গত ২০ জানুয়ারি সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ‘বেড়েছে শিক্ষার ব্যয়, অসহায় অভিভাবক’। যদিও প্রতিবেদনটি চট্টগ্রাম শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ে লেখা, কিন্তু এটি যেন পুরো দেশেরই শিক্ষাচিত্র। দিন দিন শিক্ষা উপকরণে খরচ এমন একটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না।
এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরাও দিশেহারা। বই, খাতা, কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স– প্রতিটি উপকরণেরই দাম বেড়েছে। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী, তার ওপর শিক্ষা উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে অভিভাবকরা যাবেন কোথায়? যেসব পরিবারে দুই বা ততধিক শিক্ষার্থী, তাদের অবস্থা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যও উল্লেখযোগ্য। প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা নতুন ক্লাসে ওঠামাত্র ভর্তি প্রক্রিয়ায় বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচের ধকল সামাল দিতে হয় অভিভাবকদের। তারপর যুগের পরিবর্তনে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন অবস্থা হয়েছে, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনই হোক; নতুন ক্লাসে নতুন স্কুল ড্রেস, নতুন জুতা, নতুন টিফিন বক্স, নতুন খাতাপত্র– সব অবশ্যই দিয়ে পাঠাতে হয়। যেন সাধ্যের অতিরিক্ত জীবনযাপনের জন্য শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীদের ভেতর একটি ক্রমবর্ধমান চাহিদা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।
সাধারণ পরিমিতিবোধসম্পন্ন জীবনযাত্রা থেকে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। আবার আগের বছরের কোনো খাতাপত্র ব্যবহার উপযোগী থাকলেও তা বাদ দেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। একজন শিক্ষক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগের বছরের বেঁচে যাওয়া ভালো খাতাপত্র যদি হোমওয়ার্ক করার নির্দেশও দেওয়া হতো তাহলে অনেক দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। বছর শেষ হয়েছে বলে ভালো খাতাও ফেলে দিতে হবে কেন? শিক্ষার মূল কাজ তো মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো। আমরা যদি শিক্ষার্থীদের শৈশব থেকেই এভাবে সাশ্রয়ী ও মিতব্যয়ী হতে শেখাতাম; এ আদর্শের শিক্ষা তাদের পরবর্তী জীবনেও কাজে লাগত। অথচ আমাদের শিক্ষাকাঠামো মানবিক গুণাবলির বিকাশ তো হচ্ছেই না, কোনো প্রকারের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষাও দিতে পারছে না। শিক্ষাকাঠামো এখন কেবল সনদসম্পন্ন যন্ত্র তৈরির কারিগরে পরিণত হয়েছে, যার বাইরের পোশাকটা ঝলমলে, ভেতরটা ফাঁকা।
ছেলেবেলায় একটা প্রবাদ খুব শোনা যেত– ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে’। ভাবতে অবাক লাগে, আজ যুগের পরিবর্তনে নির্মম বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্রবাদটি যেন ঘুরিয়ে বলার সময় এসেছে। কেননা.
দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শিক্ষা আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোগসর্বস্ব পয়সাওয়ালাদের বিষয়। যেন তাদেরই অধিকার এ ক্ষেত্রে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে এমনটি তো হওয়ার কথা নয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো শিক্ষাও মানুষের মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও রাষ্ট্র আমাদের নাগরিকদের সে অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য কোনো গৌরবের বিষয় নয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে। দেশের মানুষ এক বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। দেশে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা দরকার। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও শিক্ষা উপকরণে যেন তার কোনো প্রভাব না পড়ে। যেন অভিভাবকদের আয়ত্তের বাইরে তা চলে না যায়। নতুবা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
মাহজাবিন আলমগীর: শিক্ষিকা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র র
এছাড়াও পড়ুন:
সলেমানের সোলার পাম্পে উপকৃত ১১০০ কৃষক, সাশ্রয় একরে ৪০০০ টাকা
কৃষির উপকরণ হচ্ছে বীজ, সেচ ও সার। তার মধ্যে অন্যতম উপকরণ সেচ। দেশের সেচ ব্যবস্থা ডিজেল ও বিদ্যুৎ নির্ভর। কিন্তু এই দুই ব্যবস্থার থেকে কম খরচ ও পরিবেশবান্ধব সোলার প্যানেল দিয়ে তৈরি করা সেচ পাম্প দিয়ে সেচ সুবিধা নিয়ে উপকৃত হচ্ছেন ঠাকুরগাঁওয়ে ১১০০ বোরো ধান চাষি। এতে কৃষকের একরপ্রতি সাশ্রয় হচ্চে ৪ হাজার টাকা। শুধু টাকায় নয়, সোলার সেচ পাম্পে নেই কোনো শব্দ, নেই জ্বালানি খরচসহ কোনো রকম ঝামেলা। আর এটি সম্ভব করেছেন সলেমান আলী নামে এক কৃষি উদ্যোক্তা।
