নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীই প্রাণ। অট্টালিকাসমৃদ্ধ বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসে আমরা যত বিশাল ও সমৃদ্ধ সভ্যতা দেখি না কেন, তাদের সভ্যতার বিস্তার ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। একসময় সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে পৌরাণিক কাহিনি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, ভৌগোলিক গড়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, এমনকি জীবিকার অনুষঙ্গ গড়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের উর্বরতা সমৃদ্ধ মাটি তৈরিতে প্রধান কারিগর নদী। বাংলাদেশে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এ ছাড়া শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে ৭০০-এর মতো নদনদী, অসংখ্য খাল-বিল বাংলাদেশের বুক চিরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ দেশে কৃষিকাজে যুগ যুগ ধরে নদীর সেবা পেয়ে আসছে জনগণ। ক্ষেতে সেচ দেওয়া থেকে শুরু করে শিল্পকারখানায় অন্যতম প্রধান সহায়ক হিসেবে পানি অপরিহার্য। যে পানির জোগান দিয়ে থাকে নদী। ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার ধরে রাখতে নদী অদ্বিতীয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও মাটির স্বাস্থ্য ধরে রাখতে পানি খুবই কার্যকর। এ ছাড়া সামুদ্রিক অনেক মাছ প্রজননের সময় নদীতে এসে ডিম পাড়ে।
আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো আজ মুমূর্ষু অবস্থায়। দখল-দূষণে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এক সময়ের খরস্রোতা ও উপকারী নদীগুলো। ইদানীং দেখা যাচ্ছে অসাধু ও ভূমিদস্যুদের নদী দখলের অবাধ প্রতিযোগিতা ও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনে নদীগুলো নাব্য হারিয়ে আজ মৃতপ্রায়। আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর ওপর বাঁধ দেওয়ার ফলে পানির প্রবাহে তারতম্য সৃষ্টি হওয়ায় নদীগুলো হারাচ্ছে স্বাভাবিক প্রবাহ এবং শুকনো মৌসুমে পানি কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এ ছাড়া ট্যানারি, কলকারখানার দূষিত ও বিষাক্ত বর্জ্য অবাধে নদীতে ফেলা, গৃহস্থালি বর্জ্য, কৃষিক্ষেতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বিষ যা বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদীতে মিশে নদীদূষণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে সহায়তা করছে। হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য ও জাহাজের তেল এবং শহরের অপচনশীল কঠিন আবর্জনা নদীদূষণে সমানভাবে দায়ী।
অপরিকল্পিত উপায়ে নদীপাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনা নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নদীদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ভয়াবহ। নদীদূষণের ফলে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নদীদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবসহ মানব স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি করে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপর্যস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জন্য প্রাণঘাতী ক্যান্সার রোগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ ছাড়া অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্ম, ফুসফুসের রোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগের সৃষ্টি করে। বিরতিহীনভাবে নদী দখল ও দূষণের ফলে নদী হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের সোনালি শৈশব। সাঁতার কাটার জায়গা না পেয়ে সাঁতার শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেক শিশু, যা অনেক ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দূষণের করাল গ্রাস থেকে নদীগুলোর জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনতে নদীর ওপর চালানো অত্যাচারের স্টিমরোলার বন্ধ করা; যত্রতত্র বাঁধ, কালভার্ট ও ব্রিজ তৈরিতে যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন; নদীদূষণ রোধে নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলা বা নৌযান নির্গত বর্জ্য নিক্ষেপে যথা সম্ভব বিরত থাকলে সুফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়া নৌযান চলাচলের জন্য বিকল্প জ্বালানির কথা চিন্তা করা, শিল্প ও কলকারখানায় বর্জ্য নদীতে না ফেলে তা পরিশোধনের ব্যবস্থা বা নিরাপদভাবে বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা, প্লাস্টিক জাতীয় কঠিন বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা যেতে পারে। নদী দখলমুক্ত করতে আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বেশি প্রয়োজন। জাগ্রত ও সচেতন নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, সরকারের সুদৃষ্টি এবং আইনের অনুশাসন মৃতপ্রায় নদীগুলোকে রক্ষা করতে কার্যকর হতে পারে।
