সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ আইনে সংশোধনী আনতে সরকারকে প্রস্তাব পাঠাবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরুতে তারা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে। 

এদিকে, আইন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ৪১টি সংসদীয় আসনের বর্তমান সীমানা পুনর্নির্ধারণের দাবিতে ২৪৮ আবেদন জমা পড়েছে ইসিতে। এর বেশির ভাগই ২০০১ সালের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। 

গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠক শেষে কমিশনার আবুল ফজল মো.

সানাউল্লাহ বলেন, এসব নিষ্পত্তিতে সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত আসে, সে অপেক্ষায় আছে ইসি। এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আছে। তাই ইসিকে অপেক্ষা করতে হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীনের সভাপতিত্বে তিন ঘণ্টার এই বৈঠকে আলোচ্যসূচিতে ছিল ১২টি বিষয়। বৈঠকে ভোটার তালিকা আইন, আন্তর্জাতিক ও দেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা এবং নির্বাচনের সময় সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা আরও পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য এগুলো ইসির সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে সানাউল্লাহ বলেন, ভোটার তালিকা আইন আরও পর্যালোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। 

নির্বাচন কমিশনের সভায় যে চারটি আইন ও নীতিমালা পর্যালোচনা করা হয়েছে, একই বিষয় নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আছে। তাদের সেই সুপারিশ এখনও বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। এর মধ্যে ইসির এই উদ্যোগের ফলে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হতে পারে কিনা– এমন প্রশ্নে সানাউল্লাহ  বলেন, এটা ইসির নিজস্ব চর্চা। এটি সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। এখানে সাংঘর্ষিক হওয়ার সুযোগ নেই। 

সীমানা নির্ধারণ আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনে দুটি বিষয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে। মূলত জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। ইসি ভৌগোলিক আয়তন, অবস্থান, সর্বশেষ জনশুমারি প্রতিবেদন ইত্যাদির ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ করতে চায়। দেশের জনসাধারণের শহরমুখী প্রবণতা রয়েছে। শুধু জনসংখ্যার ভিত্তিতে করলে শহরের দিকে আসনসংখ্যা বাড়বে, অন্য এলাকায় কমে যাবে। এতে সঠিক প্রতিনিধিত্ব হবে না বলে কমিশন মনে করে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনের উপধারায় একটি ছাপার ভুল আছে। ইসি এটি সংশোধনের প্রস্তাব পাঠাবে। সংস্কার কমিশনও সীমানা নির্ধারণ আইনের একটি খসড়া করেছে। ইসিও সংশোধন করছে। দুটির মধ্যে পার্থক্য থাকলে ইসি কোনটা নেবে– এমন প্রশ্নে সানাউল্লাহ বলেন, এখানে কোনো পার্থক্য হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ, কতগুলো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। 

আইন-বিধিগুলো পর্যালোচনা শেষে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে কিনা, এমন প্রশ্নে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, কমিশনে প্রতিবেদন আসার পর কমিশন যদি মনে করে তাহলে পাঠানো হবে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশের কারণে ইসির কাজ দেরি হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে আছি। সংস্কারটা ন্যাশনাল ডিমান্ড। আমরা তো এর বাইরে নই।

সম্প্রতি সিইসি বলেছেন, সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে। বিষয়টি সরকারকে ইসি জানিয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নে সানাউল্লাহ বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইসি তাদের পর্যবেক্ষণ সরকারকে জানাবে। 

এ ছাড়া সভায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার বিষয়টি আরও সহজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রবাসী ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তিনটি বিকল্প নিয়ে ভাবছে ইসি। সেগুলো হলো– পোস্টাল ব্যালট, প্রক্সি ভোটিং এবং অনলাইন ভোটিং।

এনআইডি সংশোধন প্রক্রিয়া মানবিক করার কথা ভাবছে

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধন প্রক্রিয়া মানবিক করার কথা ভাবছে ইসি। এ জন্য একটা নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সানাউল্লাহ বলেন, এনআইডি সংশোধন সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে  আলোচনা হয়েছে। সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা কমিশনের কাছে আসছে। এগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হবে। তিনি বলেন, ১৮২ প্রতিষ্ঠান ইসির হাতে থাকা জাতীয় সার্ভার থেকে সেবা নিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনার আলোকে ইসি মনে করছে, নিরাপত্তা ফিচারগুলো আরও জোরদার করতে হবে। এটা সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। 

ভোটারের আস্থা ফেরানোর পরামর্শ ইইউর 

ইসিকে ভোটারের আস্থা ফেরানোর পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গতকাল সকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে  সফররত ইইউ গণতন্ত্র বিশেষজ্ঞ মাইকেল লিডর সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এমন পরামর্শ দেন।

