সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের প্রস্তাব
Published: 31st, January 2025 GMT
বাল্যবিয়ে ও নির্যাতন উপসর্গমাত্র। এগুলো প্রতিকারে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন উদ্যোগ নেয়, কিন্তু রাশ টেনে ধরা যায় না। সংকটের মূল কারণ সম্পদে নারীর সমান অধিকার না থাকা। তাই উত্তরাধিকার আইনে নারীর সমান অধিকারের সুপারিশ করবে নারী-বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
সম্পদে সমান অধিকার না থাকাকে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে প্রধান বাধা বলে কমিশনের মতামতে উঠে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড.
এ বিষয়ে কমিশনপ্রধান শিরীন পারভিন হক সমকালকে বলেন, ‘কমিশনের লক্ষ্য হলো নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা। সুতরাং নারীর প্রতি বৈষম্য যেখানে আছে, সেটা-ই নিরসন চাই। সেই সঙ্গে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ নেওয়ারও সুপারিশ করা হবে। দেশে নারীর প্রতি যত বৈষম্যমূলক আইন রয়েছে, সেগুলো সংস্কারের সুপারিশ করব।’
এ জন্য দেশে প্রচলিত কোন কোন আইনে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ধারা রয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সংবিধান ও আইন, নীতি নির্ধারণ এবং কর্ম পরিকল্পনা– এই তিন ভাগে ভাগ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আইন যখন বাধা
১৯৭১ সালের এপ্রিলে গঠিত মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণার মূলনীতি ছিল সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও এই নীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। সংবিধানের ২৮ (১) ধারা অনুযায়ী, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ অথচ ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের তৈরি পারিবারিক আইন এখনও বহাল। এতে রাষ্ট্রের ৫০ ভাগ নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অথচ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল হয়ে যাবে বলে সংবিধানের ২৬ (১) ও (২) ধারায় অঙ্গীকার রয়েছে।
এদিকে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিয়ে ও বিচ্ছেদে সমানাধিকার বিষয়ে সিডও সনদের ২ ও ১৬ (১) (গ) দুটি ধারায় সংরক্ষণ বহাল রেখেছে বাংলাদেশ। এটা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০, ১৯, ২৬, ২৭ ও ২৮-এর মূল নির্যাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবিধানের ২৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘বৈষম্যহীনতা’র সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তরাধিকার আইন বহাল থাকার যৌক্তিক ও আইনগত ভিত্তি নেই।
ছয় জেলায় সভা
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক তারিখ হলেও কমিশনের কার্যক্রম দেরিতে শুরু করায় মার্চে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। বৈষম্য দূর করে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, সিলেট ও রংপুরে বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে সভা করেছে কমিশন। ওই সব সভায় অধিকারকর্মী, নারী ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, আইনজ্ঞসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাদের মতামতের ভিত্তিতে কয়েকটি সুপারিশ পেয়েছে কমিশন। ময়মনসিংহে সভা হলে প্রাপ্ত সুপারিশ নিয়ে মূল প্রতিবেদন সাজানো হবে বলে জানান নারী-বিষয়ক সংস্কার কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সদস্য।
১৮-এর আগে বিয়ে নয়
মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮। তবে আইনে বলা আছে, মা-বাবা চাইলে ১৬ বছরেও বিয়ে হতে পারে। চিকিৎসক ও অধিকারকর্মীরা এ আইনের সঙ্গে একমত নন। শিশু আইন, শিশুনীতিসহ বিভিন্ন আইন ও নীতি এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুসমর্থন করে সরকার ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাই বাল্যবিয়ে নিরোধের লক্ষ্যে এ ধারা বাতিলের সুপারিশ করা হবে।
স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে সুপারিশ
স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য– সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে গর্ভনিরোধক, এমআরএম কিট এবং নিরাপদ প্রসব পরিষেবা দেওয়ার জন্য ৫ম সেক্টরাল প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে। কারণ, ২০২৩ সাল থেকে লজিস্টিক সহায়তা (পণ্য সরবরাহ, মানবসম্পদ ও বাজেট) কমে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নারীরা তাদের মৌলিক প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইসিপিডির (জনসংখ্যা ও উন্নয়ন-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন) প্রতিশ্রুতি হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এর মাধ্যমে এফপি (পরিবার পরিকল্পনা) ২০৩০ এবং এসডিজি (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) ২০৩০ গুরুত্ব পাবে। মাতৃমৃত্যু হ্রাস করার জন্য এমআর/এমআরএম পরিষেবা উন্নত করতে হবে।
