অভ্যুত্থানের কড়চা এবং উন্নতির খতিয়ান
Published: 31st, January 2025 GMT
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের ছবি দৈনিকে বের হয়েছে; ছবির প্রদর্শনী হয়েছে; কয়েকটি অ্যালবামও বের হয়েছে। তিনটি অ্যালবাম আমরা আগ্রহের সঙ্গে দেখলাম। একটির প্রকাশক প্রথম আলো পত্রিকা, আরেকটি প্রকাশ করেছে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তৃতীয়টির প্রকাশক হিসেবে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম আছে বটে, তবে প্রকাশ করেছেন আলোকচিত্রশিল্পী মনজুর হোসেন নিজেই। তিনটিতেই দেখা যাচ্ছে তরুণদের সাহস ও দৃঢ়তা; এবং সেই সাহসের প্রতীক হচ্ছে রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ, পুলিশকে নিবৃত্ত করতে যে তাদের সামনে দু’হাত বিস্তৃত করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে গেছে। প্রথম আলোর সংকলনটির নাম ‘মুক্ত করো ভয়’; চারণের সংকলনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘হামার ব্যাটাক মারলু কেন’, যা সাঈদের মায়ের হৃদয়মথিত প্রশ্ন। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার যে তার শাসন বজায় রেখেছিল, সেটা জয় দেখিয়ে নয়, ভয় দেখিয়ে বটে।
তবে সবকিছুরই তো শেষ আছে, এমনকি ভয় দেখানোরও। ভয় দেখানো যখন চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, ভয় তখন গেছে ভেঙে তরুণদের সাহসের সামনে। ‘মুক্ত করো ভয়’-এর শুরুতেই দেখি আবু সাঈদেরই বয়সী এক তরুণ একাকী দাঁড়িয়ে আছে সুসজ্জিত পুলিশ বাহিনীর সামনে। সে নির্ভয়, পুলিশ বাহিনীই বরং বিব্রত। অ্যালবামের ভেতরে আরেকটি ছবি, সেটি চট্টগ্রামের। পুলিশ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, তারপরে একটি মেয়ে একাকী দাঁড়িয়ে নির্ভীক ভঙ্গিতে সশস্ত্র পুলিশের উদ্দেশে বলছে, ‘আন্দোলন করা আমাদের অধিকার, এই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না।’ আরেকটি ছবি একটি বুলেটের; ছবিটির বর্ণনা এই রকম: ‘জানালা দিয়ে ছুটে আসা এই বুলেট ১১ বছরের শিশু সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে দেয়ালে লাগে। ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।’
‘চারণ’-এর সংকলনে মুখোমুখি দুটো মুখচ্ছবি ছাপা হয়েছে। একটি ১৯৭১-এর, ইয়াহিয়া খানের; অপরটি ২০২৪-এর শেখ হাসিনার। একজন একাত্তরের ঘাতক, অপরজন একাত্তরের বাঙালিদের প্রধান নেতার কন্যা। একজন পাঞ্জাবি পুরুষ, অপরজন বাঙালি নারী। পাশাপাশি রাখা হয়েছে ছবি দুটি; এবং দেখা মাত্রই যা চোখে পড়ে সেটা হলো, মুখচ্ছবি দুটির সাদৃশ্য। প্রথমজন যেন ফিরে এসেছেন দ্বিতীয়জন হয়ে।
উভয় সংকলনেই ছাত্রলীগের মহাবীরদের বীরত্বের জলজ্যান্ত ছবি ছাপা হয়েছে। লাঠি দিয়ে তারা প্রহার করছে তাদেরই বয়সী দুটি মেয়েকে, যারা মিছিলে ছিল। পুলিশ ছাত্রীদেরও লাঠিপেটা করছে, এমন দৃশ্য আগে দেখেছি কিন্তু ছাত্ররা সহপাঠী মেয়েদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, এমন ছবি আগে চোখে পড়েনি। দুটি সংকলনেই দেখতে পাচ্ছি একজন রিকশাচালককে, যিনি নিজের রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে স্যালুট করছেন শিক্ষার্থীদের মিছিলকে। এই অভিবাদন সকল মেহনতি মানুষেরই।
ওপরের ঘটনাগুলো উদাহরণ মাত্র। এসব মানুষ পরিসংখ্যানের অংশ হয়ে যাবে। কেউ কেউ হয়তো রয়ে যাবে হিসাবের বাইরেই, কিন্তু প্রত্যেক মানুষই তো জীবন্ত ছিল; তাদের বাঁচার অধিকার ছিল। যে বাস্তবতা এখানে উন্মোচিত হলো, সেটা অত্যন্ত সুবিস্তৃত ও সুগভীর। সমাজ শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভক্ত; এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষের ওপর দিয়েই ঝড়টা সবচেয়ে বেশি জোরে বয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন, রাজনৈতিক আন্দোলনেও তেমনি তাদের ক্ষতিটাই ঘটে সর্বাধিক পরিমাণে। সেই