খন্দকার বদিউজ্জামান বুলবুল:
শিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বাণিজ্য মেলার শেষ দিনে ছিল উপচে পড়া ভিড়
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার পর্দা নেমেছে শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এদিন সকাল থেকেই মেলায় ক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়। দুপুরের পর মেলা প্রাঙ্গণে ক্রেতা-দর্শনার্থীর ভিড় বাড়ে। বিকেল শেষে সন্ধ্যায় সে ভিড় রূপ নেয় জনসমুদ্রে। এমন ভিড়ের মধ্যে ছিল শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার ধুম।
বিকেলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মেলায় থাকা উদ্যোক্তাদের মাঝে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে পুরস্কার বিতরণ করেন তিনি। এবার বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ২২টি প্রতিষ্ঠান প্রথম পুরস্কার, ১৬টি দ্বিতীয় এবং ১৩টি প্রতিষ্ঠান তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে। এর আগে ১ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচলে বাংলাদেশ চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সরেজমিন দেখা যায়, শুক্রবার দুপুর ২টার পর থেকে মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীর ঢল নামে। টিকিট কাউন্টারগুলোতে ছিল মানুষের দীর্ঘ সারি। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। মেলা চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।
বাণিজ্য মেলায় আগত হাটাব এলাকার দর্শনার্থী মামুন মোল্লা বলেন, খুবই ভালো লেগেছে। তবে মেলার ভেতরে ফুটপাতে অনেক হকার বসিয়ে মেলার মানকে একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে। এদের জন্য হাঁটতে অসুবিধা হয়।
মেলায় বিদেশি স্টল কাশ্মীরি শাল হাউসের কর্মী আব্দুল মালেক বলেন, এবার বিক্রি ভালো। দর্শনার্থীও অনেক বেশি।
সায়মন ফেব্রিক্সের বিক্রয় প্রতিনিধি রাজিব নয়ন বলেন, মেলার শুরুতে একটু হতাশ হলেও শেষটা খুব ভালো ছিল। বেচাবিক্রি বেশ ভালো হয়েছে।
মিয়াকোর মার্কেটিং অফিসার আব্দুর রহমান বলেন, আমাদের ব্যবসা ও প্রচার এবং জনগণের সাড়া– সব বিষয় পজিটিভ। ঢাকার ভেতর থেকে রূপগঞ্জেই আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।
মেলার খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ করে আক্কাস আলী নামে এক দর্শনার্থী বলেন, বাণিজ্য মেলার সবই ভালো ছিল, কিন্তু খাবারের মান তেমন ভালো না; দাম তিন থেকে চার গুণ বেশি।
এদিকে শুক্রবার কয়েক লাখ দর্শনার্থীর চাপ সামাল দিতে গলদঘর্ম ৭০০ পুলিশ সদস্য ও শতাধিক সেনা। এর মধ্যে দুপুরে তুচ্ছ ঘটনায় ঈগলু আইসক্রিম স্টলের বিক্রয়কর্মী ও মেলার প্রবেশদ্বার ঠিকাদার নিয়োজিত কর্মীদের মাঝে মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে মেলায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়। এ ঘটনায় সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে বাধার সম্মুখীন হন। পরে তাদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। ঈগলু আইসক্রিম স্টলের কর্মচারীদের হামলায় যমুনা টিভির রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জয়নাল আবেদীন জয় আহত হন।
রূপগঞ্জ থানার এসআই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মানুষ যে যেভাবে পারে, এলোমেলোভাবে মেলায় প্রবেশ করে। এর মধ্যেও সব ঠিক রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছি।
এবারের মেলায় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, হংকং, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য নিয়ে হাজির হন। মেলায় ৯টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এ ছাড়া দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুটি হলের বাইরে মিলে মোট ৩৬১টি স্টল, প্যাভিলিয়ন ও মিনি প্যাভিলিয়ন ছিল। এবারের মেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতিধারণ সংবলিত তারুণ্যের বাংলাদেশ, ৩৬ জুলাই, মুগ্ধ কর্নারগুলো ছিল তরুণদের আগ্রহের স্থানে।