গাজা: যুদ্ধবিরতি এলো মানুষগুলো ফিরল না
Published: 30th, January 2025 GMT
প্রচুর শব্দ– ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিস্ফোরণ, ড্রোনের শব্দ, আর্তনাদ, “শহীদ, শহীদ” বলে চিৎকার। কাচ ভাঙার শব্দ, দরজা বন্ধ করার শব্দ, ভবন ভেঙে পড়া, আগুনের জ্বলন্ত শিখা, বজ্রপাত, বৃষ্টি, বাতাস, মৃত্যুর শ্বাস, অন্ধকার এবং ছাই। এই সবকিছু এখনও আমার মাথায় রয়ে গেছে।
প্রায় এক বছর আগে গাজা ছেড়েছি, কিন্তু এইসব দৃশ্য এবং শব্দ এখনও আমাকে তাড়া করছে। আমি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি– একান্নবর্তী পরিবার, আমার বাড়ি এবং বন্ধুদের– কিন্তু যুদ্ধের প্রতিধ্বনি ছেড়ে যায়নি।
এখানে, কায়রোতে, গাজায় প্রথম চার মাসের যুদ্ধে যা দেখেছিলাম, যা শুনেছিলাম এবং যা উপলব্ধি করেছিলাম, সেই মানসিক আঘাতই বারেবার অনুভব করি।
এখনও যখন উড়োজাহাজের শব্দ শুনি, ভয়ে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে, মনে হয় যুদ্ধবিমান। যখন আতশবাজির শব্দ শুনি, আতঙ্কিত হয়ে উঠি, ভাবি– বিস্ফোরণের শব্দ। আমি ভেবেছিলাম নির্বাসন নিরাপত্তা এবং শান্তি আনবে। অথচ দেখা গেল তা যুদ্ধের আরও একটি পরিবর্ধিত রূপ।
গাজায় যে মৃত্যু এবং ধ্বংস ঘটেছে, তা এখনও আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই দুঃখ, যন্ত্রণা এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম; যা আমরা ভেবেছিলাম পেছনে ফেলে এসেছি, তা আজও আমাদের অনুসরণ করছে।
আমরা বৃষ্টিতে ভেজা তাঁবুর মধ্যে থাকি না কিংবা অভুক্ত নই; বোমার শব্দও সত্যি নয়– জানি, এগুলো কেবলই আমাদের মনের স্মৃতির প্রতিধ্বনি। তবুও আমরা এখনও যন্ত্রণায় রয়েছি।
আমার বাবা, আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, যিনি মাসের পর মাস চাকরি খুঁজে পাননি। যখন পেয়েছিলেন, তখন সেই কাজের বেতন ছিল অতি সামান্য। আমাদের ঋণের পর ঋণ বেড়েই চলছিল আর তাই আমরা মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছিলাম না।
এদিকে পুরোপুরি ডুবে আছি গাজার ভয়াবহতায়। সেই বোমা হামলা, গণহত্যা, ছিন্নভিন্ন তাঁবুর দুর্ভোগ– এইসব আমাদের কাছে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে আসছে মেসেজিং অ্যাপসের মাধ্যমে।
এখানে দেখা যাচ্ছে, আমার সব ফিলিস্তিনি বন্ধুর একই অবস্থা– তারা যুদ্ধে অবরুদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় এবং হতাশায় জীবনযাপন করছে।
“আমি বেঁচে না থেকে তাদের সঙ্গে মরে যেতে চেয়েছিলাম।” আমার বন্ধু দুআ আমাকে সম্প্রতি বলেছিল, তার পরিবার জেনোসাইড শুরু হওয়ার পরপরই তাকে কায়রোতে শান্তিতে পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পাঠিয়েছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেছিল, “যখন তাদের বিদায় জানালাম, আমার মনে হয়েছিল, তাদের আমি আর দেখব না।”
মিসরে পৌঁছে সে ভেবেছিল, জীবন তাকে বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য একটি ভালো সুযোগ দিয়েছে। কিছুদিন পর সে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, তাদের খোঁজ নেওয়ার জন্য, কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। আর তাই অস্বস্তি তাকে গ্রাস করে রেখেছিল, তার পরিবারের শহীদ হওয়ার বিধ্বংসী খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত।
এ ব্যথা অসহনীয় ছিল আর তাই সে তার পড়াশোনায় ব্যর্থ হয়। আজও সে তার অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে এবং আমাকে বলেছিল, তার বাড়িওয়ালা শিগগিরই ভাড়া দিতে না পারার কারণে তাকে উচ্ছেদ করবে। সে অনাথ, নির্বাসনে একা, আর শিগগিরই হয়তো গৃহহীনও হয়ে পড়বে।
আরেকজন বন্ধু, রাওয়ান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে মিসরে কয়েক বছর ধরে পড়াশোনা করছিল। ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর, একটি বিশাল বিস্ফোরণে তার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়, পুরো পরিবার মারা যায়। শুধু তার মা গুরুতর আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। আর তার বিবাহিত বোন, যিনি অন্য একটি বাড়িতে ছিলেন এবং বেঁচে আছেন।
