মেডিকেলে সুযোগ পেয়েও ভর্তি অনিশ্চিত শাপলার
Published: 31st, January 2025 GMT
শাপলা যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী তখন তার মা কুলছুম বেগম কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর থেকেই শাপলার মনে চিকিৎসক হওয়ার অদম্য ইচ্ছা জাগে। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ এর পর এ বছর মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন শিশুকালে মা হারানো সেই শাপলা। নীলফামারী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেও আর্থিক সংকটের কারণে তার ভর্তি হওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের নিকড়হাটা গ্রামের অটোরিকশা চালক শফিকুল ইসলামের মেধাবী এই মেয়েটির চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। শাপলাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সহায় সম্পত্তি বলতে দুটো ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের। বাবা পেশায় একজন অটোরিকশা চালক। পরিবারের কয়েকজন সদস্যদের নিয়ে তার একার আয়েই চলে সংসার।
তার পরিবার জানায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর স্বল্প আয় দিয়ে যেখানে ঠিকঠাকমতো সংসারই চলে না সেখানে মেয়েকে মেডিকেল কলেজে কীভাবেই বা ভর্তি করবেন আর কীভাবেই তার পড়ালেখার খরচ চালাবেন, সে চিন্তায় বাবা শফিকুলেরও চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের মতো তিনিও সমাজের বিত্তবানদের দিকে তাকিয়ে আছেন, যদি কেউ তার মেয়েটির চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণিতে মেধাতালিকায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিলাভ, একই স্কুল থেকে ২০২২ সালে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ ফল অর্জনের পর ২০২৪ সালে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন শাপলা। এই ধারাবাহিকতায় এবারের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে ৭৪ নাম্বার পেয়ে মেধাতালিকায় ৪৮৫১ তম স্থান অর্জন করেন। নীলফামারী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
অশ্রুসজল চোখে শাপলা বলেন, মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হবো, এ জন্য পড়াশোনা আর নামাজ ছাড়া অন্য কিছুতেই আমার মনোযোগ ছিল না। টাকা দিয়ে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না থাকায় প্রতিদিন প্রায় ১৪ ঘণ্টা করে পড়ালেখা করতাম। আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করেছেন, কিন্তু জানি না- এখন অর্থের কাছে আমাকে পরাজিত হতে হয় কি না।
বাবা শফিকুল মেয়ের এমন সাফল্যে টাকা জোগাড়ের জন্য অটোরিকশা নিয়ে কাকডাকা ভোরে বাড়ি থেকে বের হন আর বাড়িতে ফেরেন রাত ১১টার পর। মেয়ের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নপূরণে তিনি বাড়তি উপার্জনের আশায় প্রতিদিন বাড়তি পরিশ্রম করছেন।
শফিকুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়ের এমন সাফল্যে আমার ভাষা হারিয়ে গেছে। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। আমার মা মরা মেয়ের পড়াশোনা এগিয়ে নিতে যদি কোনও বিত্তবান এগিয়ে আসতেন, তবে অনেক উপকার হতো।
শাপলা বলেন, আমাদের দারিদ্রতার কারণে আমার শিক্ষক মঈন স্যার বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। কমল স্যারও নামমাত্র টাকায় আমাকে পড়াতেন। তাদের প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ।
শিক্ষক মঈন উদ্দিন বলেন, শাপলা অনেক মেধাবী। আমার বিশ্বাস ছিল সে পড়ালেখা করে ভালো কিছু করবে। মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েও টাকার অভাবে ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, একটা মেধাবী শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন হবে না এটা হতে পারে না।
শিক্ষক কমল বলেন, পড়াশোনার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ এবং ভালো কিছু করার বাসনা ওর মধ্যে সবসময়ই ছিল। শাপলা আমাদের স্কুলের গর্ব।
