সংস্কারই খুলতে পারে কাঙ্ক্ষিত ইনসাফের দুয়ার
Published: 31st, January 2025 GMT
আগস্টের ৫ তারিখ শেখ হাসিনার পতনের পর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ হলো সংস্কার। শুরুতে অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রায় সব দল সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার ছিল। কিন্তু ইদানীং নির্বাচন যেন সংস্কারের দাবিকে ছাপিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ফলে সংস্কার, না নির্বাচন; কোনটা আগে হওয়া দরকার– এ নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে।
সংস্কার মানে বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো বদলাতে বহুমুখী পদক্ষেপ হাতে নেওয়া, যা নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে। গত পাঁচ দশক যাবৎ যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহাল রয়েছে, তা উপড়ে ফেলতে রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজির করা। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটা স্বাভাবিক।
এই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে, নৈতিকতাভিত্তিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা পলিটিক্যাল মোরালিজম। সমাজে ন্যায্যতা, সমতা, স্বাধীনতা, প্রশান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয়ভাবে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাই এ রাজনীতির লক্ষ্য। কেউ কেউ এ ধারার রাজনীতিকে ‘কাল্পনিক’ বলেও চিহ্নিত করেন। ১৫১৬ সালে টমাস মুরের ‘ইউটোপিয়া’ বই প্রকাশ পায়; যেখানে একটি আদর্শিক জাতি গঠনের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের মধ্যেও সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের প্রস্তাব দেখা যায়। এ ধারার চিন্তাকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন, যা সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু তুলনামূলক কল্যাণকর ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এ ধারার চিন্তা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সমাজে ইনসাফ কিংবা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ন্যায্যতা ও অধিকারের মতো অভীষ্ট সামনে রেখেই আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কারপন্থিদের এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন বেশ দুরূহ হলেও নিঃসন্দেহে অসম্ভব নয়। কনফুসিয়াস সে ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা ও বাস্তবতাভিত্তিক রাষ্ট্রনীতির প্রস্তাব করেছেন, যা সংস্কারপন্থিরা কাজে লাগাতে পারেন।
অন্যদিকে বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনপন্থিরা আরেকটি শক্তিশালী ধারা। তাদের উদ্দেশ্য দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তগত করা। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম কিংবা তাদের ভাষায় প্রয়োজনমতো সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। এই আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে আছে বিদ্যমান সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঠেকিয়ে দেওয়া, যাতে পুরোনো শ্রেণিস্বার্থ বহাল থাকে। বিগত আওয়ামী শাসনের সুবিধাভোগীদের জায়গায় নতুন সুবিধাবাদীদের বসানো। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে ’৪৭-এর দেশভাগ সম্পর্কে বলেছেন, ক্ষমতার হাত বদলানো কিংবা শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে বাদামিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
নির্বাচনপন্থিদের কাছে রাজনীতিতে নৈতিক ভিত্তি কিংবা সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল্য তুলনামূলক কম। তারা ক্ষমতাকে রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য মনে করেন। যে কোনো ছলচাতুরী, ধূর্ততা, সহিংসতা কিংবা অন্যায়ভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। নাগরিক অধিকার সমুন্নত হলো কিনা, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলো কিনা, সেটি তাদের ভাবার সময় নেই। তাদের চিন্তাধারা ম্যাকিয়াভেলি ও হবসপন্থি। সততা, নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তার বদলে ছলচাতুরী, ফাঁকি, ধূর্ততা কিংবা চালাকিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করেন। তাদের কাছে সমাজে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক প্রতারণাপূর্ণ। প্রকৃতির নিয়মের এই রাজ্যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিপক্ষ। এই ‘ব্রুটিশ’ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান জনসাধারণের ওপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ রাজনৈতিক ধারায় পরিবার ও গোষ্ঠী রাজনীতির নিয়ন্ত্রক, যাদের হাতে অর্থনীতি কুক্ষিগত থাকে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মর্জিমতো কাজ করে।
সংস্কারপন্থি ও নির্বাচনপন্থিদের মধ্যে চলমান বিতর্কে সাধারণত রাজনৈতিক দল বর্গ দিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। কিন্তু বিশ্লেষণের এ পন্থায় দেশের মূল চিত্র ধরা পড়ে না। তত্ত্বীয় দিক থেকে কার্ল মার্ক্স ‘শ্রেণি’ ধারণা দিয়ে সামাজিক চিত্রটি কার্যকরভাবে তুলে ধরার পথ জনপ্রিয় করে গেছেন। সেদিক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করা যতটা যুক্তিযুক্ত, তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হলো শ্রেণি ধারণা দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করে দেখা।
