কয়েক দিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে চীন। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিশানায়েকে চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে ১৫টি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। তাঁর সঙ্গে আছে ভারত-চীন পররাষ্ট্র সচিব-পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা, পাকিস্তানে সিন্ধু পুলিশের বিরুদ্ধে ছয় চীনা নাগরিকের হয়রানি মামলা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে চীনা সহায়তার উদ্যোগ ইত্যাদি। তাই সংবাদমাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা এবং ভারতের কৌশলগত লাভ-ক্ষতির বিষয় আলোচিত। 
চীন সফরকালে দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় একটি তেল শোধনাগারের জন্য সিনোপেক (একটি পেট্রোলিয়াম পরিশোধন করপোরেশন) থেকে ৩.

৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ চুক্তি করেন। চায়না এক্সিম ব্যাংক ও চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত চুক্তিটি সম্ভবত আইএমএফের ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করবে। যৌথ বিবৃতিতে ‘উচ্চ মানের’ বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতায় অংশীদারিত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কা জিজাং ও জিনজিয়াং সম্পর্কে চীনের অবস্থানকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
চীন থেকে ফিরে ২০ জানুয়ারি কাতুকুরুন্ডায় এক জনসভায় দিশানায়েকে বলেছেন, ‘আমাদের অন্যান্য দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত।’ তিনি উত্তর-পূর্ব উপকূলের বন্দরনগরী ত্রিনকোমালিতে ভারত ও শ্রীলঙ্কার যৌথ পরিচালনায় ৬১টি তেল ট্যাঙ্কের সঙ্গে একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ বিষয়ে ভারতীয় কোম্পানি ও সিলন পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মধ্যে আলোচনার ফলাফলও তুলে ধরেন। 

মজার বিষয় হলো, ভারত-শ্রীলঙ্কা সরকারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে আদানি গ্রিন এনার্জি শ্রীলঙ্কা লিমিটেডকে অনুমোদন দেওয়া মান্নার ও পুনেরিনে বায়ুশক্তি প্রকল্পটি এখন শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভোক্তাদের জ্বালানি প্রদানের মূল্য চুক্তি প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্পষ্টতই উচ্চ শুল্কের প্রকল্পটি শ্রীলঙ্কা সরকার নিযুক্ত একটি কমিটি যাচাই-বাছাই করে দেখছে। ভারতের উপকূলের কাছাকাছি এ প্রকল্প আগে চীনকে দেওয়া হয়েছিল। নয়াদিল্লি সব যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পে শ্রীলঙ্কার বিলম্বের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাতিল করা হয়েছিল। এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, কলম্বো বন্দরের পূর্ব কনটেইনার টার্মিনাল। 

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় এবং তাঁর পতন ঘটে। এর পর চীন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরপরই চীন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তার ‘সব ধরনের কৌশলগত অংশীদারিত্বের’ ওপর জোর দিয়েছিল। 
চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারও। চীনা অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে চীনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ‘অকৃত্রিম বন্ধুত্ব’ তুলে ধরে; অন্যদিকে ভারতীয় প্রকল্পগুলো অন্যায্য ও অসম বলে চিত্রিত। দেশটির ভারতবিরোধী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মিথস্ক্রিয়া এখন ন্যূনতম পর্যায়ে আছে। দেশটির সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে– দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তন চীনের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে না। 

চীনারা তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা হুমকির কারণে পাকিস্তানে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। কারণ তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি চারজন চীনা নাগরিক সিন্ধু উচ্চ আদালতে রাজনৈতিক হয়রানির বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন। তারা দাবি করেছেন, ‘নিরাপত্তার’ অজুহাতে ন্যায্যতা ছাড়া তাদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালে একজন স্থানীয় বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের পটুয়াখালীতে চীনা ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। একইভাবে ২০২১ সালে শ্রমিকদের বেতন না দেওয়া নিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে স্থানীয়দের সঙ্গে চীনা শ্রমিকদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। এতে পুলিশ গুলি চালালে পাঁচজন বাংলাদেশি শ্রমিক নিহত হন। 

চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে। ভারত এ অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্পে সমানভাবে যুক্ত। চীনের বিপরীতে ভারতীয় প্রকল্পগুলো দেশীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এবং তা ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ও চীনের সঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রূপও পরিবর্তিত হয়।

শ্রুতি এস পট্টনায়েক: ভারতের নয়াদিল্লির মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের গবেষণা
ফেলো; দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক প রকল প

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনে জেলেনস্কির বিকল্প নেতা খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র!

ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ খবর- সিএনএন

গণমাধ্যমের সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার পর এ কথা বললেন তিনি। বাগবিতণ্ডার এ ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল হয়ে যায়। আর এর পরই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কোন পথে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শুক্রবারের ওই ঘটনায় সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গড়া ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া-দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