মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ হলেও পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় এর দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি সাঁথিয়া-পুন্ডুরিয়া সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চাপায় জন্মদিনে সাবিদ হোসেন নামে আট বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে এক বছরে দুই উপজেলায় তিন চাকার অবৈধ বাহনের কারণে ৪০টি দুর্ঘটনায় অন্তত ২৫ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকে।
অভিযোগ উঠেছে, হাইওয়ে পুলিশ এসব যান চলাচল বন্ধে নিষ্ক্রিয় থাকায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়কে নছিমন, করিমন, অটোভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে এগুলো আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। বেড়া বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় বাসচালক ফরিদ হোসেন ও ট্রাকচালক রেজাউল হকের সঙ্গে। তাদের ভাষ্য, এসব যানবাহন শুধু নিজেরাই দুর্ঘটনায় পড়ছে না, বাস-ট্রাককেও দুর্ঘটনায় ফেলছে। নজরদারির অভাবে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
পুলিশ ও পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, তিন চাকার যানবাহন ধীরগতির হওয়ায় মহাসড়কে এর চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোর ব্রেক যেমন দুর্বল, তেমনি গঠনও মহাসড়কে চলার উপযোগী নয়। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে। এ ছাড়া চালকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় মহাসড়কে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে, অন্য যানবাহনকেও দুর্ঘটনায় ফেলে। এ কারণে মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচলে উচ্চ
আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
উপজেলার ছোন্দহ গ্রামের রুফাই মান্নান গত ২৭ ডিসেম্বর করিমনের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষে মাথা ও পায়ে আঘাত পেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এখন তিনি বিছানায় কাতরাচ্ছেন। অর্থের অভাবে তাঁর ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না। একই দিন দুর্ঘটনায় চার কৃষি শ্রমিক প্রাণ হারান। তিন চাকার যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল উল্লেখ করে জোড়গাছা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন উল্লাস বলেন, চালকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা নেই। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।
এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশের উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাঁথিয়ার মাধপুর হাইওয়ে থানার সদস্যরা দুই উপজেলায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার মহাসড়কে টহল দিয়ে এসব যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাদের তৎপরতা কমেছে। এতে তিন-চার মাস ধরে তিন চাকার যানবাহন মহাসড়কে চলাচল করছে। যদিও টহল অব্যাহত আছে জানিয়ে হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ব্যবস্থা নিলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসে।
সম্প্রতি হাইওয়ে পুলিশ ফের সক্রিয় হলেও আগের মতো শক্ত অবস্থানে নেই বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। ফলে এসব যানবাহন বেপরোয়া চলাচল করছে। অনুসন্ধানে ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর এসব যানবাহনের কারণে সাঁথিয়া ও বেড়ায় অন্তত ৪০টি দুর্ঘটনায় ২৫ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে আগস্ট থেকে চলতি জানুয়ারি মাসের মধ্যে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বেশি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে মহাসড়কে অন্তত পাঁচজন নিহত হন। আগস্ট থেকে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৫ জানুয়ারি বেড়ার আমিনপুর নতুনবাজার এলাকায় মোটরসাইকেল ও নছিমনের সংঘর্ষে শাহীনুর রহমান নামে মোটরসাইকেল আরোহী কলেজ শিক্ষক নিহত হন। ২৩ জানুয়ারি সাঁথিয়ার পাঁচ ধোপাদহে নছিমন ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত হন যাত্রী ব্যবসায়ী ইসলাম প্রামাণিক। ২৪ জানুয়ারি মহাসড়কে সাঁথিয়ার পাটগাড়িতে আব্দুর রহমান নামের আওয়ামী লীগের এক নেতা কাভার্ডভ্যান চাপায় নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে পাশ কাটাতে গিয়ে দ্রুতগতির কাভার্ডভ্যানটি দুর্ঘটনায় পড়ে।