বৈঠক শেষে এ বিষয়ে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, আমরা দু’সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা তাদের মতবিনিময়ের ফিডব্যাক দিতে এসেছেন। সব মহলের একটাই কথা- সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। প্রবাসী বাংলাদেশির ভোটাধিকার ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা মডেল থাকলে শেয়ার করতে বলা হয়েছে। এটা জটিল প্রক্রিয়া হলেও তারা বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান সচিব। 

মাইকেল লিডর বলেন, দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসে আমরা নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন পর্যন্ত যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়– এটা বোঝা যাচ্ছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস থ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ভোটসন্ত্রাস ব্যক্তি-দল কারও জন্য ভালো নয়: সিইসি

ভোটসন্ত্রাস ব্যক্তি-দল কারও জন্য ভালো নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ভোটাসন্ত্রাস করে আপাতদৃষ্টিতে জয় পাওয়া যায়। কিন্তু আখেরে নিজের বা দল কারও জন্য ভালো হয় না। এজন্য আমি বলতে চাই, কেউ এ ধরনের কাজ করবেন না।

আজ রোববার নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী, ২ মার্চ ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করতে হয়। এরমধ্যে আমাদের আবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হচ্ছে। এ কার্যক্রম শেষ হলে আগামী জুনের মধ্যে আরেকটা ভোটার তালিকা প্রস্তুত হয়ে যাবে। 

মানুষ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, যদি এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে যারা আহত ও শহীদ হলেন তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। ভোটকেন্দ্রে ভোট দেওয়া শুধু এখন আর অধিকার নয়, এটা একটা দায়িত্বও। আমাদের ওপর মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। অন্য কোনো ইসির ওপর এতো প্রত্যাশা ছিল না।

এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য দেবে। এটা ভিন্ন ভিন্ন হবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমাদের এখানে অনেকেই আছেন, যারা মনে করেন, আমার দলই দেশপ্রেমিক আর কোনো দল নয়। এট ঠিক না। মানুষ কিন্তু জন্মগতভাবেই দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেমটা কারও মনোপলি (একক অধিকার) নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে কম-বেশি হয়।

তিনি আরও বলেন, আমি যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, এমন কোনো ব্যক্তি পাইনি, যে সুন্দর-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়নি। সবাই সুন্দর-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই কথা হয়েছে; সবাই সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চেয়েছে। আমরা জাতির কাছে ওয়াদা দিয়েছি, আমাদের এজেন্ডা বাংলাদেশের এজেন্ডা, ১৮ কোটি বাংলাদেশির এজেন্ডা। সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমাদের এজেন্ডা। এর বাইরে আমাদের কোনো এজেন্ডা নেই। 

অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, জনগণের অংশগ্রহণই হলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের শাসক নির্বাচন করে। ভোটারদের মতামতের তখনই প্রতিফলন হবে, যদি ভোটার সঠিকভাবে ভোট দিতে পারে।

নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ বলেন, আমরা চারদিকে দেখছি, সংস্কার আর সংস্কার। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ইসির কি সংস্কার হবে না? আমি চাই, খোলা মাঠে নির্বাচনটা হোক। স্কুল-কলেজের খোলা মাঠে নির্বাচন করা কি সম্ভব নয়। আমরা চাই ট্রান্সপারেন্ট। কিন্তু এজন্য সবার সহযোগিতা করলে এটা করা সম্ভব।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তার দায় কেউ না কেউ নেবে। যদি বিগত নির্বাচনগুলো ভালো না হয়ে থাকে; এর দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, এর দায় ইসিকে নিতে হবে। কেউ এর দায় এড়াতে পারেন না।

তিনি বলেন, আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কঠিন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা ভেঙে যাবো, কিন্তু মচকাবো না। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে বিশ্বাস অর্জনের জন্য যা যা করার প্রয়োজন, তা করতে হবে। প্রথম পরীক্ষাই হবে আমাদের একটা ভালো নির্বাচন করা।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আজকের ভোটার দিবস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। ৩০ জুনের মধ্যে আরও একটি ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। ভঙ্গুর নির্বাচনব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা করতে হবে। আমরা কোনো রক্তাক্ত, হানাহানি ও চুরি দেখতে চাই না। এসব প্রতিরোধ করতে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।

ইসি সচিব আখতার আহমেদের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে সংস্থাটির অতিরিক্ত সচিব, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক, নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় এনআইডি মহাপরিচালক জানান, বাড়ি বাড়ি হালনাগাদ কার্যক্রমে ভোটার তালিকা থেকে ১৯ লাখ মৃত ভোটার কর্তন করা হয়েছে। সারাদেশে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৬৩ জনের।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভোটসন্ত্রাস ব্যক্তি-দল কারও জন্য ভালো নয়: সিইসি