প্রকৃত জাতীয় ঐক্য করতে হলে শ্রমিকের ঐক্য দরকার বলে মন্তব্য করেছেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আসলে মজুরের দেশ। এদেশের ১০ ভাগ জনগণ কৃষক, গার্মেন্টস শ্রমিক, কারখানার শ্রমিক, গৃহ শ্রমিক, দোকান শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, আউটসোর্সিং শ্রমিক। একটি দেশ কেমন চলছে তা বোঝা যায় সে দেশের শ্রমজীবী মানুষ কেমন আছে কিংবা কতটা সম্মানজনক জীবন যাপন করছে। এই শ্রমিকের ভেতর নারী, পুরুষ, আদিবাসী, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ রয়েছে। তাই প্রকৃত জাতীয় ঐক্য করতে হলে শ্রমিকের ঐক্য দরকার।

আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর পুরানা পল্টনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে এসব কথা বলেন অধ্যাপক তিনি। বন্ধ কারখানা চালু, বকেয়া মজুরি পরিশোধ, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণ ও মিথ্যা মামলায় শ্রমিক হয়রানি বন্ধের দাবিতে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গত ১৬ বছর ধরে শ্রমিকদেরকে বিভিন্নভাবে অপমান করে বাংলাদেশে এক ভয়ংকর রকম স্বৈরশাসন কায়েম করা হয়েছে। প্রতিটি গণঅভ্যুত্থানের দিকে তাকালে শ্রমিকের আন্দোলনের শক্তি বুঝা যায়। থ্রি জিরো তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ড.

মুহাম্মদ ইউনুস এখন সরকারের দায়িত্বে। তিন শূন্যের এই তত্ত্বে রয়েছে কার্বন শূন্য, বেকারত্ব শূন্য এবং দারিদ্র শূন্য। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন কারখানা বন্ধ হয়ে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। তাদের বকেয়া মজুরি এখনো পরিশোধ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আইএমএফ, এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ। আইএমএফের তিন বছরে যে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য সরকার যে জনবিরোধী শর্ত পূরণ করছে, সেই একই পরিমাণের ডলার প্রবাসী শ্রমিকরা এই দেশে প্রতি দুই মাসে প্রেরণ করে। হাশেম ফুড কারখানায় শ্রমিক হত্যার গণতদন্তে শিল্প পুলিশ বাতিল করার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, তা এখনও মানা হয়নি বলে জানান তিনি।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য লেখক ও গবেষক মাহতাব উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় এবং অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সভাপতিত্বে উক্ত সভায় বক্তব্য প্রদান করেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক শামীম ইমাম, গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস, গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি, আ ক ম জহিরুল ইসলাম, গার্মেন্টস টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাসুম রেজা, শ্রমজীবী আন্দোলনের আহ্বায়ক হারুন আর রশীদ ভূঁইয়া এবং চলচ্চিত্রকর্মী আকরাম খান। সভায় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, পাটকল শ্রমিক, লেদার শ্রমিক, জণগণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক এবং অধিকারকর্মীরা সংহতি প্রকাশ করেছেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক গ র ম ন টস

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে রাজনীতিকদের কী লাভ?

অবাক হওয়ার ব্যাপার– রাজনীতিকরা কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছেন! এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন ‘অনির্বাচিত’ আখ্যা দিচ্ছে। যদিও নাগরিকদের বড় অংশ এই সরকারের ওপরেই আস্থা রাখছে। নাগরিকদের ধারণা জন্মেছে, সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনায় আসবে, রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের ইচ্ছা বা সক্ষমতার ঘাটতি আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব প্রকট। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এর কারণ খোঁজায় খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক পরিবেশে বর্তমানে বিএনপির ভালো অবস্থানে থাকার কথা। কিন্তু তারা দৃশ্যত চাপের মধ্যে। এমনকি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও মানুষের একচেটিয়া সমর্থন পাচ্ছে, বলা যাবে না। তার মানে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া সাধারণ নাগরিকরা রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নাগরিকদের আস্থা ক্রমে বাড়ছে। এটা স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানুষের আস্থা আরও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে গুণগত সংস্কার আনতে না পারলে দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন কমতে থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোতে এখনও সেকেলে ধাঁচের ব্যক্তি-তোষণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি চালু আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো অভ্যন্তরীণ সংস্কার। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। নেতাকর্মীর বক্তব্যে সুস্থ ধারার রাজনীতির ছাপ থাকতে হবে। তারা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কীভাবে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তা পরিষ্কার করে বলতে হবে। রাজনীতির প্যাটার্নই বদলাতে হবে।

