নির্বাচনের চাপ বাড়াতে ‘দ্রুত আন্দোলনে যাবে’ বিএনপি
Published: 29th, January 2025 GMT
জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে চাপ সৃষ্টি করতে বিএনপি ‘দ্রুত আন্দোলনের যাবে’—এমন ইঙ্গিত দিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। বুধবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে এক আলোচনা সভায় দেশের জনগণের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে দলের এই অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর আত্মপ্রকাশ হয়েছে। এ উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে সংগঠনের উদ্যোগে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই প্রধান অতিথি ছিলেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘সরকার মাত্রই সিদ্ধান্তের মধ্যে ভুল করতে পারে। সেটা সকল সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখন অন্তর্বর্তী সরকার সকল সিদ্ধান্ত নির্ভুলভাবে নেবে, এটা তো সঠিক নয়। ভুল তাদেরও হতে পারে। কিন্তু সেটা সঠিকভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব এদেশের সাংবাদিক সমাজের যেমন আছে; রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক শক্তি ও সামাজিক শক্তিগুলোরও আছে।”
আরো পড়ুন:
তিন জেলার কর্মশালায় তারেক রহমান
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সব দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে
জামায়াত-বিএনপির মধ্যে কোনো সংঘাত নেই: দুদু
‘‘সেই জায়গা থেকে আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে চিন্তা করছি, সরকারের ভুল শুধরিয়ে সঠিক রাস্তায় এনে গণতান্ত্রিক রাস্তা বিনির্মাণের জন্য এবং একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের পথ পরিষ্কার করতে আমরা খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেব। সেটা (পদক্ষেপ)-কে আপনারা আন্দোলনও বলতে পারেন, সরকারের সমালোচনাও বলতে পারেন।”
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য তুলে ধরে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মাঝেমধ্যে বলেন যে, আমরা বেশি বেশি করে যেন সমালোচনা করি, যাতে সরকার সঠিক পথে থাকে।”
‘‘এই সরকারের একটি ভালো গুণ আছে। তা হচ্ছে, সরকার মাঝেমধ্যে ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও সমালোচনার মুখে সেগুলো শুধরায়, গো ধরে বসে থাকে না। সরকার যখন ভুল শুধরায়, তখনই মনে করতে হবে এই সরকার জনগণের।”
অন্তর্বর্তী সরকারকে সঠিক রাস্তায় রাখতে ‘যথেষ্ট সমালোচনা’র ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আজকের দিনে প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সামনের দিকে কী কী সংস্কার চাই, কীভাবে নির্বাচন চাই, কখন নির্বাচন চাই ইত্যাদি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা, সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্তহীনতা।”
‘‘আমরা যদি এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতে দিতে চাই, তাহলে সরকারকে গাইড করতে, পরিচালনা করতে আমাদের যথেষ্ট সমালোচনা করতে হবে। এমনকি, আমাদের সড়কে আন্দোলনও করতে হতে পারে সরকারকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে আসার জন্য।”
সংস্কার প্রসঙ্গে
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘নির্বাচন যদি বিলম্বিত করবেন, সেই যৌক্তিকতা আপনাদের জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে। ইতোমধ্যে ৬ মাস পার হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলো রিপোর্ট প্রদান করেছে, সরকারের কাছে সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক দলগুলো, সামাজিক শক্তিগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার কথা। রিপোর্ট দেওয়ার পর প্রায় ১৪/১৫ দিন পার হয়ে গেছে, সেই উদ্যোগ অবশ্য এখনো দেখা যায়নি। আমি আশা করি, আপনারা (সরকার) যেসব বিষয়গুলো রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তিগুলো, বিশেষজ্ঞগণ ঐক্যমত্য পোষণ করতে পারে; সেগুলো আগে চিহ্নিত করুন সংস্কারের মধ্যে।”
‘‘সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো অত্যন্ত সুন্দর, বুঝলাম। কিন্তু সকল বিষয়গুলো কী এসেছে? অবশ্যই না। আবার কিছু বিষয় কি অতিরিক্ত এসেছে? অবশ্যই হ্যাঁ। আর কিছু বিষয় এসেছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে না। যে বিষয়গুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে, সামাজিক কালচারে যায় না; সেগুলো আমাদের চিন্তা করতে হবে। কারণ, যারা সংস্কার কমিশনের বসেছেন আপনারাও মানুষ। আপনাদের সব বক্তব্য রিকমন্ডেশন শতভাগ সঠিক, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেজন্য আলোচনার কথা এসেছে।”
আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্নভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলছি। কালকেও দেখলাম, আওয়ামী লীগ এ দেশে নির্বাচন করতে পারবে না, করতে দেয়া হবে না, নিষিদ্ধ করা হবে। এ বিষয়ে আমরা পরিষ্কার বলেছি, বাংলাদেশের জনগণ নির্ধারণ করবে। যে দল ফ্যাসিবাদী চরিত্রে দেশে গণহত্যা চালিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যে দল দায়ী, যে দলের নির্ধারিত সরকার দায়ী। শেখ হাসিনা অনির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব করেছেন। তার সিদ্ধান্তে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এদেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং, ব্যক্তির সঙ্গে সেই সংগঠনের বিচার করতে হবে।”
‘‘ব্যক্তির বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও অন্যান্য আদালতে মামলা হয়েছে, কিন্তু সংগঠন হিসেবে বিচার করার প্রভিশন সংবিধানের আর্টিকেল-৪৭ আছে। কিন্তু সংগঠনের বিচারের বিষয়ে আমরা তো তত বেশি সোচ্চার নই কেন?”
