গত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরা প্রকৃতি ও পরিবেশ খুবলে খাওয়ার যে ভয়াবহ চক্র গড়ে তুলেছিল, তা এখনও চলমান। ক্ষমতার পালাবদলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং এসব চক্রের চালকের আসনে এসেছে নতুন মুখ। তাদের হাত ধরে হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে বালু ও মাটিখেকোদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড।
জেলাজুড়ে মাটিখেকো চক্রের সদস্যরা অব্যাহত রেখেছে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে বিক্রির তৎপরতা। কৃষি বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পরেও থামছে না এই যজ্ঞ।
টপ সয়েল হলো মাটির ওপরের স্তর। মাটির এই স্তরে জৈব পদার্থ এবং অণুজীবের সর্বাধিক ঘনত্ব বিদ্যমান; যেখানে প্রকৃতির অধিকাংশ জৈবিক কার্যকলাপ ঘটে। প্রাকৃতিকভাবে মাটির উপরিভাগের এই স্তরের উর্বরতা ও ফসল উৎপাদনের সক্ষমতা সর্বোচ্চ। তাই কৃষি বা ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি ক্ষয় হলে বা হ্রাস পেলে ফসল উৎপাদন ভয়াবহ ব্যাহত হয়; যা সামগ্রিকভাবে একটি অঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে, জমির উপরিভাগের ছয় থেকে দশ ইঞ্চিতে জৈব পদার্থ বিদ্যমান। এই অংশটিই টপসয়েল। এই স্তরের মাটি কাটার ফলে জমির ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই কৃষিজমির এই স্তরের মাটি কাটা ও বিক্রি করা আইনত নিষিদ্ধ। তবে মাটিখেকো চক্রের সদস্যরা স্থানীয় কৃষকদের নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলছে। প্রান্তিক কৃষক ভবিষ্যতের ভয়াবহতা অনুমান করতে না পেরে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিচ্ছে নিজেদের জমির টপসয়েল।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১২ এর ৬ ধারা) অনুযায়ী, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট টিলা ও পাহাড় নিধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপসয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
সাধারণ কৃষকরা জানান, কিছু জমি পলিমাটি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। যার কারণে সেসব জমির উপরিভাগের মাটি কাটতে দিচ্ছেন তারা। স্থানীয়রা জানান, টপ সয়েল কেটে নিয়ে শুধু যে ফসলি জমি ধ্বংস করা হচ্ছে তা নয়, এই মাটি পরিবহনের কাজে যেসব ভারী যানবাহন ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কারণে স্থানীয় সড়ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি রক্ষায় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সচেতন মহল।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলা, নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, বাহুবল, লাখাই, মাধবপুরসহ প্রতিটি উপজেলায় চলছে এই টপসয়েল কেটে নেওয়ার কাজ। অসচেতন কৃষক আর ধূর্ত মাটিখেকো চক্রের সদস্যদের কারণে প্রাণশক্তি হারাচ্ছে এই অঞ্চলের উর্বর ফসলের প্রান্তর। প্রতিদিন হাওরের বিভিন্ন ফসলি জমিতে এক্সক্যাভেটর লাগিয়ে মাটি কাটা শুরু হয়। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি ট্রাক্টর মাটি মাত্র ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় কিনে নিয়ে ভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। 
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সুলতানশী এলাকার বাসিন্দা অনিক জানান, কয়েক বছর ধরেই কৃষিজমি থেকে মাটি কাটার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে এ ক্ষেত্রে স্বস্তি মিলবে বলে আশা ছিল। তবে সেটি হয়নি। মাটিখেকো চক্রের নিয়ন্ত্রণে শুধু হাত বদল হয়েছে। কৃষকদের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তাদের জমি থেকে অমূল্য এই মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক খাদ্যভান্ডারে এরই মধ্যে এর প্রভাব দৃশ্যমান। এ বিষয়ে প্রশাসনকে আরও কঠোর নজরদারি করতে হবে।
লাখাইয়ের বুল্লা গ্রামের বাসিন্দা আরিফ আহমেদ জানান, কৃষিজমি থেকে কেটে নেওয়া মাটি পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্ট ও ট্রাক্টরের কারণে এলাকার রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত। স্থানীয়দের যে ভোগান্তি হচ্ছে তা বর্ণনাতীত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎপরতার কথা বলা হলেও বাস্তবতা বলছে, সেটি যথেষ্ট নয়।
আজমিরীগঞ্জের বাসিন্দা রুজেল মিয়া জানান, বর্ধিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মাটির সবচেয়ে উর্বর ও জৈবিক গুণে ভরপুর স্তরকে রক্ষা করা। প্রকৃতির দেওয়া শক্তি নষ্ট করে কৃত্রিম সার আর রাসায়নিকে তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অবান্তর। টপসয়েল টিকলে ফসল উৎপাদনে কৃষকের সার ও কীটনাশক ব্যয়ও হ্রাস পাবে। তাদের এটা বুঝতে হবে। 
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল জানান, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি সৃষ্টির জন্য আশীর্বাদ। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এই স্তরের মাটি কেটে নিলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষকের জীবন কাটে মাটি নিয়ে। মাটির প্রতি এটুকু দায়িত্বশীল তাদের হতে হবে। কৃষক বিক্রি না করলে চক্রকে দমন করার কাজটি সহজ হবে। 
জেলা প্রশাসক ফরিদুর রহমান জানান, কৃষিজমি থেকে উপরিভাগের মাটি কাটা বন্ধে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। জেলাজুড়ে অভিযান চালিয়ে ৯টি মামলা দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে অভিযুক্তদের। এ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব শ ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছোট নদী নামে পরিচিত নাগর নদে চাক জাল ও পলো দিয়ে শুরু হয়েছে মাছ ধরার উৎসব। প্রতিবছরের মতো এবারও সিংড়ার ১৫-১৬ গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণে খরসতি, সারদানগর ও নওগাঁর আত্রাই সীমান্তে মঙ্গলবার এ আয়োজন করা হয়। মাছ ধরা শেষে আনন্দ করতে করতেই বড়দের সঙ্গে মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে শিশুরাও।

কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব আগের মতো জাঁকজমক না হলেও গান ও হৈ-হুল্লোড় কোনো কমতি ছিল না। উৎসব দেখতে ভিড়ে করেন উৎসুক জনতা।

মাছ ধরা উৎসবের দলনেতা কাদিরগাছা গ্রামের শাহাদত হোসেন বলেন, সবাই মিলে মাছ ধরতে নেমেছি। কেউ মাছ পেলে তার বাড়িতে
খবর পৌঁছে যাচ্ছে। রবি-বোরো মৌসুমে কৃষকের ধান রোপণ শেষে এই নদে মাছ ধরার উৎসব শুরু হয়। প্রায় মাসব্যাপী এলাকায় এ উৎসব চলে। এ বছর প্রশাসনের তৎপরতায় নদী-নালা, খাল-বিল উন্মুক্ত থাকায় মৎস্য শিকারিদের মুখে হাসি ফুটেছে।

তাজপুর গ্রামের সুনিল কুমার শীল বলেন, পাঁচটি বোয়াল মাছ পেয়েছি। আশা করছি, আরও মাছ ধরতে পারবো। শীতের মধ্যে পানিতে নামা কষ্ট, কিন্তু এখন কোনো কষ্ট মনে হচ্ছে না।

জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র নয়ন বলে, বিদ্যালয় ছুটি থাকায় এলাকার মানুষের সঙ্গে দলবেঁধে মাছ ধরার উৎসবে এসেছি।
মাছ আমাকে ফাঁকি দিতে পারিনি। দুইটা বোয়াল ধরা দিয়েছে চাকে।

চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের তৎপরতায় চলনবিলের নদ-নদী ও খাল-বিল উন্মুক্ত থাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছ ও বিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ দেশীয় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব