“আজও তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি।” মহাদেব সাহা, ‘চিঠি দিও’
“I’ll write to you. A super-long letter, like in an old-fashioned novel.” Haruki Murakami, ‘After Dark’
১.
অফিস থেকে বের হতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার মতো বেজে গেল। বেইলি রোডের ঠাসা ভিড় ঠেলে সিতারার ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছাতে ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর পেরিয়ে গেছে। একদিনের হিসাব করে ঝটপট কিছু কাপড় নিয়ে লাগেজ গুছিয়ে, বারকয়েক টেলিফোনে কথা বলে, রাতের খাবার খেয়ে যখন সে পান্থপথের সোহাগ বাস কাউন্টারে গিয়ে হাজির হলো, তখন বাকিরা সব এসে গেছে। রাত সাড়ে দশটায় বাস ছাড়ার কথা। ঠিক দশটা দশে সে অন্যদের সাথে যোগ দিল। তারা সবাই যশোর যাবে তাদের স্কুলের পুনর্মিলনীর প্রথম কো-অর্ডিনেশন মিটিংয়ে অংশ নিতে। স্কুলের রিইউনিয়ন বা পুনর্মিলনীর অভিজ্ঞতা সিতারার এই প্রথম। যাদের সাথে সে তার ছাত্রজীবন কাটিয়ে এসেছে, কারও সাথেই তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। হাতে গোনা দুয়েকজন হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলে সামান্য হাই-হ্যালো হয়।তার নিজের থেকে অবশ্য সে ধরনের চেষ্টা করা হয়ে ওঠেনি আজ পর্যন্ত।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে সিতারার কোনো দিনই কেউ ছিল না। গড়পড়তা সবার সাথে মিশেছে, স্কুল-কলেজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছে, মাঝে মাঝে দুয়েকজন বন্ধু-বান্ধবী ফোন করলে কথা হয়েছে। বছর শেষে বা নতুন বছরের শুরুতে কখনও কখনও বার্ষিক পিকনিক বা বনভোজনে অংশ নিয়েছে। মাইক্রোবাস ভাড়া করে যশোর পিকনিক স্পট, নড়াইলে শিল্পী সুলতানের বাড়ি, মেহেরপুরের আম্রকাননে যাওয়া হয়েছে। তখন ল্যান্ডফোনের যুগ। বন্ধুদের মধ্যে যাদের বাড়িতে ফোন ছিল, এসব নিয়ে তাদের সাথে ফোনে কথা হতো। বেশির ভাগ আলাপ সেরে নেওয়া হতো স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণে। জীবনটা তখন সহজ ছিল; সরল ছিল এই সময়ের হিসাবে। অবশ্য, যে কোনো বর্তমানের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালে বেশির ভাগ ঘটনাপ্রবাহ মনে হয় রোমান্টিকতায় মোড়ানো অথবা রোমাঞ্চপূর্ণ। যে কোনো রিয়েল টাইম বাস্তবতায় জীবন জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। এসব ভাবনার মাঝখানে সিতারা গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। চালক গাড়ির বুট থেকে তার কেবিন লাগেজটা বের করে হাতে ধরিয়ে দেয়। সিতারা তাকে আগেই বলে রেখেছিল, নামিয়ে দেওয়ার পর বাস ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। অনেকেই উপস্থিত থাকবে। বাসে উঠতে সমস্যা হবে না।
২.