১১ জুন সাঁথিয়ার রাঙামাটিয়ায় নছিমন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রইজউদ্দিন ও ১২ জুন মাধপুরে করিমন নিয়ন্ত্রণ হারালে হামিদুল ইসলাম নিহত হন। গত ৬ আগস্ট কাশিনাথপুর-কাজীরহাট সড়কে বেড়ার আমিনপুরে বাসের ধাক্কায় নিহত হন সিএনজিচালিত অটোরিকশার তিন যাত্রী। ৩০ আগস্ট সাঁথিয়ার পাটগাড়িতে ট্রাক ও সিএনজিচালিত আটোরিকশার সংঘর্ষে প্রাণ হারান বাবলু সাহা নামের এক ব্যবসায়ী। গত ১৬ নভেম্বর গাড়াদহে ডাম্প ট্রাকের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে সুজন ও বাহাদুর আলী নামে দু’জন নিহত হন।
২০ নভেম্বর বেড়ার সিন্দুরিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংঘর্ষে কলেজছাত্র পরশ ও ইজিবাইকচালক পুষ্প মারা যান। ২১ ডিসেম্বর সাঁথিয়ার তেলকুপিতে বাস ও অটোভ্যানের সংঘর্ষে রত্না বেগম ও কালু খাঁ নিহত হন। ২৭ ডিসেম্বর রাঙামাটিয়ায় ট্রাকের সঙ্গে করিমনের সংঘর্ষে প্রাণ হারান খোকন মিয়া, ধনী প্রামাণিক, রাসেল হোসেন ও আব্দুল জলিল নামে চার কৃষিশ্রমিক।
গত ২০ জানুয়ারি বেড়ার কাশিনাথপুরে তিন চাকার অটোর সঙ্গে সংঘর্ষে মোটরসাইকেল আরোহী জামিল নিহত হন। সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি সাঁথিয়া-পুন্ডুরিয়া সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিচের চাপা পড়ে সাবিদ হোসেন নামে এক শিশু প্রাণ হারিয়েছে। সরেজমিন সাঁথিয়ার কাশিনাথপুর ও বেড়া বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, দুই স্থানেই বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাত্রী তোলার অপেক্ষায় রয়েছে শতাধিক ব্যাটারিচালিত অটোভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। মাঝেমধ্যে করিমন এর সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। বিশৃঙ্খলভাবে এসব যান অবস্থান করায় যানজট লেগেই থাকছে।
অটোভ্যান ও অটোরিকশাচালকদের ভাষ্য, আগে তারা মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের ভয়ে দেখেশুনে যাতায়াত করতেন। পাঁচ-ছয় মাস ধরে নির্ভয়ে চলছেন। হাইওয়ে পুলিশের টহল এখন প্রায়ই দেখা যায় না। সাঁথিয়ার পাটগাড়ি থেকে মহাসড়ক হয়ে ইট নিয়ে আসা নছিমনচালক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘পুলিশ আগে আমাদের মহাসড়কে উঠতেই দিত না। গাড়ি আটকে রাখত। এখন নির্বিঘ্নে চলি, কিছু বলে না।’
মহাসড়কে টহল অব্যাহত থাকলেও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছেন না বলে স্বীকার করেছেন মাধপুর হাইওয়ে থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, কিছু জায়গায়, বিশেষ করে বেড়ার দিকে টহলের সময় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে অটোরিকশাচালকরা লাঠিসোটা নিয়ে ধেয়ে আসে। এর মধ্যেও এসব যানের চালক ও যাত্রীদের সচেতন করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র স ঘর ষ ব যবস থ এসব য ন অবস থ ন আগস ট হ ইওয় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
বাসচাপায় প্রাণ গেল স্বামী-স্ত্রীসহ একই পরিবারের ৩ জনের
সিরাজগঞ্জের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে বাসচাপায় স্বামী-স্ত্রীসহ একই পরিবারের তিন অটোরিকশা যাত্রী নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যার পর সদর উপজেলার মুলীবাড়ী চেকপোস্ট এলাকায় ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও তিনজন।
যমুনা সেতু পশ্চিমপাড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ারুল ইসলাম সমকালকে জানান, যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের মুলিবাড়ি চেকপোস্ট এলাকায় সন্ধ্যার পর ৬ জন যাত্রী নিয়ে একটি অটোরিকশা মহাসড়ক পার হচ্ছিল। এ সময় উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকাগামী নাবিল পরিবহনের একটি বাস অটোরিকশাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই অটোরিকশার যাত্রী দুজন ও হাসপাতালে নেওয়ার পর একজন মারা যান।
নিহতরা হলেন- সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পুর্ব-বাঐতারা গ্রামের গোলাম হোসেনের স্ত্রী মো. শফিকুল ইসলাম (৪৫), তার স্ত্রী সুমনা খাতুন (৩৮) এবং শফিকুল ইসলামের বোন লাকী খাতুন (২২)। শফিকুল ও তার স্ত্রীর মরদেহ সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। আর শফিকুলের বোন লাকীর মরদেহ স্বজনরা নিয়ে গেছেন।
ওসি আনোয়ারুল ইসলাম জানান, বাসটিকে ও চালককে শনাক্ত করার চেষ্টা করছে পুলিশ। শুক্রবার রাত পৌনে এগারোটা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তবে মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।