দেশজ ঐতিহ্যবাহী মেলায় শিশুদের খেলনাসামগ্রীর মাঝে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কম দামে যা পাওয়া যায়, সেটি হলো মাটির তৈরি বিভিন্ন প্রাণী। এসব প্রাণীর মধ্যে সব থেকে নজরকাড়া প্রাণী হলো ঘোড়া। যান্ত্রিক মোড়কের ঢাকা শহরে সেই মাটির তৈরি ঘোড়ার স্থানে দেখা মিলল পিতলের তৈরি দেশি কলকি ও ফুলের নকশাকাটা ঘোড়ার। ফারহানা তাসনীম মীমের তৈরি করা ‘লাবণ্য পার্বণ’ শিরোনামের এই ঘোড়া একই সাথে আমাদের ঐতিহ্য ও যান্ত্রিকতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ রকম তামা, লোহাসহ বিভিন্ন কঠিন বস্তুতে এত নান্দনিক ও মানবজীবনের কোমলতা, আবেগ– সব যেন এক ছাদের নিচে এসে জড়ো হয়েছে ষষ্ঠ জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী ২০২৪-এ। ১৯৩টি বিভিন্ন মাধ্যমে তৈরি ভাস্কর্য নিয়ে গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪-এ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীতে আরও স্থান পেয়েছে আমন্ত্রিত ১১ জন শিল্পীর ভাস্কর্য এবং সম্পূর্ণ প্রদর্শনীতে তিনজন ভাস্করের কাজ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসেবে সেরা কাজের পুরস্কার পেয়েছে। যাদের কাজ সম্পূর্ণ প্রদর্শনীতে সেরা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে, তারা হলেন– ড.
বিভিন্ন বয়সী শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমে তৈরি এই ভাস্কর্যগুলোই বলে দেয় একজন শিল্পীর চিন্তা একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাঝেও কীভাবে শিল্পের কোমলতা খুঁজে পায়। এর আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ গ্যালারিতে থাকা একটি অসম্পূর্ণ কুঁড়েঘর, ভাঙা চেয়ার ও টুল। মরচে ধরা টিন, লোহা ও বিভিন্ন ধাতব বস্তু দিয়ে নির্মিত এই অসম্পূর্ণ কুঁড়েঘর দেখলে যেমন আমাদের গ্রামবাংলার কুঁড়েঘরের কথা মনে আসে, ঠিক তেমনি মনে হয় আমাদের চিন্তার জায়গায়ও তার বাস্তবিক রূপ অধিকাংশ সময়ই আংশিক বা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। কিন্তু এটা ভাবার সময়ের আনন্দের রেশ রয়েই যায় আমাদের মাঝে। এই ‘স্মর্তব্য’ শিরোনামের কাজটি দেখে তাই মনে হচ্ছে বলে জানান প্রদর্শনী দেখতে আসা তরুণ হাসিবুল ইসলাম। এই স্মর্তব্য কাজটি তৈরি করেছেন ইসরাত জাহান ইভা। এ ছাড়া এই একই শিল্পীর লোহা জোড়া দিয়ে তৈরি করা নারী জীবনের সব থেকে আনন্দের মুহূর্ত মাতৃত্বকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটি গাছের আকৃতি দিয়ে। যেখানে প্রকৃতি ও নারী মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে। এ রকম মানবিক গুণাবলি ও প্রকৃতির বিভিন্ন দিক এবারের প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে।
এ ছাড়া মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঁশের তৈরি ছোট ছোট কাঠি দিয়ে প্রমাণাকৃতির ২১ শতকের ডেভিড নির্মাণ করেছেন শিল্পী এস এম মিজানুর রহমান। এই ডেভিডের মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলালে একটির সঙ্গে একটি বাঁশের কাঠির জোড়া যেন মনে করিয়ে দেয় মানুষ কীভাবে পুরো জীবনটা এক অংশের সঙ্গে আরেক অংশ জোড়া দিয়ে দিনাতিপাত করার মাধ্যমে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় অল্প অল্প করে। প্রদর্শনীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসফিকুর রহমান, যিনি এ প্রদর্শনীতে সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মিক্সড মিডিয়ায় লাল কালো রঙের মিশেলে তৈরি করা কাজ অ্যাসপেক্ট অব টাইমের ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছু ঘটে; যার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা সহসাই মেলে না। যা কিছুটা রহস্যে ঘেরা, বিভ্রান্তিকর, যদিও তা প্রায় সত্যের মতোই উপস্থিত হয় সে মুহূর্তে। সব মিলিয়ে একটা বিভ্রম জাগানো পরিস্থিতির অবতারণা হয়। যা আমরা দেখে, শুনে ও বোঝার মাধ্যমে অনুভব করি। তাৎক্ষণিক এই প্রতিক্রিয়াটি ঘটে আমাদেরই পূর্বধারণা, জ্ঞান ও পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। বিপরীতে এ ধরনের ভাবনার মধ্য দিয়ে কিছু অধিজাগতিক অভিজ্ঞতাও অর্জন করি যেন আমরা; যা বাস্তবিক অভিজ্ঞতার চেয়ে ভিন্ন। বিপরীতের মধ্য দিয়েই যেন তৈরি হয় নতুন সম্ভাবনাও। বিভ্রমের এই প্যারাডক্সিক্যাল বাস্তবতার আড়ালেই হয়তো ভিন্ন কিছু লুকিয়ে আছে; যা গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব। সেই অসম্ভবের জায়গাটিই আমার কাজের মধ্য দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