গাড়ি থেকে নামার আগেই সিতারা দেখেছে তার স্কুলের জুনিয়র কয়েকজন ছেলে ফুটপাতের দেয়াল ঘেঁষে এক কোনায় দাঁড়িয়ে গল্পে মশগুল। দুয়েকজনের হাতে আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি। স্কুল বয়সের নিষ্পাপ চেহারার খোলস ঝেড়ে ফেলে এরা এখন একেকজন সম্পূর্ণ ব্যাটা মানুষ হয়ে উঠেছে। সবাই বিবাহিত, সংসারী পুরুষ, একাধিক সন্তানের পিতা। কারও কারও জীবনে আছে অনিবার্য সাংসারিক জটিলতা। রিইউনিয়ন আয়োজন নিয়ে তাদের অনেকে ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও বাস্তবতা থেকে কারও মুক্তি নেই।
বহুদিন বাদে যশোর ভ্রমণের উপলক্ষ তৈরি হওয়ায় সিতারার ভাবুক মন এ রকম সম্ভব-অসম্ভব নানা দৃশ্যকল্পের জাল বুনতে শুরু করেছে। তার উড়ে চলা মন আরও খানিকটা পেছনে সরে গিয়ে আরও কিছু ভাবছে, ভাবতে চাইছে কোনো এক বিশেষ জনকে নিয়ে যার সাথে আজ তার যোজন যোজন বিরহের ব্যবধান।
দূর অতীতের ধ্বংসস্তূপের ভেতর এলোমেলো দাঁড়ানো এক স্মৃতির ইমারত। সেই ইমারতের লম্বা করিডোরের ব্যালাস্ট্রেডে লম্বা শরীরটা ঝুলিয়ে দিয়ে সে কি আজও অপেক্ষা করে আছে তার জন্য যে একদিন সিতারাকে অনেক কথার ফাঁকে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের গল্প শুনিয়েছিল? না, তা হওয়ার নয়। এসব অপেক্ষার গল্প কেবল সাররিয়েল প্রেক্ষাপটে মানায়। পাশ কেটে চলে যায় দ্রুতগতির এক গাড়ি। সেটির বিকট হর্নের শব্দে সিতারার কল্পনার জাল ছিঁড়ে পড়ে। কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে চোখ বড় করে সে সামনে তাকিয়ে আরও দুইজনকে দেখতে পায়। যে দলটা আজ যশোর যাবে, তাদের মধ্যে সিতারা ছাড়া আরও দুইজন মেয়ে আছে। সেই নীলা আর সিলভিয়া হাসিমুখে রাস্তার ওপাশে কাউন্টারের ওয়েটিং রুমের সামনে দাঁড়ানো। দুজনেই সিতারার জুনিয়র ক্লাসের। একমাত্র সিনিয়র আপা হিসেবে সিতারা তাদের সাথে ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছে অনেক অনুরোধের পর।
৩.
সবাই মিলে পুনর্মিলনী আয়োজন কমিটির সভাপতি বানিয়ে দিয়েছে সিতারাকে। তার তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও। মেসেঞ্জার গ্রুপের মিটিংয়ে বিভিন্ন কমিটির সদস্যরা একবাক্যে তাকে সভাপতি ঘোষণা করে দেওয়ার পর তার ওজর-আপত্তি আর কোনো কাজে আসেনি। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, এ রকম একটি অরাজনৈতিক বিষয়েও কিছু বিরোধী পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে।
সিতারা ভীষণ অস্বস্তি আর দ্বিধা নিয়ে আরও একবার নতুন করে আবিষ্কার করল যে, আপ ভালো তো জগৎ ভালো, কথাটা সব সময়ের জন্য যথার্থ নয়। তার সাদামাটা চিন্তা আর নিপাট ভালোমানুষি কারও কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। রিইউনিয়ন কমিটি এবং এর সাথের অন্যান্য সাব-কমিটির সভাপতি বা সচিব পদ পাওয়া যে ভীষণ লোভনীয় বা সম্মানজনক একটা ব্যাপার হতে পারে, কিছু জুনিয়র ছেলেমেয়ের অসৎ আর বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ না দেখলে সিতারা বিশ্বাস করতে পারত না। ফেসবুক ওয়াল আর মেসেঞ্জারের ইনবক্স তাদের গরলঘৃণামিশ্রিত পোস্ট আর কাদা ছোড়াছুড়ির মন্তব্যে রীতিমতো নোংরা ভাগাড়ে পরিণত হলো। এসব দেখে সিতারার অবস্থা দাঁড়াল ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