রাওয়ান আমাকে বলেছিল, তার বাবার উৎসাহজনক বার্তা, ভাই মহম্মদ ও মাহমুদের সমর্থন এবং বোন রুবার নিষ্পাপ হাসি আজও তার মনে পড়ে। সে কখনোই তার পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। এখন সে যেন তার নিজেরই ছায়া হয়ে গেছে। নাদা আমার আরেক বন্ধু, তার বোনের সাথে কায়রোতে আছে। সেই মেয়েগুলো তাদের বাবা-মা এবং ভাইকে গাজার পেছনে রেখে চলে এসেছিল। কেননা, রাফা ক্রসিংয়ে যেতে তাদের নাম অনুমোদিতের তালিকায় ছিল না।
কায়রোতে নাদা একাকী, দিশেহারা এবং ভীত হয়ে পড়েছিল। তাই সে চেষ্টা করছিল তার বাবা-মা এবং ভাইয়ের স্থানান্তরের আবেদন করতে, কিন্তু তখনই দখলদার রাফাতে আক্রমণ চালায় এবং ক্রসিংটি বন্ধ করে দেয়। তখন সে আমাকে বলেছিল তার অনুভূতির কথা, যেন জীবনের সবক’টি দরজা তার মুখের সামনেই বন্ধ হয়ে গেছে।
আত্মীয়দের কোনো সহায়তা ছাড়াই নাদা আর তার বোন একা থাকছে এবং সংগ্রাম করে চলেছে। মানসিক চাপ, যন্ত্রণা তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এখন সে অনেকখানি ওজন হারিয়েছে এবং তার মতে তাকে কঙ্কালের মতো দেখায়!
সে আমাকে আরও বলেছে হয়রানি এবং অপহরণের ভয়ে যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকছে সেখান থেকে বাইরে যেতে তারা ইচ্ছুক নয়।
“আমরা আমাদের ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত ফিরে পেতে চাই।” সে বলেছে।
আমরাও চাই, তবে আমরা এটাও জানি যে আমাদের ফেলে আসা জীবনের সবকিছুই হারিয়ে গেছে। এমনকি যুদ্ধ শেষ হলেও কিছুই আগের মতো হবে না। আমাদের সেই অপূরণীয় ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণও মিলবে না।
যুদ্ধবিরতি আজ কার্যকর হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। বুধবার যখন এটা ঘোষণা হয়েছে, তারপর থেকে ১২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আমরা জানি আরও মানুষ মারা যাবে তবু পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কেননা, গাজা এখন আর বসবাসের উপযুক্ত নয়।
যুদ্ধবিরতির পর যদি শান্তি স্থাপিত হয়ও, তবু ইসরায়েলি সরকার তাদের নিজস্ব শর্তে অবরোধ এবং জনগণের হয়রানি চালিয়ে যাবে। পুনর্গঠন– যদি কখনও শুরু হয়– বহু বছর ধরে চলবে। এজন্যই আমরা, একটি পরিবার হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে নির্বাসনে নতুন জীবন শুরু করব, সম্মুখে যতই সমস্যা আসুক।
রিম স্লিম, ফিলিস্তিনি লেখক, বর্তমানে মিসরে আশ্রয় নিয়েছেন
সূত্র: আলজাজিরা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র পর ব র ত র পর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
হঠাৎ চারজনকে উদ্ধারের আলোচনা, নিশ্চিত নয় পুলিশ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থীর মধ্যে চারজনের খোঁজ মিলেছে– সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন আলোচনা থাকলেও এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ। তাদের ভাষ্য, আজকালের মধ্যে এমন তথ্যের বিষয়টি আরও পরিষ্কার হতে পারে।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল সমকালকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকজনের খোঁজ মিলেছে– এমন প্রচার আছে। তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা এখনও উদ্ধার বিষয়ে নিশ্চিত নই। আজকালের মধ্যে পরিষ্কার হতে পারব।
পাহাড়ের বিজু উৎসব শেষে খাগড়াছড়ি থেকে চবি ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে জেলা সদরের গিরিফুল এলাকা থেকে ১৬ এপ্রিল সকালে পাঁচ শিক্ষার্থীকে দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে। অপহৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে রিশন চাকমা, দিব্যি চাকমা ও মৈত্রীময় চাকমা রাঙামাটি এবং অন্য দু’জন লংঙি ম্রো ও অলড্রিন ত্রিপুরা বান্দরবানের বাসিন্দা। তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
সন্তু লারমা সমর্থিত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি নিপণ ত্রিপুরা এ অপহরণের ঘটনায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) দায়ী করেছেন। তবে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
একাধিক অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে চাপের মুখে অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থীর মধ্যে চারজনকে গত সোমবার রাতে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার সর্বোসিদ্ধিপাড়া এলাকা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।