ভাস্কর্য প্রদর্শনী ঘিরে নিজের আশা ও আক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রান্তিক শিল্পীদের কাজগুলো যেন আমরা দেখতে ও জানতে পারি সব সময়। সেজন্য এ ধরনের প্রদর্শনী শুধু ভাস্কর্য বিষয়ভিত্তিকই নয়, চারুকলার সব ক্ষেত্রের কাজগুলো বিভাগীয় পর্যায়ে প্রদর্শিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। প্রান্তিক শিল্পীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিশালাকৃতির শিল্পকর্ম বহন করে ঢাকায় নিয়ে আসা ব্যয়সাধ্য হওয়ার কারণেও অনেকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক, ছাত্রদের কাজ ছাড়া এ আয়োজনগুলো দেশব্যাপী প্রান্তিক শিল্পীদের নিয়েও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ১১ জন ভাস্করের কাজও একটি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– হামিদুজ্জামান খানের ‘শিরোনামহীন’, মোস্তফা শরীফ আনোয়ারের ‘চা শ্রমিক’, রেজাউজ্জামান রেজার ‘অভ্যুত্থান’সহ আরও বেশ কিছু কাজ। মাসব্যাপী এই প্রদর্শনী শেষ হয় ২০ জানুয়ারি। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭% শুল্ক আরোপ করল যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন, যাকে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে অনেক দেশ। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল।
বাংলাদেশের প্রধান দুই রপ্তানি বাজারের একটি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশ রপ্তানি হয় দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) ডলার, যা প্রধানত তৈরি পোশাক। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তান ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (৭৩৪ কোটি) ডলারে।
নতুন করে উচ্চ মাত্রায় এই শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ২টা) হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে উপস্থিত সাংবাদিকসহ সমবেতদের উদ্দেশে বক্তব্যের শুরুতেই ট্রাম্প বলেন, ‘আজ খুব ভালো খবর’ থাকবে। এ সময় দর্শক সারি থেকে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
এই দিনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস’ অভিহিত করেন ট্রাম্প। নতুন শুল্ক আরোপকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, এই দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ দিন ধরে অপেক্ষা করছে।
ট্রাম্পের পাল্টা এই শুল্ক আরোপে ভারতের পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পাকিস্তানের পণ্যের ওপর ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ৩৪ শতাংশ।
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার পণ্যে ৪৪ শতাংশ, তাইওয়ানের পণ্যে ৩২ শতাংশ, জাপানের পণ্যে ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের পণ্যে ৩৬ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডের পণ্যে ৩১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ৩২ শতাংশ, মালয়েশিয়ার পণ্যে ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়ার পণ্যে ৪৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের পণ্যে ১০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্যে ৩০ শতাংশ, ব্রাজিলের পণ্যে ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের পণ্যে ১০ শতাংশ, ইসরায়েলের পণ্যে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনের পণ্যে ১৭ শতাংশ, চিলির পণ্যে ১০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্কের পণ্যে ১০ শতাংশ, কলম্বিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে।
অন্যান্য যেসব দেশের পণ্যের ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের পণ্যে ৪৪ শতাংশ, লাওসের পণ্যে ৪৮ শতাংশ এবং মাদাগাস্কারের পণ্যের ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
পাল্টা এই শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে থাকা ট্রাম্প বলেছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ‘বন্ধু শত্রুর চেয়ে খারাপ হয়’।
যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের বিদেশি গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় যেসব গাড়ি উৎপাদন করা হয় তার ৮০ শতাংশের বেশি সেদেশে বিক্রি হয়। আর জাপানে যেসব গাড়ি বিক্রি হয় সেগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি সেদেশে তৈরি হয়। এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি বিক্রি হয় খুব সামান্য।
মার্কিন কোম্পানি ফোর্ড অন্যান্য দেশে খুব কম গাড়ি বিক্রি করে উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, অন্য যে কোনো দেশে তৈরি মোটরযানের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে এবং এটা আজ মধ্যরাত থেকেই কার্যকর হবে।
শুল্ক আরোপের ঘোষণাকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিফলন উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, আজকের দিনকে আমেরিকান শিল্পের ‘পুনর্জন্ম’ এবং আমেরিকাকে ‘আবার সম্পদশালী’ করার দিন হিসেবে স্মরণ করা হবে।
এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য বাধার মুখে রয়েছে।
অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা আরও খারাপ অবস্থা তৈরি করেছে।
বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মেধাসত্ত চুরিসহ অন্যান্য বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগ করেছেন তিনি।