গণতান্ত্রিক উত্তরণে উভয় সংকটে বাংলাদেশ
Published: 31st, January 2025 GMT
গণতান্ত্রিক উত্তরণে উভয় সংকটে বাংলাদেশ। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় যত এগোচ্ছে, প্রতিশ্রুত সংস্কার শেষ করতে তত চাপে পড়ছে অন্তর্বর্তী সরকার। রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক চাপও। সরকারের সংস্কার কর্মসূচিকে লাইনচ্যুত করতে বিরোধীদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আবার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল, তাও ম্লান হতে শুরু করেছে বলে মনে করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্থাটি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ : গণতান্ত্রিক উত্তরণে উভয় সংকট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে ক্রাইসিস গ্রুপ প্রকাশিত ‘ওয়াচ লিস্ট-২০২৫’ এ উত্তরণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও এর সদস্য দেশগুলোর পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
প্রতি বছর ক্রাইসিস গ্রুপ ইইউ ও এর সদস্য দেশগুলো কোথায় শান্তির সম্ভাবনা বাড়তে পারে, তা চিহ্নিত করে ‘ইইউ পর্যবেক্ষণ তালিকা’ প্রকাশ করে। এ বছরের তালিকায় বাংলাদেশ ছাড়াও ইউক্রেন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল, ইরানসহ কয়েকটি দেশের নাম রয়েছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বলেন, ‘বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমার সময় শেষ। রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দর কষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় চলতি বছর বাড়তে পারে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।’
তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিতে চাপে রয়েছে সরকার, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে তারা পেয়েছে। ফলে অর্থনীতিকে আবারও সঠিক পথে ফেরত আনার চলমান প্রচেষ্টার সুফল পেতে আরও সময় লাগবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়ে গেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’ এর পরও আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন, এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তি ও জবাবদিহিমূলক করার বিরল সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন থমাস কিয়ান। তিনি বলেন, ‘এ লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো কয়েকশ প্রস্তাব-সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে।’
ক্রাইসিস গ্রুপের এ কনসালট্যান্ট বলেন, ‘নির্বাচনী রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার প্রক্রিয়ায় সমর্থন ও অন্তর্বর্তী সরকার যাতে দেশকে জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়, তা নিশ্চিতেতে আলাপ-আলোচনা থেকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বিদেশি অংশীদাররা।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাসের কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছর জুনের মধ্যে এ নির্বাচন হবে। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড.
ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, হাসিনার আওয়ামী লীগ দীর্ঘ শাসনকালে রাষ্ট্রযন্ত্রের বড় অংশে দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। দলটি এখন রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারকে সাংবিধানিক, নির্বাচনী, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের সুযোগ এনে দিয়েছে। তবে হাসিনার পতনের পর পর অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল, তা ম্লান হতে শুরু হয়েছে। ড. ইউনূস এখন অভ্যুত্থানের সুনির্দিষ্ট ফলাফল দেখানোর জন্য চাপে পড়ছেন। সরকার শুধু অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে মতপার্থক্য দূর করার সংগ্রাম করছে তা নয়, দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা নিয়েও লোকজনের সমালোচনার শিকার হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এসব চ্যালেঞ্জ এ বছর আরও বাড়তে পারে। কেননা বিরোধী দলগুলো, ছাত্রনেতা, ইসলামী দলগুলো ও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য শক্তি নির্বাচনী সুবিধা আদায়ে তৎপর। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। হাসিনা সরকারকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শক্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়া দেশটির সঙ্গে এমন সম্পর্কও বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক বাধা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর দেখভালের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যুদ্ধকবলিত মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তের অস্থিতিশীলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক উত্তরণে সমর্থন ও অত্যন্ত গুরুত্বের ভূ-রাজনৈতিক একটি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের (বাংলাদেশ) সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ইইউর সামনে বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশ।