সদর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের মোলানী গ্রামের মো. সলেমান আলী। ব্যাটারিবিহীন সোলার সেচ পাম্প তৈরি করে এলাকায় সাড়া ফেলার পাশাপাশি অর্জন করেছেন সুনাম। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করেন সোলার নিয়ে সেচ। দীর্ঘ বছরের পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে ২০১৪ সালে তৈরি করেন ব্যাটারিবিহীন সোলার সেচ পাম্প। ২০১৫ সাল থেকে সোলার দিয়ে তিনি স্থানীয় কৃষকদের সেচ সুবিধা দিয়ে আসছেন। বর্তমানে তার ২৫০০, ২৬০০, ৩৩০০ ওয়ার্ডসহ মোট ২৬টি সোলার প্যানেল ও পাম্প রয়েছে। যার মধ্যে ৬টি পাম্প দিয়ে তিনি নিজে কৃষকদের সেচ সুবিধা দেন। বাকি পাম্পগুলো তিনি মৌসুমভিত্তিক ৩৬ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছেন।
বর্তমানে তার তৈরি করা সোলার সেচ পাম্প দিয়ে সেচ সুবিধা নিয়ে উপকৃত হচ্ছেন ১১০০ কৃষক। এতে এবার প্রায় ৮ লাখ টাকা আয় করার আশা করছেন সলেমান আলী। গত বছর আয় করেছিলেন ৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। একেকটি সোলার প্যানেলসহ পাম্প তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বলে জানান সোলার সেচ পাম্প উদ্ভাবনকারী উদ্যোক্তা সলেমান আলী।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে বজ্রপাতে প্রাণ গেল ২ কৃষকের
কৃষি জমিতে ‘বোমা বিস্ফোণ’, কৃষক আহত
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, শ্যালোমেশিন ও বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে সেচ দিতে অনেক বেশি খরচ হয় ও প্রয়োজনের সময় বিদ্যুৎও থাকে না। শ্যালোমেশিন দিয়ে সেচ দিতে একর প্রতি খরচ ১০ হাজার আর সোলারে খরচ হয় ৬ হাজার টাকা। এতে খরচ কম ও ঝামেলামুক্ত। এছাড়াও মাটির অভ্যন্তরীণ পাইপ স্থাপন করায় ড্রেনের ঝামেলা নেই এবং ড্রেনের সেই জায়গায় তারা আবাদ করতে পারছেন। এতে ফসল ভালো ও বেশি হচ্ছে। সলেমানের সোলার সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক উপকৃত হচ্ছেন তারা।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লালাপুর শুকানি গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘‘আমি সলেমান আলীর সোলার সেচ পাম্প দিয়ে গত চার বছর ধরে ফসলে পানি নেই। এতে বিশেষ করে মানুষ থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না। আর শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি নিলে তেল কিনতে হয় ও মেশিন আনা নেওয়া করতে কমপক্ষে দুইজন মানুষ লাগে ও পরিশ্রম হয় বেশি। আর আগে একর প্রতি মেশিনের পানি নিতে বর্তমানে লাগে ১০ হাজার টাকা। আর সোলার সেচ দিতে লাগে ৬ হাজার টাকা। এতে আমাদের অনেক খরচ ও পরিশ্রম কম হয়।’’
একই উপজেলার কালমেঘ বাজার এলাকার কৃষক মো. নূর ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের এইদিকে সোলার পাম্প দেওয়ার পর থেকে কৃষকদের খুবই উপকার হয়েছে। আগে ডিজেলচালিত মেশিনের মাধ্যমে আমাদের পানি নিতে কষ্ট হতো ও খরচ বেশি হতো। সলেমান ভাই সোলার নিয়ে আসাতে আমরা খুব সহজেই বোরো ধান ক্ষেতে পানি দিতে পারছি। পানি দিতে আমাদের ক্ষেতে আসতেও হয় না। শুধু সকালে সোলার পাম্প একবার চালু করে দিলে সারা দিন এমনিতে পানি হয়ে যায়। আর বিকাল ৫-৬টার দিকে সেটি অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়।’’
সদর উপজেলার মোলানি গ্রামের কৃষক মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘‘সোলারের মাধ্যমে এক ঘণ্টায় বোরো ধানের এক বিঘা জমিতে পানি হয়ে যায়। শ্যালোমেশিন ও ডিপ-টিউবওয়েলের মাধ্যমে আমাদের পানি নিতে ড্রেন করতে হতো। এতে পানির চাপে অনেক সময় মাটির ড্রেন ভেঙে যেত। এখন সলেমান চাচা মাটির নিচ দিয়ে পাইপ পুতে দিয়েছে। যার ফলে আমাদের আর ড্রেন করতে হয় না ও ড্রেনের যে জায়গাটি পড়ে থাকতো সেটিতে ধান করতে পারছি। এতে আমাদের ধানের ফলনও বেশি হচ্ছে।’’
আরো অনেক কৃষক সলেমানের মাধ্যমে উপকৃত হতে পেরে তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
সলেমান আলী জানান, তিনি তার বাড়িতে লাইট, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজসহ মাছের ও মুরগির খামারে বিদ্যুতের যাবতীয় কাজ সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চালান। তার এই প্রযুক্তি দেশে তিনি ছড়িয়ে দিতে চান। তাহলে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সাশ্রয়, পরিবেশ দুষণ রোধ ও দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম বলেন, সলেমান আলীর এই উদ্ভাবন কৃষিক্ষেত্রে আর্শীবাদ স্বরূপ। শুধু এই জেলায় নয়, দেশের বিভিন্ন জেলাসহ সুনামগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে তার এই উদ্ভাবন প্রযুক্তি। সোলার সেচ পাম্প দিয়ে জেলার প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেছেন। তার এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানকার কৃষকরা সাশ্রয় মূল্যে, প্রয়োজন ও সাধ্যমতো সেচ দিতে পেরে লাভবান হচ্ছেন। ফলে তাদের ফসল উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে।
সলেমানের এই প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে বলে আশা করেন এবং কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হবে জানান উপপরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম।
ঢাকা/বকুল