এখন বিতর্কের গোড়ায় যাওয়া যাক। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান অভ্যুত্থানের পাঁচ দিন পর ১০ আগস্ট সমকালে এক সাক্ষাৎকারে গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা ষোলোআনা বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই ষোলোআনার নেপথ্যেও প্রধান কারণ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা রাজনীতির প্রধান অংশীদার। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক উল্লিখিত বইয়ে উনিশ শতকের পরিপ্রেক্ষিতে যাদের ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন; স্বাধীনতার পর মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনীতি গড়ে উঠেছে ব্যাপক লুটপাটের মধ্য দিয়ে। বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, ‘এই যে শ্রেণি বাংলাদেশে তৈরি হলো, এরা এলো লুটপাট ও নানা রকম দুর্নীতির মাধ্যমে। এই মধ্যশ্রেণির মধ্য থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্ম হলো।’
বুদ্ধিজীবীদের কথা আসাতেই সমকালীন নাগরিক সমাজের প্রশ্নটি উঠে আসে, যারা লুটেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম শরিক। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতেই রাজনীতি পরিপুষ্ট হয়েছে। সমাজের চারদিকে বিভিন্ন শ্রেণিস্বার্থ গেড়ে বসেছে, অর্থনীতির সর্বস্তরে রয়েছে ছোট-বড় সিন্ডিকেট। নদী থেকে বালু উত্তোলন, ঔষধশিল্প, যানবাহন, কাঁচাবাজার, মিডিয়া, বিজ্ঞাপন– এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে সিন্ডিকেটের বিস্তার ঘটেনি।
এ সবকিছুই গত পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপহার! গেড়ে বসা এসব কাঠামোর মূলোৎপাটন হলে পুরোনো শ্রেণিস্বার্থ আর বহাল থাকে না। সেখানেই সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে নির্বাচনপন্থিদের ফ্যাসাদ। এ সংঘাত কেবল তর্কে সীমাবদ্ধ নেই, অনেক ক্ষেত্রে খুনোখুনি পর্যন্ত হচ্ছে। নির্বাচনপন্থিরা যে কোনো মূল্যে পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রাখতে চাইবেন। এতেই তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে। সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলোর সাউথ এশিয়া স্টাডির অধ্যাপক আরাইল্ড এঙ্গেলসন বাংলাদেশে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেছেন।
সংস্কারপন্থি ও নির্বাচনপন্থিদের বিতর্ক যে দিকেই যাক না কেন; বাংলাদেশে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হলে সংস্কারের বিকল্প নেই। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেবল ক্ষমতার হাতবদল ঘটবে, ক্ষমতা কাঠামো নয়। এ দেশে বহুবার ক্ষমতার হাতবদল ঘটেছে, কিন্তু সামাজিকভাবে আমূল পরিবর্তন কখনও সম্ভব হয়নি। তাই সংস্কারের দুরূহ পথই হতে পারে সুবিচার তথা ইনসাফ কায়েমে সম্ভাবনার দুয়ার।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
iftekarulbd@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক ব র র জন ত র জন ত র ব যবস থ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারই খুলতে পারে কাঙ্ক্ষিত ইনসাফের দুয়ার
আগস্টের ৫ তারিখ শেখ হাসিনার পতনের পর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ হলো সংস্কার। শুরুতে অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রায় সব দল সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার ছিল। কিন্তু ইদানীং নির্বাচন যেন সংস্কারের দাবিকে ছাপিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ফলে সংস্কার, না নির্বাচন; কোনটা আগে হওয়া দরকার– এ নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে।
সংস্কার মানে বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো বদলাতে বহুমুখী পদক্ষেপ হাতে নেওয়া, যা নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে। গত পাঁচ দশক যাবৎ যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহাল রয়েছে, তা উপড়ে ফেলতে রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজির করা। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটা স্বাভাবিক।
এই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে, নৈতিকতাভিত্তিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা পলিটিক্যাল মোরালিজম। সমাজে ন্যায্যতা, সমতা, স্বাধীনতা, প্রশান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয়ভাবে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাই এ রাজনীতির লক্ষ্য। কেউ কেউ এ ধারার রাজনীতিকে ‘কাল্পনিক’ বলেও চিহ্নিত করেন। ১৫১৬ সালে টমাস মুরের ‘ইউটোপিয়া’ বই প্রকাশ পায়; যেখানে একটি আদর্শিক জাতি গঠনের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের মধ্যেও সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের প্রস্তাব দেখা যায়। এ ধারার চিন্তাকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন, যা সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু তুলনামূলক কল্যাণকর ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এ ধারার চিন্তা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সমাজে ইনসাফ কিংবা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ন্যায্যতা ও অধিকারের মতো অভীষ্ট সামনে রেখেই আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কারপন্থিদের এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন বেশ দুরূহ হলেও নিঃসন্দেহে অসম্ভব নয়। কনফুসিয়াস সে ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা ও বাস্তবতাভিত্তিক রাষ্ট্রনীতির প্রস্তাব করেছেন, যা সংস্কারপন্থিরা কাজে লাগাতে পারেন।