বস্তুত পুরোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা এখনও নব্বই দশকের রাজনীতি করছেন। তাদের বয়ানের মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। তাদের বক্তব্য সচেতন নাগরিকরাও সেভাবে শুনছেন না। বিএনপি বা জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের রাষ্ট্র গঠন নিয়ে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাবনা শোনা যায় না। এমনকি বিএনপির ৩১ দফাও নিজ দলের মধ্যে আলোচনায় আসছে না সেভাবে। আবার সরকারের বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার প্রশ্নে অনেক জরুরি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারছে না। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাই বটে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই রাজনীতি কোনো আকর্ষণ তৈরি করছে না।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবাই আশা করেছিল, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। সেটি আসেনি। সাধারণ মানুষ যে কারণে হতাশ। তারা এক রাজনৈতিক দলের বদলে আরেক রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি ও লুটপাট দেখতে চায় না। মানুষের মধ্যে নতুন চাওয়া তৈরি হয়েছে। তারা আর রাজনৈতিক হানাহানি, মারামারি দেখতে চায় না। তাই নাগরিকদের অনেকেই এখন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গঠিত সরকার বনাম অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে তুলনা করছে। এই তুলনা অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারাবাহিক ব্যর্থতারই ফল! 
বিপরীত দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ, কথা, শরীরী-ভাষা, বিবৃতি, অফুরন্ত কর্মস্পৃহা মানুষের মধ্যে, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষত বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ক্রমে বাড়ছে। কারণ, তারা এ রকম উজ্জ্বল নেতৃত্ব গত কয়েক দশকে দেখেনি। তাই তারা এখন তুলনা করতে পারছে।
আমি প্রায় প্রতিদিন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলি। জনসাধারণের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে এত প্রাণহানির পর মানুষ আর পেশিশক্তিনির্ভর, সন্ত্রাসনির্ভর, চাঁদাবাজিনির্ভর রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা সন্ত্রাসী, চাটুকার পরিবেষ্টিত রাজনীতিবিদদের গলাবাজি শুনতে চায় না। তারা দেখতে চায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, অর্থনীতিতে গতি, বাজারের স্থিতিশীল অবস্থা, ব্যাংকে লুটপাট বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা। 

প্রথমদিকে স্থবিরতা থাকলেও অর্থনীতি আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে; বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার সঙ্গে যে কৌশলী কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও গণমানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদদের উচিত ছিল পুরোনো রাজনীতি ঝেড়ে ফেলে নতুন রাজনীতির ক্যারিশমা দেখানো। কিন্তু সেই প্রজ্ঞা, সদিচ্ছা, প্রচেষ্টা দেখা যায়নি; টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করার ব্যাপারে কর্মস্পৃহা দেখা যায় না। 
প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কি অনন্তকাল থাকবে? সেটা কেউ চাইবে না; জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই হবে। তার আগে রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে এবং শাসন ব্যবস্থায় জরুরি মৌলিক সংস্কার করতেই হবে। গণঅভ্যুত্থান সেই ম্যান্ডেট এই সরকারকে দিয়েছে। 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিকদের নিজের কোয়ালিটি বাড়াতে হবে, যদি তারা টিকে থাকতে চান। দলের মধ্যে ইতিবাচক সংস্কার করতেই হবে। এখনও সেকেলে ধাঁচের রাজনীতি থেকে বের হতে না পারলে এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ হয়ে কাজ না করলে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না। আর অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বসে থেকে বিশেষ কোনো ফায়দা নেই।

শেখ নাহিদ নিয়াজী: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই আন্দোলনকে ‘তথাকথিত’ বলায় ঢাবি ছাত্রদল সভাপতির দুঃখপ্রকাশ
  • ঐক্য-অনৈক্যের রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য
  • সিদ্ধিরগঞ্জে মহাসড়কে বৈষম্য বিরোধী ও এনসিপির বিক্ষোভ 
  • প্রাইম এশিয়া শিক্ষার্থী হত্যা, ছাত্রদল মিডিয়া ট্রায়ালে লিপ্ত হয়েছে: উমামা ফাতেমা  
  • প্রয়োজন বহুপক্ষীয় সক্রিয়তা
  • অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে রাজনীতিকদের কী লাভ?
  • যশোরে আত্মগোপনে থাকা আ’লীগ নেতাদের বাড়িতে পুলিশের অভিযান