জুনিয়রদের কাছ থেকে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে সিতারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। সে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে খানিকটা সময় নিল। প্রথমে বিরোধী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া কয়েকজনকে আন্তরিক ভঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, একটি চমৎকার রিইউনিয়ন আয়োজনের জন্য সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণটাই মুখ্য। এখানে সভাপতি বা সচিব হওয়া কেবল এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা। কে বোঝে কার কথা। সিতারা একবার হাল ছেড়ে দিয়ে বাকিদের পরিষ্কার জানিয়ে দিল, সে এসব ঝামেলার মধ্যে থাকতে চায় না। যাদের সভাপতি হওয়ার ইচ্ছা তাদের সাথে থেকে সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে। ইত্যাদি। এখানেও সেই কে শোনে কার কথা। রিইউনিয়নের মূল পরিকল্পনাকারীদের একটাই কথা, সভাপতি হিসেবে তাদের সিতারা আপাকেই প্রয়োজন। অনেক চিন্তাভাবনা আর আলোচনার পর সিতারা আবার তাদের কথায় রাজি হলো। তার ভেতরে একটা তীব্র জেদ এসেও ভর করল। যে কয়েকজন রিইউনিয়ন আয়োজন ভন্ডুল করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছিল, তাদের মুখ বন্ধ করার জন্যই সেও চুপচাপ আয়োজনের পুরো প্রস্তুতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। এরই ধারাবাহিকতায় এবার এই যশোর মিটিং: রিইউনিয়ন আয়োজনে ঢাকার বাইরে প্রথম সরাসরি মিটিং। যেহেতু যশোরে তাদের স্কুল প্রাঙ্গণটাই রিইউনিয়নের ভেন্যু, যশোরে বাস করা স্কুলের অনেক পুরোনো ছাত্রছাত্রী এই মিটিংয়ে সশরীরে হাজির হবে। মেসেঞ্জার গ্রুপে কেউ কেউ লিখেছে, শুধু সিতারা আপাকে স্বচক্ষে দেখতেই তারা এসে ভিড় করবে। এতদিন শুধু তার কথা বিভিন্ন জনের মুখে শুনেছে; স্ক্রিনে তার চেহারা দেখেছে। এবার তারা সরাসরি তাকে দেখতে উৎসুক। তাদের এমন ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখানোও সিতারার এই যশোর ভ্রমণে অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আর আছে, ভীষণভাবে আছে অব্যক্ত, অনুক্ত অজস্র স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকা ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের গল্পকার!
৪.
তুমুল উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা আর আগ্রহ নিয়ে ঢাকার দলটা বাসে উঠে পড়ল। সব মিলিয়ে তারা বারোজন। সব সময়ের রসিক কামাল চোখ টিপে বলল, ভালোই হলো, একেবারে ডারটি ডজন। সিতারার সস্নেহ চোখ রাঙানিতে জিবে কামড় কেটে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করলে অন্যরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
সভাপতি হিসেবে সিতারার দিকে বাকিদের একটু আলাদা, বাড়তি নজর। যদিও সিতারা বলেছে, এসব নিয়ে তাদের একদম ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই। অনেক বছর পর যশোর যাচ্ছে সে। যে শহরে সে ফেলে এসেছে তার উঠতি জীবনের আঠারো বছর, স্বর্ণালি অতীত, প্রথম প্রেম আর এ রকম অনেক প্রথম কিছুর ভালো-মন্দ স্মৃতি। যশোর যেন তার সোনালি শৈশব-কৈশোর আর তারুণ্যের অসংখ্য স্মৃতি জড়ানো যক্ষের ধন!