এলাকার পল্লী চিকিৎসক মাসুদ রানা বলেন, আমাদের এই গ্রাম থেকে এই প্রথম কোনও মেয়ে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। আমরা এলাকাবাসী গর্বিত। তবে অর্থের অভাবে এই অদম্য মেধাবীর মেডিকেল কলেজে ভর্তি ও পড়াশোনা এখানেই থেমে যাবে ভেবে খারাপ লাগছে। শাপলার বাবা শফিকুল ইসলাম অটোরিকশা চালক। পড়াশোনার এতো খরচ তিনি কীভাবে বহন করবেন জানি না। এ কারণে শাপলা ও তার বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিত্তবানদের প্রতি অনুরোধ জানাই।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ড ক ল কল জ চ ক ৎসক
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমার মতো দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে চাই’
বাবা ইজিবাইকচালক, মা গৃহিণী। এক টুকরো ভিটে ও টিনের ঘর ছাড়া কিছুই নেই। এই দারিদ্র্যও দমাতে পারেনি মেধাবী মেয়েটিকে। দারিদ্র্যকে জয় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
এমন কৃতিত্বের অধিকারী নন্দিনী রানী সরকার মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের গিলন্ড গ্রামের অনিল চন্দ্র সরকারের মেয়ে। দুই বোনের মধ্যে নন্দিনী বড়। ছোট বোন বিনা রানী সরকারও মেধাবী শিক্ষার্থী। এবার সে এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
নন্দিনীর সাফল্যে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষক ও এলাকার লোকজন সবাই খুশি। তবে আর্থিক টানাপড়েনে মেয়ের পড়াশোনার পরবর্তী খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবারটি। ইতোমধ্যে অবশ্য অনেকেই নন্দিনীর পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন।
নন্দিনী পিএসসিতে জিপিএ ৫, জেএসসিতে জিপিএ ৪.৪৬, এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫ ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পান।
নন্দিনীদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি টিনের ঘর। প্রতিবেশীরা নন্দিনীর সাফল্যে তাদের বাড়িতে এসে শুভ কামনা জানাচ্ছেন। বাড়ির উঠানে রান্না করছেন নন্দিনীর মা সীমা সরকার। মায়ের পাশে বসে রয়েছেন নন্দিনী ও তাঁর বোন বিনা।
নন্দিনীর বাবা অনিল চন্দ্র সরকার জানান, ইজিবাইক চালিয়ে দুই মেয়ে, স্ত্রী ও বাবা-মাকে নিয়ে ছয় সদস্যের সংসার চলে। তাঁর দুই মেয়েই বেশ মেধাবী। মেয়েদের যে চাহিদা, সেটা বাবা হিসেবে কখনও পূরণ করতে পারেননি। মেয়ের স্কুলের শিক্ষকদের কারণে তাঁর মেয়ে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এতে তিনি অনেক আনন্দিত। তিনি বলেন, ‘মেডিকেলে পড়ানোর মতো টাকাপয়সা নাই আমার। মেডিকেলে মেয়ের পড়াশোনায় কেউ যদি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসত তাহলে চিন্তা থাকত না।’
নন্দিনীর মা সীমা রানী সরকার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মেয়েগো প্রাইভেট পড়াতে পারি নাই। পড়ার জন্য নাই কোনো টেবিল-চেয়ার। মাস্টাররা সাহায্য-সহযোগিতা না করলে আমার মেয়ে এতদূর আসত পারত না, ভালো রেজাল্ট করতে পারত না। কিন্তু পড়ালেখার খরচের কথা মাথায় আসলে সেই আনন্দ আর থাকে না।’
নন্দিনী রানী সরকার একজন সফল চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলছি। স্কুল ও কলেজে স্যাররা আমাকে বিনা বেতনে পড়িয়েছেন। বই থেকে শুরু করে সব সহায়তা পেয়েছি। আমার বাবার সামর্থ্য নাই, এত টাকা দিয়ে আমাকে পড়াবেন। সরকার বা কেউ সাহায্য করলে আমার মেডিকেলে পড়ালেখা করা সম্ভব হবে। আমার স্বপ্ন, আমি যেন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারি। আমি যেমন দরিদ্র, অনেক দরিদ্র মানুষ আছেন যারা বিনা চিকিৎসায় মারা যান তাদের সাহায্য করতে চাই, সেবা করতে চাই।’
নবগ্রাম ইউনিয়নের কানিজ ফাতেমা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন নন্দিনী। এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুল হালিম বলেন, নন্দিনী মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় তাঁর স্কুল ও কলেজের সবাই খুশি। এখন মেডিকেলে ভর্তির জন্য নন্দিনীর পাশে তার স্কুল থাকবে।
জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, আমরা নন্দিনীর মতো অদম্য মেধাবীদের দিয়ে আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ব। মেধাবীদের এগিয়ে নিতে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।