পর তাঁকে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। পাঁচ মাস পর তাঁকে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়েছে। এখানেও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে মোহাম্মদ শাহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কর্মস্থলে যোগ দিতে বিশেষ বার্তা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বদলি করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়িত কর্মস্থলে যোগদানের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এমনকি বিনা ব্যর্থতায় ছাড়পত্র গ্রহণ ও যোগদান সম্পন্নের প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এ বি এম আবু হানিফ। পাশাপাশি পরিস্থিতি উত্তরণে ৯টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর পর কিছু চিকিৎসক কর্মস্থলে যোগ দিলেও এখনও একটি বড় অংশ কর্মস্থলে যোগ দেননি।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে সুচিকিৎসা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম সমকালকে বলেন, বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত যেসব ব্যক্তির নাম এসেছে, তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বদল ম ড ক ল কল জ চ ক ৎসক আর থ ক পর য য় আওয় ম ব এনপ র বদল সরক র উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রামে অনশনে বৈষম্যবিরোধীরা

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ জড়িত সবার ফাঁসির দাবিতে অনশন করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর জামালখানে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে এ অনশন শুরু করেন তারা। পরে প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। রাত সাড়ে ৮টা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অনশন চলছিল। এর আগে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করেন তারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য রাসেল আহমেদ বলেন, ‘বিপ্লবের ছয়মাস পূরণ হতে যাচ্ছে। আমরা এখনও এ সরকারের কাছে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। আমাদের ভাইদের রক্ত এখনও রাজপথে লেগে আছে। আমি এখানে বসলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেবে না আমরা এখান থেকে উঠব না। আমাদের লড়াই চলছে, চলবে। আমরা আমাদের আমরণ অনশন চালিয়ে যাব। আমরা বিচার চাই। বিচার ছাড়া কোনো কথা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ সরকার আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় বসেছে। ইউনূস সরকার কি করে। খুনি বাইরের দেশে বসে আছে। তাদের ধরে এনে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতে হবে। এটাই আমাদের শেষ কথা।’ 

রাসেল আহমেদ বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে যেভাবে ফ্যাসিবাদী কাঠামো গড়ে উঠেছিল, সেটাকে ভেঙে দিয়ে খুনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আমরা রাজপথে নেমে এসেছিলাম। এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে আমরা ন্যূনতম সংস্কার ও বিচার পাইনি। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আমাদের দুই হাজারের অধিক ভাই জীবন দিয়েছে। তারা রাজপথে সাহসিকতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।’

রাসেল আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এখনও আমাদের খুনি হাসিনা, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের বিচারের দাবিতে রাজপথে নামতে হয়। আমাদের এ মুক্ত বাতাসে এখনও লাশের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। বারবার আমাদের তাদের বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলতে হচ্ছে। এ অন্তর্বর্তী সরকারকে সেসব খুনিদের বিচার করার জন্যই ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। আজও ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুণ্ডাবাহিনী বীর চট্টলার বুকে মিছিল করেছে। খুনি হাসিনাসহ আমাদের ভাইদের যারা খুন করেছে, তাদের বিচার ও ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানে এখন থেকেই আমরণ অনশন পালন করব।’ 

আজ বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘এখনো তারা সড়কে আছেন। তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।’ 

অনশনকারীদের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- দ্রুত বিচার আইনে বিভাগীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও উস্কানিদাতাদের গ্রেপ্তার-বিচার করা, শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত এনে বিচার করা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা, সব হত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণ, অপরাধ ও নির্যাতনের বিচার করা, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, আওয়ামী লীগ নেতাদের অবৈধভাবে অর্জিত সব অর্থ ও সম্পদ রাষ্ট্রীয়ভাবে বাজেয়াপ্ত করা, বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জীবনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে ও নতুন সংবিধান প্রণয়ন করাসহ রাষ্ট্রের যাবতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারের রূপরেখা প্রদান করতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এক সপ্তাহেও তদন্তে নেই কোনো অগ্রগতি
  • এই চিঠি পোস্ট করা হয়নি
  • গাজা: যুদ্ধবিরতি এলো মানুষগুলো ফিরল না
  • শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রামে অনশনে বৈষম্যবিরোধীরা
  • পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেইনি: নাহিদ ইসলাম