রাতের ঘুম যতক্ষণ না এসে চোখের পাতায় আসন পেতে নেয়, নিজের সিটে বসে সিতারা সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের কুয়োর মাঝে ডুব দিতে চায় আপনমনে। কিছু কি খুঁজে আনতে পারবে সে সেখান থেকে, সেই অতল গহ্বরের একবুক হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস আর আফসোস ছাড়া? তবু আরেকবার যশোরে ফিরে যাওয়ার আনন্দে সে ডুবুরি হয়ে সেচে তুলতে চায় কিছু মুক্তাসম সুখস্মৃতি।
আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ দ্যাট টেল অব স্যাডেস্ট থট। শেলির ‘টু স্কাইলারক’ কবিতা থেকে তাকে পড়ে শুনিয়েছিল সিতারা। সে ঠোঁট উল্টে বলেছিল, তাদের জীবনে অমন সুমধুর করুণ সংগীতের দরকার নেই। সারাজীবন দুজন হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতে পারলেই সে খুশি। এভাবে হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে যদি তারা হেঁটে যেতে পারে অক্লান্ত, অবিরাম! এভাবে হেঁটে হেঁটে যদি ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়!
এভাবেই কবিতার সুরে কথা বলত সে। ভাবত, গোটা পৃথিবীটাই একটা বড় কবিতা। সে আর সিতারা কখনও কবি, কখনও শ্রোতা! বাই টার্ন। এর বিপরীতে যে একটা ভাত-ডাল-নুন-পান্তার ক্ষুধার রাজ্য আছে– যেখানে পৃথিবী গদ্যময়, এসব আটপৌরে দৈনন্দিন জীবনযাপনের কথা তার মাথায় ঢুকত না। ছিল নিত্যদিনের আদুরে আবদার: পত্র দিও। দেখা হলেও পত্র দিও, না হলেও পত্র দিও। তবু দিও। বলত সে করুণ ছলছল চোখে। সিতারার হাসি সামলানো কঠিন হতো। মাঝে মাঝে বিরক্তির চূড়ান্ত। তারপর বাড়ি ফেরার পথে কানের কাছে মুখ রেখে ওই এক ঘ্যানঘ্যানানি, পত্র দিও।
এবার কি দেখা হবে তার সাথে? এত বছর পর, যখন সিতারার নতুন ঠিকানার কথা তার হয়তো জানা নেই, দেখা হলেও কি সেই আগের মতোই পত্র চেয়ে বসবে? পনেরো বছর যার কথা সে একবারও মনে করেনি, সিতারার হঠাৎ উপস্থিতি কি সব পুরোনো হিসাব পাল্টে আগের মতো কাব্যময় করে দিতে পারবে?
৫.
মাঝে একবার একদিনের জন্য এখানে, যশোরে নেমেছিল সিতারা। অফিসের কাজে ঢাকা থেকে প্লেনে সরাসরি যশোর। তারপর বাসে খুলনা। শহরের মাঝখানে ঢোকার সুযোগ হয়নি। তখনও ভেবেছিল, একবার যাই ঘুরে আসি সেই পুরোনো আবাসিক এলাকায়, যেখানে সে থাকে। যেখানে তার থাকার কথা।
পনেরো বছর পর সে কি এখনও আছে হলুদ রঙের সেই দোতলা বাসাটায়? ওদের নিজেদের বাড়ি ছিল ওটা। নিশ্চয় আছে। সে না থাকুক, তার সেই বদমেজাজি স্বভাবের মা আর অহংকারী ছোট বোনটা থাকলেও থাকতে পারে।
সায়মন, সিতারার প্রথম প্রেমিক। হাই স্কুলে পড়ার সময় পরিচয়। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এক বছর। তারপর সব শেষ। শেষ কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত? তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়, আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়। আরতি মুখার্জির গানের কথাগুলো তাদের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল।
৬.