অন্যদিকে বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনপন্থিরা আরেকটি শক্তিশালী ধারা। তাদের উদ্দেশ্য দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তগত করা। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম কিংবা তাদের ভাষায় প্রয়োজনমতো সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। এই আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে আছে বিদ্যমান সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঠেকিয়ে দেওয়া, যাতে পুরোনো শ্রেণিস্বার্থ বহাল থাকে। বিগত আওয়ামী শাসনের সুবিধাভোগীদের জায়গায় নতুন সুবিধাবাদীদের বসানো। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে ’৪৭-এর দেশভাগ সম্পর্কে বলেছেন, ক্ষমতার হাত বদলানো কিংবা শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে বাদামিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
নির্বাচনপন্থিদের কাছে রাজনীতিতে নৈতিক ভিত্তি কিংবা সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল্য তুলনামূলক কম। তারা ক্ষমতাকে রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য মনে করেন। যে কোনো ছলচাতুরী, ধূর্ততা, সহিংসতা কিংবা অন্যায়ভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। নাগরিক অধিকার সমুন্নত হলো কিনা, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলো কিনা, সেটি তাদের ভাবার সময় নেই। তাদের চিন্তাধারা ম্যাকিয়াভেলি ও হবসপন্থি। সততা, নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তার বদলে ছলচাতুরী, ফাঁকি, ধূর্ততা কিংবা চালাকিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করেন। তাদের কাছে সমাজে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক প্রতারণাপূর্ণ। প্রকৃতির নিয়মের এই রাজ্যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিপক্ষ। এই ‘ব্রুটিশ’ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান জনসাধারণের ওপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ রাজনৈতিক ধারায় পরিবার ও গোষ্ঠী রাজনীতির নিয়ন্ত্রক, যাদের হাতে অর্থনীতি কুক্ষিগত থাকে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মর্জিমতো কাজ করে।
সংস্কারপন্থি ও নির্বাচনপন্থিদের মধ্যে চলমান বিতর্কে সাধারণত রাজনৈতিক দল বর্গ দিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। কিন্তু বিশ্লেষণের এ পন্থায় দেশের মূল চিত্র ধরা পড়ে না। তত্ত্বীয় দিক থেকে কার্ল মার্ক্স ‘শ্রেণি’ ধারণা দিয়ে সামাজিক চিত্রটি কার্যকরভাবে তুলে ধরার পথ জনপ্রিয় করে গেছেন। সেদিক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করা যতটা যুক্তিযুক্ত, তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হলো শ্রেণি ধারণা দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করে দেখা।
এখন বিতর্কের গোড়ায় যাওয়া যাক। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান অভ্যুত্থানের পাঁচ দিন পর ১০ আগস্ট সমকালে এক সাক্ষাৎকারে গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা ষোলোআনা বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই ষোলোআনার নেপথ্যেও প্রধান কারণ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা রাজনীতির প্রধান অংশীদার। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক উল্লিখিত বইয়ে উনিশ শতকের পরিপ্রেক্ষিতে যাদের ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন; স্বাধীনতার পর মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনীতি গড়ে উঠেছে ব্যাপক লুটপাটের মধ্য দিয়ে। বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, ‘এই যে শ্রেণি বাংলাদেশে তৈরি হলো, এরা এলো লুটপাট ও নানা রকম দুর্নীতির মাধ্যমে। এই মধ্যশ্রেণির মধ্য থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্ম হলো।’
বুদ্ধিজীবীদের কথা আসাতেই সমকালীন নাগরিক সমাজের প্রশ্নটি উঠে আসে, যারা লুটেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম শরিক। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতেই রাজনীতি পরিপুষ্ট হয়েছে। সমাজের চারদিকে বিভিন্ন শ্রেণিস্বার্থ গেড়ে বসেছে, অর্থনীতির সর্বস্তরে রয়েছে ছোট-বড় সিন্ডিকেট। নদী থেকে বালু উত্তোলন, ঔষধশিল্প, যানবাহন, কাঁচাবাজার, মিডিয়া, বিজ্ঞাপন– এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে সিন্ডিকেটের বিস্তার ঘটেনি।
এ সবকিছুই গত পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপহার! গেড়ে বসা এসব কাঠামোর মূলোৎপাটন হলে পুরোনো শ্রেণিস্বার্থ আর বহাল থাকে না। সেখানেই সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে নির্বাচনপন্থিদের ফ্যাসাদ। এ সংঘাত কেবল তর্কে সীমাবদ্ধ নেই, অনেক ক্ষেত্রে খুনোখুনি পর্যন্ত হচ্ছে। নির্বাচনপন্থিরা যে কোনো মূল্যে পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রাখতে চাইবেন। এতেই তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে। সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলোর সাউথ এশিয়া স্টাডির অধ্যাপক আরাইল্ড এঙ্গেলসন বাংলাদেশে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেছেন।
সংস্কারপন্থি ও নির্বাচনপন্থিদের বিতর্ক যে দিকেই যাক না কেন; বাংলাদেশে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হলে সংস্কারের বিকল্প নেই। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেবল ক্ষমতার হাতবদল ঘটবে, ক্ষমতা কাঠামো নয়। এ দেশে বহুবার ক্ষমতার হাতবদল ঘটেছে, কিন্তু সামাজিকভাবে আমূল পরিবর্তন কখনও সম্ভব হয়নি। তাই সংস্কারের দুরূহ পথই হতে পারে সুবিচার তথা ইনসাফ কায়েমে সম্ভাবনার দুয়ার।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
iftekarulbd@gmail.com