ক্ষতির পূরণ ঘটে না। উল্টো দেখা যায় সুবিধাভোগীদেরই সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এবারের অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীকে হুকুম ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল নির্বিচারে মানুষ হত্যার। দেখামাত্র গুলি করা যাবে, এমন আওয়াজও শোনা গিয়েছিল এবং সেটা যে ফাঁকা আওয়াজ ছিল, তাও নয়। শিশুহত্যা, হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, ঘরের ভেতরে গুলি চালানো– এসব ঘটনা আগে কখনও দেখা যায়নি; এবার দেখা গেল। এই নিষ্ঠুরতার প্রতিক্রিয়া হয়েছে; পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও আহত ও নিহত হয়েছেন। তাদের ৪৪ জন নিহত হয়েছেন বলে সংবাদ বের হয়েছে। এই ঘটনাও অভূতপূর্ব। বোঝা যাচ্ছে, আমরা চরম অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
অভ্যুত্থানের সময় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে পুলিশের থানা ও ফাঁড়ি। অগ্নিসংযোগ ঘটেছে। লুট হয়েছে অস্ত্র। প্রাণভয়ে পুলিশকে পালাতে হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পুলিশ বাহিনীর ক্ষতিই হয়েছে সর্বাধিক। পুলিশের নতুন প্রধান তাঁর বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের অত্যুৎসাহের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং তাদের হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। র্যাবের নতুন প্রধান তো গোটা বাহিনীর পক্ষেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং ক্ষমাপ্রার্থী। একদা র্যাব গঠন করেছিল যে বিএনপি, তারাই এখন ওই বাহিনীর বিলুপ্তি চাইছে। কিন্তু এসব পরিবর্তন জনদুর্ভোগ মোটেই কমাবে না, যদি না রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক চরিত্রে পরিবর্তন ঘটে। পোশাক বদল হতে পারে, এমনকি নামেও পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু জনপীড়নের জন্য সাজসরঞ্জাম এবং উৎসাহের কোনো ঘাটতি যে দেখা দেবে না, সেটা নিশ্চিত।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বড় ঘটনা আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া। অনেকেই আশা করেছিলেন, কমলা হ্যারিসই জিতবেন। সেটা হলো না; ট্রাম্পই জিতলেন। আসলে এটা ট্রাম্পের জয় যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি কমলা হ্যারিসের পরাজয়। উন্মোচিত হলো এই সত্য– আধুনিক আমেরিকার অভ্যন্তরেও রক্ষণশীলতা কার্যকর শুধু নয়; বৃদ্ধিপ্রাপ্তও হয়েছে।
কমলা বলছিলেন, তিনি লড়ছেন গণতন্ত্রের জন্য; আর ট্রাম্প বলছিলেন, তাঁর সংগ্রাম উন্নতির লক্ষ্যে। গণতন্ত্রকে উন্নতির পথে অন্তরায় হিসেবে দাঁড় করানো রক্ষণশীলদের পরীক্ষিত কৌশল। গণতন্ত্র পরে দেখা যাবে, আপাতত উন্নয়ন তো হোক– এই মনোভাব অস্বাভাবিক নয় এবং এটাকে পুষ্ট করাও সহজ। কারণ উন্নতি কে না চায়! ধনীও চায়, গরিবও চায়। ধনী চায় আরও ধনী হবে। গরিব চায় সেও গরিব থাকবে না; ধনী হবে। তাই দেখা গেছে, আমেরিকার সেরা ধনীরা তো বটেই, বেকার-অর্ধবেকার-অর্ধশিক্ষিতদের একটা বড় অংশও ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছে। ওদিকে ট্রাম্প অন্য যে আওয়াজগুলো দিয়েছেন, সেগুলো রক্ষণশীলদের তো বটেই, গরিব মানুষকেও উদ্বেলিত করেছে। তিনি বলেছেন, আমেরিকাকে আবার ‘বড়’ করা হবে এবং তিনি না জিতলে আমেরিকা টিকবে না। জিতলে তিনি অবৈধ অভিবাসীদের কী করে তাড়াতে হয়, সেটা দেখিয়ে দেবেন। এই ধরনের বর্ণবাদী ও জাতীয়তাবাদী রণধ্বনি অনেকের কানেই মধুর শোনায়; শুনিয়েছেও বৈ কি। নইলে ট্রাম্পের মতো নিকৃষ্ট নৈতিক মানের, বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত এবং কোনো কোনো অভিযোগ সঠিক বলে প্রমাণিত, ব্যক্তি কী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদটিতে চার বছর ধরে রাজত্ব করবার জন্য নির্বাচিত