এবার যখন যশোর আসার কথা ঠিক হলো, প্রথম থেকেই সিতারার মনে সায়মনের কথা এসে ঘুরঘুর করছে। এবার কি যাবে সে দেখা করতে? এত বছর পরে দেখা করে আসলে কী হবে? সায়মন তো একবারও আর কোনো রকম যোগাযোগ করেনি। করেনি মানে আর সাহস পায়নি। শেষের দিকে ভীষণ অপমান করেছিল সিতারাকে। আসলে সে অন্য কোনো দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তার আরেক বান্ধবী বিপাশার দিকে। অনেক টাকাপয়সা ছিল ওদের। সেটাই হয়তো আকর্ষণের কারণ। সিতারা একজন সীমিত আয়ের সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে। সায়মনদের পরিবারের চাহিদা মেটাতে বিপাশাদের মতো পরিবারই উপযুক্ত। কিছু কিছু কথা সিতারার কানে এসেছে।
সব মিলিয়ে কেটে যাওয়া সুরটা আর মিলছিল না। একদিন ভালো যায় তো দু’দিন কথা বন্ধ। সিতারা শত চেষ্টাতেও সায়মনের মনকে আর তার দিকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। সেই সায়মন, কবিতার সুরে ছন্দে যে একদিন সিতারার সাথে জীবন কাটাতে চেয়েছিল, পরিবারের দাবির কাছে মাথা নত করে সে একদিন সরে গেল।
অমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অপমানিত হওয়ার পরও সিতারা সায়মনকে সবটুকু মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। প্রায় তার কথা ভেবেছে সে, ভাবে সে। মনটাকে যখন যুক্তি দিয়ে বোঝাতে ব্যর্থ হয়, তখন সায়মনকে উদ্দেশ করে লিখতে থাকে কয়েক পাতার চিঠি। আগে যেমনটা লিখত। চিঠিগুলো সে জমিয়ে রেখেছে জার্নালের একেকটা এন্ট্রির মতো করে। একেকটা এন্ট্রি একেকটা সম্পূর্ণ কবিতা!
এবার কী মনে করে চিঠিগুলো সাথে করে নিয়ে এসেছে। কাপড় গুছিয়ে নেওয়ার সময় তার লাগেজের একেবারে নিচে একটা বড় এ ফোর সাইজের বাদামি রঙের খামে ভরে চিঠিগুলো নিয়েছে সে। কেন কে জানে!
৭.
সিতারাদের বাসটা যখন যশোর বাসস্ট্যান্ডে এসে থামে, তখন ভোরের আলো চারদিকে ফুটতে শুরু করেছে। দুয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই চলন্ত বাসের ভেতরেও রাতের ঘুম সেরে নিয়েছে। দুয়েকজনের একজন সিতারা। সারারাত বলতে গেলে চোখের পাতা চেপে ধরেও নিদ্রা দেবীর মন গলাতে পারেনি।
ঝিম ধরা মাথা নিয়ে সিতারা অন্যদের সাথে বাস থেকে নেমে পড়ে। তার জন্য স্কুলের বন্ধু কামাল এসেছে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে। তার বাসায় নিয়ে যাবে বলে। বাকিদের বেশির ভাগ বিভিন্ন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠবে। কারও কারও নিজস্ব ঠিকানা আছে। সকালের নাশতা আর কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের পর সবাই স্কুলের অডিটোরিয়ামে গিয়ে জড়ো হবে। অনেক দিন পর কামালের সাথে সামনাসামনি দেখা। কামালকে দেখেই কি আবার তার কথা মনে পড়ে গেল সিতারার? যার কথা ভাবতে ভাবতে এলো এতটা পথ। স্কুলের লাজুক চেহারার সেই কামালকে এখন আর চেনা যায় না। মুখভর্তি দাড়ি। দুই সন্তানের পিতা, দায়িত্বশীল স্বামী। মুখের মিষ্টি হাসিটাই যা অটুট আছে আগের মতো।
“অনেক কষ্ট হয়ে গেল, না?” গাড়িতে চালকের আসনে বসে কামালের জিজ্ঞাসা।
“ঘুম হলো না একদম। আবার দুই জায়গায় চাকা নষ্ট হয়ে গেল।” চোখ বন্ধ করে সিতারার সংক্ষিপ্ত জবাব।
“বুঝতে পারছি। বাসায় গিয়ে নাশতা করো, রেস্ট নাও। ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের মিটিং তো দুপুর বেলায়।”
“হুম্ম।”
পরিচিত রাস্তাগুলো এখন অচেনা লাগে। নতুন গড়ে ওঠা বাড়িঘর, দোকানপাটের ভিড়ে পুরোনো শহরটা অপরিচিত মনে হয়। নাকি পনেরো বছরের ব্যবধানে সে নিজেই এখন চিরচেনা শহরে আগন্তুক?
হঠাৎ কামালের কথায় সিতারার ঘোর কেটে যায়।
“চাচা তো মারা গেছে!”
“কোন চাচা?” জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে সিতারার কথা আটকে আসে।
সায়মনকে কামাল চাচা বলে ডাকত। কামালের বাবার দিক থেকে আত্মীয় ছিল ওরা। তাদের সেই প্রেমের দিনগুলিতে মাঝে মাঝে কামালের মাধ্যমেও যোগাযোগ হতো সায়মনের সাথে।
গলার মধ্যে কেমন একটা অনুভব। সিতারা কিছুটা সময় নিয়ে আবার জানতে চায়। “কবে?”
“বছরখানেক হবে।”
এ রকম আরও কিছু নিরাসক্ত প্রশ্ন-উত্তরের মধ্য দিয়ে কামালের গাড়িটা সামনের দিকে এগোতে থাকে। সিতারার মনে এখন আর কোনো ভাবনা কাজ করছে না। হঠাৎ রাস্তার বাম পাশে শহরের বড় কবরস্থানটা চোখে পড়ে। সায়মন কি এখানেই কোথাও শুয়ে আছে?
সাথে করে আনা এতদিন ধরে লেখা চিঠিগুলো, পত্রগুলো তাহলে আর প্রাপকের কাছে পৌঁছাবে না শেষ পর্যন্ত।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ইউন য ন বছর পর র জন য প রথম স য়মন একদ ন য় কজন একব র এ রকম ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
মতপার্থক্য থাকবে, ঐক্যের জায়গা চিহ্নিত করতে হবে: আলী রিয়াজ
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেছেন, ‘সমাজে মতপার্থক্য থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। কিন্তু সহিষ্ণুতা থাকতে হবে। ঐক্যের জায়গাটা চিহ্নিত করতে হবে।’ গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক প্রকাশনা উৎসবে তিনি এসব কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ খান রচিত ‘বাংলাদেশের স্বপ্ন ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান’ গ্রন্থের প্রকাশনায় আলী রিয়াজ বলেন, সবার মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে হবে যাতে এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এজন্য এমন একটা রাজনৈতিক ঐকমত্যের কাঠামোতে আসতে হবে, রাষ্ট্র তার নাগরিকের সঙ্গে একটি চুক্তি করবে। ফলে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হবে, তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। রাষ্ট্র জবাবদিহির মধ্যে চলবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন কথা বলতে পারে, কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে পার্থক্য থাকবেই। দেখতে হবে ঐক্যের জায়গাটা কোথায়। ঐক্যের জায়গাটা চিহ্নিত করতে হবে। সেই সনদ তৈরি করতে হবে যা আসলে সামাজিক চুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হবে, যেটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য দিকনির্দেশনা দেবে। এটিই হবে বাংলাদেশের সনদ।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষ চায় নিরাপত্তা, ভোটের অধিকার এবং সরকার যেন তাকে না জানিয়ে যা খুশি তা করতে না পারে। মতপার্থক্যকে শত্রুভাবাপন্ন ভাবলে হবে না।
প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ‘আজকেও যারা গৃহযুদ্ধের ভয় দেখাচ্ছে, সেটি আমার কাছে অমূলক মনে হয়। গৃহযুদ্ধ হতে হলে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত একটা দেশ লাগে।’
প্রকাশনা উৎসবে সভাপতিত্ব করেন আহমদ পাবলিশিং হাউসের প্রকাশক মেছবাহ উদ্দিন আহমদ। চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক আদিত্য শাহীনের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আব্দুল্লাহ, আমেরিকা বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের কো-চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান হাসান ও নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম প্রমুখ।