ইইউ ও এর সদস্য দেশগুলোর করণীয়
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চপর্যায়ের সফর আয়োজন ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজে সমর্থনের ওপর জোর অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে দেশের অভ্যন্তরে ড. ইউনূস সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং তার কর্মসূচি ক্ষুণ্ন করতে চাওয়া শক্তিগুলো দুর্বল হয়। নতুন অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতামূলক চুক্তির চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে ইইউকে। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিকে কারিগরি এবং আর্থিকভাবে সমর্থন দেওয়া দরকার। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা, শাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারে ইইউ। এ জোটের উচিত হবে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে একটি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানো।
ক্রাইসিস গ্রুপ মনে করে, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় ইইউর অবদান রাখা দরকার। এ জন্য দেশটির জন্য বাড়তি অর্থনৈতিক সমর্থন আদায়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিজের প্রভাবকে কাজে লাগাতে পারে ইউরোপ। অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার আরও আকর্ষণীয় বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা, তৈরি পোশাক উৎপাদন খাতের বাইরে এনে দেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার প্রচেষ্টায় সমর্থন, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পদ পুনরুদ্ধারে সহায়তা এবং ২০২৯ সালের পরও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার বিস্তৃত করতে ঢাকার সঙ্গে সমঝোতা চালিয়ে যাওয়া দরকার।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা কমাতে ইইউর কাজ করা দরকার। উভয়ের মধ্যে অনাস্থা কাটিয়ে সম্পর্ক ভালো অবস্থানে নিতে ইইউর উচিত, দু’পক্ষের ওপরই প্রভাব খাটানো। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা– উভয়কে সহায়তায় বাংলাদেশে অর্থায়ন বজায় রাখা দরকার। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের ওপর জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন আয়োজন করতে ঢাকা যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে সহায়তা এবং সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎসাহিত করতে পারে ইউরোপ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক সরক র র ব যবস থ র জন য র র জন দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষার মানের ভয়াবহ অবনতি বেড়েছে বাণিজ্য: শিক্ষা উপদেষ্টা
শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও মানের ভয়াবহ অবনতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যও দেখা যাচ্ছে। এটি আশঙ্কাজনক। এখন প্রযুক্তির যুগ, সভ্যতার পথ ধরে এগোতে গেলে প্রযুক্তি তো লাগবেই। তবে নৈতিকতা ছাড়া সভ্য হওয়া যাবে না। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পূর্বাচলে বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু, তাঁর মতো বিজ্ঞানীর নামে করা ভবন-স্থাপনা ছিল, সেগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি স্থাপনার নামও বদলানো হয়েছে। এটি আমাকে মর্মাহত করেছে। আমি আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীরা মিলে এর প্রতিকার করবে।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, আর্থিক বিবেচনায় আপনারা পেশা বেছে নেবেন না। বরং যে কাজটি করতে ভালো লাগে, সেরকম পেশা বেছে নেওয়া উচিত। আমরা এমন সমাজে বাঁচতে চাই, যেখানে সৎভাবে বুক উঁচু করে বাঁচা যায়।
গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের স্বার্থে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকের ধারণা ছিল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা শুধু নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়েই চিন্তা করে, তাদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজ করে না। তবে আমরা সাম্প্রতিক যে গণঅভ্যুত্থান দেখেছি, সেখানে ব্র্যাকসহ বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে জীবনবাজি রেখে এগিয়ে এসেছিল, তাতে সবার ভুল ভেঙেছে।
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিক শারমিন ওবায়েদ চিনয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন তামারা হাসান আবেদ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার।
সমাবর্তনে ভেলিডিক্টোরিয়ান বক্তব্য দেন চ্যান্সেলর স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী শিহাব মুহতাসিম ও সমাপনী বক্তব্য দেন সমাবর্তন কমিটির কো-চেয়ার ড. সাদিয়া হামিদ কাজী।
এবারের সমাবর্তনে চার হাজার ৮২৯ জন শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে দু’জনকে চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক, ২৮ জনকে ভাইস চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।