হন? গত শতাব্দীর শেষ দিকেও তাঁর মতো দুষ্ট চরিত্রের কোনো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া তো দূরের কথা, দলীয় মনোনয়নপ্রার্থী হতেও সাহসী হতেন না। তাঁর মাপের একজন মানুষ আজ যে নির্বাচনে জিতে এলেন, তা যে কেবল রক্ষণশীলতার জয়, তা-ই নয়; এটি হলো ফ্যাসিবাদের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও এক ধাপ অগ্রগমন। সমাজতন্ত্রী বার্নি স্যান্ডার্স আগের দুই নির্বাচনে তবুও দলীয় হিসেবে মনোনয়নের জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন, এবার তিনি এমনকি সেটাও হননি। উন্নতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
অস্কার মঞ্চে অভিবাসীদের অবদান তুলে ধরলেন অশ্রুসিক্ত জো
জমকালো আয়োজনের মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯৭তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস। এবারের আসরে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগের পুরস্কার জিতেছেন আমেরিকান তারকা জো সালদানা। ‘এমিলিয়া পেরেজ’ চলচ্চিত্রে একজন আইনজীবীর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের সুবাদে এই স্বীকৃতি উঠেছে তাঁর হাতে।
স্প্যানিশ-ভাষার সংগীতনির্ভর ছবিটি পরিচালনা করেছেন ফ্রান্সের জ্যাক অঁদিয়ার। অস্কারের মতো এমন অর্জন হাতে নেওয়ার পর অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন এই অভিনেত্রী।
মঞ্চে উঠে আবেগাপ্লুত জোয়ি তাঁর মাকে স্মরণ করেন এবং ‘এমিলিয়া পেরেজ’-এর সব শিল্পী ও কলাকুশলীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর তিনি শিল্প জগতে অভিবাসীদের অবদান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘আমার দাদি ১৯৬১ সালে এই দেশে এসেছিলেন। আমি গর্বিত একজন অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান, যারা স্বপ্ন, সম্মানবোধ ও কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা নিয়ে বড় হয়েছেন। আমি ডোমিনিকান বংশোদ্ভূত প্রথম আমেরিকান, যে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করছে। আমি জানি, আমি শেষ ব্যক্তি নই। আমি আশা করি, এই পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই চরিত্রে আমি গান গাওয়ার ও স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। যদি আমার দাদি আজ বেঁচে থাকতেন, তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হতেন।’
তার এই বক্তব্য এমন এক সময়ে দিলেন যখন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন অভিবাসন নীতিতে কঠোর আগ্রাসন চালাচ্ছে।
চলচ্চিত্র দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ একাডেমি পুরস্কার তথা অস্কারের আয়োজন চলছে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে হলিউডের ডলবি থিয়েটারে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সময় সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটায়। আয়োজনের প্রথম পুরস্কারটি পেয়েছেন আমেরিকান অভিনেতা কিয়েরান কালকিন। ‘আ রিয়েল পেইন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্ব অভিনেতার স্বীকৃতি পেলেন তিনি।
অন্যদিকে, এবার সেরা অ্যানিমেশন ছবি (স্বল্পদৈর্ঘ্য) হিসেবে ‘ইন দ্য শ্যাডো অব সাইপ্রেস’, ফিচার অ্যানিমেশন হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে ‘ফ্লো’। সেরা মেকআপ এবং হেয়ারস্টাইল বিভাগে পুরস্কার জিতেছে গেল বছরের অন্যতম আলোচিত ছবি ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’।
সেরা অ্যাডাপ্ট চিত্রনাট্যর পুরস্কার পেয়েছে আলোচিত ছবি ‘কনক্লেভ’। এছাড়া পল ট্যাজওয়েল ‘উইকেড’ চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পোশাক পরিকল্পনাকারী এবং শন বেকার ‘আনোরা’ চলচ্চিত্রের জন্য সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছেন।