প্রচুর শব্দ– ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিস্ফোরণ, ড্রোনের শব্দ, আর্তনাদ, “শহীদ, শহীদ” বলে চিৎকার। কাচ ভাঙার শব্দ, দরজা বন্ধ করার শব্দ, ভবন ভেঙে পড়া, আগুনের জ্বলন্ত শিখা, বজ্রপাত, বৃষ্টি, বাতাস, মৃত্যুর শ্বাস, অন্ধকার এবং ছাই। এই সবকিছু এখনও আমার মাথায় রয়ে গেছে।
প্রায় এক বছর আগে গাজা ছেড়েছি, কিন্তু এইসব দৃশ্য এবং শব্দ এখনও আমাকে তাড়া করছে। আমি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি– একান্নবর্তী পরিবার, আমার বাড়ি এবং বন্ধুদের– কিন্তু যুদ্ধের প্রতিধ্বনি ছেড়ে যায়নি।
এখানে, কায়রোতে, গাজায় প্রথম চার মাসের যুদ্ধে যা দেখেছিলাম, যা শুনেছিলাম এবং যা উপলব্ধি করেছিলাম, সেই মানসিক আঘাতই  বারেবার অনুভব করি।
এখনও যখন উড়োজাহাজের শব্দ শুনি, ভয়ে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে, মনে হয় যুদ্ধবিমান। যখন আতশবাজির শব্দ শুনি, আতঙ্কিত হয়ে উঠি, ভাবি– বিস্ফোরণের শব্দ। আমি ভেবেছিলাম নির্বাসন নিরাপত্তা এবং শান্তি আনবে। অথচ দেখা গেল তা যুদ্ধের আরও একটি পরিবর্ধিত রূপ।
গাজায় যে মৃত্যু এবং ধ্বংস ঘটেছে, তা এখনও আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই দুঃখ, যন্ত্রণা এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম; যা আমরা ভেবেছিলাম পেছনে ফেলে এসেছি, তা আজও আমাদের অনুসরণ করছে।
আমরা বৃষ্টিতে ভেজা তাঁবুর মধ্যে থাকি না কিংবা অভুক্ত নই; বোমার শব্দও সত্যি নয়– জানি, এগুলো কেবলই আমাদের মনের স্মৃতির প্রতিধ্বনি। তবুও আমরা এখনও যন্ত্রণায় রয়েছি।
আমার বাবা, আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, যিনি মাসের পর মাস চাকরি খুঁজে পাননি। যখন পেয়েছিলেন, তখন সেই কাজের বেতন ছিল অতি সামান্য। আমাদের ঋণের পর ঋণ বেড়েই চলছিল আর তাই আমরা মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছিলাম না।
এদিকে পুরোপুরি ডুবে আছি গাজার ভয়াবহতায়। সেই বোমা হামলা, গণহত্যা, ছিন্নভিন্ন তাঁবুর দুর্ভোগ– এইসব আমাদের কাছে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে আসছে মেসেজিং অ্যাপসের মাধ্যমে।
এখানে দেখা যাচ্ছে, আমার সব ফিলিস্তিনি বন্ধুর একই অবস্থা– তারা যুদ্ধে অবরুদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় এবং হতাশায় জীবনযাপন করছে।
“আমি বেঁচে না থেকে তাদের সঙ্গে মরে যেতে চেয়েছিলাম।” আমার বন্ধু দুআ আমাকে সম্প্রতি বলেছিল, তার পরিবার জেনোসাইড শুরু হওয়ার পরপরই তাকে কায়রোতে শান্তিতে পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পাঠিয়েছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেছিল, “যখন তাদের বিদায় জানালাম, আমার মনে হয়েছিল, তাদের আমি আর দেখব না।”
মিসরে পৌঁছে সে ভেবেছিল, জীবন তাকে বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য একটি ভালো সুযোগ দিয়েছে। কিছুদিন পর সে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, তাদের খোঁজ নেওয়ার জন্য, কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। আর তাই অস্বস্তি তাকে গ্রাস করে রেখেছিল, তার পরিবারের শহীদ হওয়ার বিধ্বংসী খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত।
এ ব্যথা অসহনীয় ছিল আর তাই সে তার পড়াশোনায় ব্যর্থ হয়।  আজও সে তার অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে এবং আমাকে বলেছিল, তার বাড়িওয়ালা শিগগিরই ভাড়া দিতে না পারার কারণে তাকে উচ্ছেদ করবে। সে অনাথ, নির্বাসনে একা, আর শিগগিরই হয়তো গৃহহীনও হয়ে পড়বে।
আরেকজন বন্ধু, রাওয়ান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে মিসরে কয়েক বছর ধরে পড়াশোনা করছিল। ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর, একটি বিশাল বিস্ফোরণে তার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়, পুরো পরিবার মারা যায়। শুধু তার মা গুরুতর আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। আর তার বিবাহিত বোন, যিনি অন্য একটি বাড়িতে ছিলেন এবং বেঁচে আছেন।
রাওয়ান আমাকে বলেছিল, তার বাবার উৎসাহজনক বার্তা, ভাই মহম্মদ ও মাহমুদের সমর্থন এবং বোন রুবার নিষ্পাপ হাসি আজও তার মনে পড়ে। সে কখনোই তার পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। এখন সে যেন তার নিজেরই ছায়া হয়ে গেছে। নাদা আমার আরেক বন্ধু, তার বোনের সাথে কায়রোতে আছে। সেই মেয়েগুলো তাদের বাবা-মা এবং ভাইকে গাজার পেছনে রেখে চলে এসেছিল। কেননা, রাফা ক্রসিংয়ে যেতে তাদের নাম অনুমোদিতের তালিকায় ছিল না।
কায়রোতে নাদা একাকী, দিশেহারা এবং ভীত হয়ে পড়েছিল। তাই সে  চেষ্টা করছিল তার বাবা-মা এবং ভাইয়ের স্থানান্তরের আবেদন করতে, কিন্তু তখনই দখলদার রাফাতে আক্রমণ চালায় এবং ক্রসিংটি বন্ধ করে দেয়। তখন সে আমাকে বলেছিল তার অনুভূতির কথা, যেন জীবনের সবক’টি দরজা তার মুখের সামনেই বন্ধ হয়ে গেছে।
আত্মীয়দের কোনো সহায়তা ছাড়াই নাদা আর তার বোন একা থাকছে এবং সংগ্রাম করে চলেছে। মানসিক চাপ, যন্ত্রণা তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এখন সে অনেকখানি ওজন হারিয়েছে এবং তার মতে তাকে কঙ্কালের মতো দেখায়!
সে আমাকে আরও বলেছে হয়রানি এবং অপহরণের ভয়ে যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকছে সেখান থেকে বাইরে যেতে তারা ইচ্ছুক নয়।
“আমরা আমাদের ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত ফিরে পেতে চাই।” সে বলেছে।
আমরাও চাই, তবে আমরা এটাও জানি যে আমাদের ফেলে আসা জীবনের সবকিছুই হারিয়ে গেছে। এমনকি যুদ্ধ শেষ হলেও কিছুই আগের মতো হবে না। আমাদের সেই অপূরণীয় ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণও মিলবে না।
যুদ্ধবিরতি আজ কার্যকর হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। বুধবার যখন এটা ঘোষণা হয়েছে, তারপর থেকে ১২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আমরা জানি আরও মানুষ মারা যাবে তবু পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কেননা, গাজা এখন আর বসবাসের উপযুক্ত নয়।
যুদ্ধবিরতির পর যদি শান্তি স্থাপিত হয়ও, তবু ইসরায়েলি সরকার তাদের নিজস্ব শর্তে অবরোধ এবং জনগণের হয়রানি চালিয়ে যাবে। পুনর্গঠন– যদি কখনও শুরু হয়– বহু বছর ধরে চলবে। এজন্যই আমরা, একটি পরিবার হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে নির্বাসনে নতুন জীবন শুরু করব, সম্মুখে যতই সমস্যা আসুক। 

রিম স্লিম, ফিলিস্তিনি লেখক, বর্তমানে মিসরে আশ্রয় নিয়েছেন
সূত্র: আলজাজিরা

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র পর ব র ত র পর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বিজিএমইএ নির্বাচনে ৬৯০ ভুয়া ভোটার

তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ আগামী ১ জুন। এ জন্য নির্বাচন পরিচালনা ও আপিল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। চলছে ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। ইতোমধ্যে ৬৯০ ভুয়া ভোটার শনাক্ত করে তাদের ভোটাধিকার বাতিল করা হয়েছে। সূত্র জানায়, বিজিএমইএর মেম্বারশিপ ফাইল অডিট এবং ভেরিফিকেশনে ভুয়া ভোটার শনাক্ত হয়। ভুয়া শনাক্ত সদস্যদের মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে ৫৮২ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১০৮ জন। এখন প্রকৃত ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০৬।
গত নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৯৬। পর্যালোচনার কাজ এখনও শেষ হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য গত ২৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছেন বিজিএমইএর ১০ সদস্য। এতে ১৪ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রশাসকের নিয়োগ করা হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং অডিট ফার্মের বিজিএমইএর মেম্বারশিপ ফাইল অডিট ও ভেরিফিকেশন কার্যক্রম স্থগিত করা এবং বিজিএমইএর সদস্যপদ নবায়নের নতুন নিয়মের স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়। রিটটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যেই ভুয়া ভোটার শনাক্ত করার কাজটি হয়েছে।

দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিজিএমইএ নির্বাচনে দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে। একটি সম্মিলিত পরিষদ এবং অপরটি ফোরাম। দল নিরপেক্ষ বলা হলেও গত ১৬ বছর সম্মিলিত পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য ছিল। কিছুটা আওয়ামীবিরোধী শিবির  হিসেবে বিবেচনা করা হয় ফোরামকে। গত নির্বাচনের আগে ৭৯২ ভুয়া ভোটার থাকার অভিযোগ করা হয় ফোরামের পক্ষ থেকে। শর্ত অনুযায়ী, ভোটার হতে নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, অভিযুক্তদের রিটার্ন হালনাগাদ নয়। অভিযোগের ভিত্তিতে সে সময়কার নির্বাচন পরিচালনা বোর্ড ৬৭ জনের ভোটাধিকার বাতিল করে। বাকিদের ভোটাধিকার বহাল ছিল।   নির্বাচনে সম্মিলিত পরিষদ নিরঙ্কুশ বিজয় পায়। প্যানেল লিডার এস এম মান্নান কচি সভাপতি নির্বাচিত হন।
অবশ্য গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সমঝোতার ভিত্তিতে সিনিয়র সহসভাপতি রফিকুল ইসলামকে সভাপতি করা হয়। এতেও ফোরাম আপত্তি থাকায় পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। বিজিএমইএর নির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পর ১২০ দিনের মধ্যে  নির্বাচন  অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিতদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনকে প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হওয়ায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি আরও চার মাস প্রশাসকের মেয়াদ বাড়ানো হয়। আগামী ১৬ জুন তাঁর বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে।
সংগঠনের প্রতিদিনকার কার্যক্রম পরিচালনা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশাসককে সহায়তার উদ্দেশ্যে একটি সহায়ক কমিটি রয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এ কমিটির বৈঠকে নির্বাচন পরিচালনা বোর্ড এবং আপিল বোর্ড গঠন করা হয়। জানা গেছে, নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবালকে। ল ফার্ম সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ব্যারিস্টার সৈয়দ আফজাল হাসান উদ্দিন এবং ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ এ বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে। 

অন্যদিকে নির্বাচন আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুরকে। এ বোর্ডের দুই সদস্য হয়েছেন বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এ এন এম কুদরত-ই-খু্দা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিজিএমইএর সহায়ক কমিটির বৈঠকে নির্বাচন পরিচালনা বোর্ড এবং আপিল বোর্ড গঠন করা হয়। 

নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল গতকাল সমকালকে বলেন, দায়িত্ব নিয়েছেন তারা। আজ সোমবার বোর্ডের প্রথম বৈঠক হবে। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সম্পর্কে বৈঠকে  বিস্তারিত আলোচনা হবে। ভুয়া ভোটারের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি শুনেছেন। তবে বিস্তারিত এখনও জানেন না। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রেমিকার সাবেক স্বামীর ফাঁদে প্রাণ গেছে তাজকীরের
  • সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি: রিজভী
  • কাজ না করে আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে কর্মকর্তারা
  • বিজিএমইএ নির্বাচনে ৬৯০ ভুয়া ভোটার
  • ভারতের কারণে অস্ট্রেলিয়ার পর দ. আফ্রিকাও গেল দুবাইতে
  • কখনও বলিনি আমি আর অভিনয় করব না: নাঈম