নিম্ন-কর্মক্ষম অঞ্চলের জন্য ভৌগোলিকভাবে লক্ষ্যযুক্ত পরিষেবা প্যাকেজ (বিসিসি প্রচারণা এবং গর্ভনিরোধক সরবরাহসহ) বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা সেবার জন্য দক্ষ মানব সম্পদের ঘাটতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নার্সসহ টাস্ক-শেয়ারিং উদ্যোগ সম্প্রসারণ করতে হবে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারত্ব জোরদার করতে হবে। যুবকেন্দ্রিক পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবার অ্যাপস এবং মান বাড়িয়ে কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্লায়েন্ট ফলো-আপ, চাহিদা তৈরি, রিপোর্টিং ইত্যাদিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় দক্ষ মানব সম্পদের ঘাটতি পূরণ, স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্তি, শিশু মৃত্যুর হার কমাতে পদক্ষেপ ও পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বৈষম্যমূলক সব আইন পরিবর্তনের সুপারিশ
বছরের পর বছর ধরে নারীর অধিকার সুরক্ষার জন্য আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করে আসছে কয়েকটি সংগঠন। অভিন্ন পারিবারিক আইন চালুর দাবিতে আন্দোলন করছে। বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকারে সব ধর্মের নারী-পুরুষের জন্য অভিন্ন আইন থাকার প্রস্তাব করেছে।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ মনজুন নাহার বলেন, প্রচলিত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পারিবারিক আইন সিডও সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এসব আইন। অবিলম্বে অভিন্ন ও সার্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করতে হবে।
মৃত্যুর পরও নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সদস্য জানান, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নয়, মৃত্যুর পরও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যা যা করার দরকার, সবকিছু প্রতিবেদনে আসবে। আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি সেগুলো কার্যকরে বাধার বিষয়ও তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসবে। কমিশনে তরুণদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে একজন ও শ্রমজীবী নারীদের অধিকার রক্ষায় যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে দু’জন প্রতিনিধি আছেন। ইতোমধ্যে কমিশন ১৩টি সভার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। সব পর্যায়ে তরুণদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নসহ বাস্তবায়ন করার সুপারিশ থাকবে।
শ্রমজীবী নারীদের বিষয়ে সুপারিশ আসছে জানিয়ে শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের বিষয়টি কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় অংশগ্রহণ কম।’ এ নিয়ে ইতোমধ্যে শ্রম কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ সভা করা হয়েছে।
কমিটিতে কে কে
গত ১৭ অক্টোবর নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে ১০ সদস্যের নারী-বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর এক মাস পর গত ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন– ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীপক্ষের পরিচালক কামরুন নাহার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প র ব র ক আইন র স প র শ কর র জন য পর ষ ব আইন প সদস য সরক র ব ষয়ক
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বড় সংঘাতের শঙ্কা
কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে ভয়াবহ বন্দুক হামলার ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সংঘাতের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা দাবি করে ওই ঘটনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কঠোর বার্তা দিয়েছেন। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ‘শক্ত ও স্পষ্ট জবাবে’র কথা বলেছেন। অপর দিকে পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে শক্ত জবাবের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এ অবস্থায় দুই দেশের মধ্যে বড় সংঘাতের শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গত মঙ্গলবার পেহেলগামে বন্দুকধারীর হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন, যাদের প্রায় সবাই পর্যটক। হামলার দায় স্বীকার করে অল্প পরিচিত সংগঠন রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। এটিকে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়্যেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করা হয়। দ্য গার্ডিয়ান অনলাইন জানায়, পাকিস্তান বরাবরই সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার কথা অস্বীকার করে আসছে। তবে তারা বলে আসছে, সার্বভৌম কাশ্মীরকে সমর্থন করে তারা। পেহেলগাম হামলার ঘটনাটি প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা অনেকটাই বাড়িয়েছে, যারা এরই মধ্যে তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ ঘোষণা ও উপত্যকার মানুষকে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই বন্ধ না করতে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের আহ্বানের এক সপ্তাহ পর এ হামলা ঘটল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতিনির্ধারক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘অঞ্চলটির জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী একে অপরকে চোখ রাঙানি দিচ্ছে।’
হামলার ঘটনায় প্রথম প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাদের বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত-বাণিজ্য কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে। ভারত অতীতে একাধিকবার পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত জড়ালেও কখনও এ চুক্তি স্থগিত করেনি।
জিও নিউজ অনলাইন জানায়, সিন্ধু নদের পানিচুক্তি স্থগিত করা নিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছে ইসলামাবাদ। ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে গতকাল বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে এনএসসির বৈঠকে বেশ কিছু পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক শেষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিবৃতিতে সিদ্ধান্তগুলো জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান কঠোরভাবে ভারতের সিন্ধুর পানিচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা নাকচ করেছে। পাকিস্তান বলেছে, এ চুক্তি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হওয়া বাধ্যবাধকতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি; এককভাবে এটি স্থগিতের কোনো বিধান নেই। পানি পাকিস্তানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু, তা দেশের ২৪ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে এবং যে কোনো মূল্যে এ পানি পাওয়ার বিষয়টি রক্ষা করা হবে। সিন্ধু চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান যে পানি পাবে, তার প্রবাহ বন্ধ বা অন্যদিকে নেওয়ার যে কোনো চেষ্টা এবং ভাটি অঞ্চলের অধিকার ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা যুদ্ধের শামিল বলে বিবেচনা করা হবে এবং জাতীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে এর জবাব দেওয়া হবে।
পাকিস্তান বলেছে, ভারতের ‘বেপরোয়া ও দায়িত্বহীন আচরণের’ মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। ফলে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিতের অধিকার প্রয়োগ করবে এবং তা শুধু সিমলা চুক্তি স্থগিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আর তা ভারত পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসবাদ উস্কে দেওয়া, আন্তঃসীমান্ত হত্যা বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক আইন ও কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো না মেনে চলা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
পাকিস্তান অবিলম্বে ওয়াগা সীমান্ত চৌকি বন্ধ করছে। দেশটি বলেছে, এ পথ দিয়ে ভারত থেকে সব ধরনের চলাচল বন্ধ থাকবে। বৈধভাবে যারা এ পথে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন, তারা অবিলম্বে ফেরত যেতে পারবেন। তবে ৩০ এপ্রিলের পর এ সুযোগ দেওয়া হবে না। ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া সব সার্ক ভিসা বাতিল করেছে পাকিস্তান। এ ভিসার আওতায় পাকিস্তানে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশটি ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য শিখ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হচ্ছে না।
ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত দেশটির প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। অবিলম্বে তাদের পাকিস্তান ছাড়তে বলা হয়েছে। তাদের সহায়তায় নিযুক্ত কর্মীদেরও ভারতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মকর্তার সংখ্যা ৩০-এ নামিয়ে আনতে বলেছে পাকিস্তান। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তা করতে বলা হয়েছে। ভারতের মালিকানাধীন বা ভারত থেকে পরিচালিত সব বিমান পরিবহন সংস্থার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। নয়াদিল্লির সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। সেই সঙ্গে পাকিস্তান দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিতের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
চলমান উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের কাশ্মীর ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে। বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এ নতুন নির্দেশনা জারি করে। এতে ভারতশাসিত কাশ্মীর ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে মণিপুর এবং মধ্য ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অংশেও।
১৯৮৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়তে শুরু করে। ২০১৯ সালে এক বিতর্কিত পদক্ষেপে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে এবং রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে। দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, হিন্দু-প্রথম রাজনৈতিক এজেন্ডা গ্রহণের জন্য পরিচিত সরকার কাশ্মীরকে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে আরও একীভূত করার জন্য অ-স্থানীয়দের জমির মালিকানাও অনুমোদন করে।
এনডিটিভি অনলাইন জানায়, পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বিহারের মধুবানিতে গিয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বৃহস্পতিবার এক সমাবেশে তিনি বলেন, ভারত সন্ত্রাসী ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের চিহ্নিত ও পরিচয় শনাক্ত করে শাস্তি দেবে। তাদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে, যা তারা কল্পনাও করেনি। এ অবস্থায় কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের ধরতে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। এ অভিযান চলাকালে গতকাল অস্ত্রধারীদের গুলিতে এক ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন।
পেহেলগাম হামলার ঘটনায় বুধবার মধ্যরাতে নয়াদিল্লিতে তলব করা হয় পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ কূটনীতিককে। এএনআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার মধ্যরাতে নয়াদিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয় ভারতে থাকা পাকিস্তানের কূটনীতিক সাদ আহমেদ ওয়ারাইচকে। বুধবারই ভারত জানিয়েছিল, নয়াদিল্লির পাক দূতাবাসে থাকা সে দেশের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নৌ উপদেষ্টা, বিমান উপদেষ্টাকে ‘অবাঞ্ছিত’ (পার্সোনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করা হচ্ছে। এ সামরিক উপদেষ্টাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়।
চলমান উত্তেজনার মধ্যে বৃহস্পতিবার আরব সাগরে ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে ভারত। ইন্ডিয়া টুডে জানান, ‘আইএনএস সুরাট’ নামের ওই মিসাইল ডেস্ট্রয়ারের সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছে।
ভারতের আচরণ ‘শিশুসুলভ’ বলছেন পাকিস্তানের মন্ত্রী
ভারতের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার। পাকিস্তানের একটি বেসরকারি চ্যানেলে তিনি বলেন, ভারতের ঘোষণাগুলো শিশুসুলভ। ভারত প্রতিটি ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। অতীতের মতো এবারও পাকিস্তানকে দোষারোপের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা বৈঠকে ভারতকে যোগ্য জবাব দেব, এ জবাব কম হবে না।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের তথ্যমন্ত্রী আজমা বোখারি হামলার ঘটনায় ইসলামাবাদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, ভারতের ‘যে কোনো সম্ভাব্য আগ্রাসনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত’ পাকিস্তান। ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ অজুহাতে ভারতের যে কোনো দুঃসাহসিক কাজ ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
যুদ্ধের শঙ্কা নিয়ে যা বলছেন বিশ্লেষক
সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা সম্ভবত একটা দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখতে পাব, যা দুই পক্ষকেই একটা বার্তা দেবে। ২০১৬ সাল থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর থেকে এ জাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা হলো আন্তঃসীমান্ত হামলা বা বিমান হামলা। কাজেই, সরকারের পক্ষে এখন সেই মাত্রার নিচে কোনো কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। অনুমান করা যায়, পাকিস্তানও আগের মতোই জবাব দেবে। এ ক্ষেত্রে বরাবরের মতোই যে ঝুঁকিটা থেকে যায় সেটা হলো, হিসাবে ভুল উভয় পক্ষেরই হতে পারে।’
রাঘবন বলেন, পারমাণবিক হাতিয়ার একই সঙ্গে বিপজ্জনক ও নিয়ন্ত্রক। এটা দুই পক্ষের নীতিনির্ধারকদের সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করে। যে কোনো প্রতিক্রিয়া সুনির্দিষ্ট এবং লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করে হতে হবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিতে পারে; তারপর সেখান থেকে সরে এসে আবার অন্য পথ অনুসরণ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানির ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি মনে করেন, কোনো গোপন অভিযান চালানো হলে, দায় অস্বীকার করার সুযোগ থেকে যায়। কিন্তু সেই পদক্ষেপ মানুষকে দেখানোর যে একটা রাজনৈতিক প্রয়োজন রয়েছে, সেটাকে মেটাতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেন হক্কানি মনে করেন, ২০১৬ সালের মতো সীমিত পরিসরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর বিষয়ে যদি ভারত বিবেচনা করে, তাহলে এবার উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।