তিনি বলেন, ‘‘আপনরা শুনেছেন, সংগঠন হিসেবে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে একটা সংশোধনী আনার কথা ছিল। কিন্তু সেখান থেকে সরকার সরে গেল। এখন যদি সরকারের অংশ হিসেবে কোনো কোনো উপদেষ্টা বলেন যে, আমরা আওয়ামী লীগের বিচার চাই।”
‘‘তো বিচার চাওয়ার বিষয়ে আপনারা কিছু করলেন না। আর বিচার করার জন্য আমরা দাবি করছি, আপনারা দাবি করছেন, এদেশের জনগণ দাবি করছে। ফ্যাসিবাদী শক্তি, গণতন্ত্র হত্যাকারী, গণহত্যাকারী মানবতাবিরোধী অপরাধী যারা তারা এবং সেই সংগঠনের বিচার হোক। বিচারের মাধ্যমে নির্ধারিত হোক। তা হলে জনগণ মেনে নেবে।”
ফ্যাসিবাদীবিরোধী জাতীয় ঐক্যে যাতে কোনো বিভেদ সৃষ্টি না হয়, সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ থাকা উচিত বলে মনে করেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
‘নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হলে সাধুবাদ’
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমি ছাত্র নেতাদের সম্মান করি। তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করি। তাদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়াসকে স্বাগত জানাই। কিন্তু, নির্বাচিত হওয়ার জন্য যদি বিভিন্ন কৌশলের সরকারের শক্তিকে প্রয়োগ করতে হয়, সেটা ফ্যাসিবাদকে দোষারোপ করে আপনার কী লাভ হবে?’’
‘‘আমরা যদি অতীতের ইতিহাস অনুসরণ করি, তাহলে আমরা কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাব?”
সংবিধানের মৌলিক সংশোধনের বিষয় তুলে ধরে ‘স্বাধীনতার সঙ্গে অন্যকিছু সমকক্ষ করা ঠিক হবে না’ বলে মন্তব্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পার্থ সারথি দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক আল ইমরান। সভায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি বাছির জামালসহ সাংবাদিকরা বক্তব্য রাখেন।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পার্থ সারথি দাস বলেন, ‘‘গণমাধ্যমকর্মীরা কারো তাঁবেদারি করবে না। তারা সব সময় দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করবে। আজকের অনুষ্ঠানে সেই বার্তা আমরা সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করেন।
এ সময় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রায়হান বলেন, ‘‘জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে আগামীতে সবাই নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করবে, এমনটাই প্রত্যাশা করে দেশের মানুষ। সে উদ্যোগে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে।’’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে পাহারা দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। কেউ এটা ভাববেন না, এই আন্দোলন ১০ থেকে ১৫ দিনে হয়ে সফল হয়েছে। এটা ঠিক নয়। বিগত ১৬ বছরের আন্দোলনের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান সফল হয়েছে।’’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘গত ১৬ বছরে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন গণমাধ্যমের অধিকারের জন্য, স্বাধীনতার জন্য আমরা দীর্ঘ আন্দোলন করেছি। ২০১৩ সালে ফ্যাসিবাদী সরকার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে কালো আইনের খসড়া তৈরি করেছে। সেখান থেকে আমাদের আন্দোলনের শুরু হয়েছে। সেখানে আমাদের বক্তব্য সব গণমাধ্যম প্রকাশ ও প্রচার করতে পারেনি। ৫ আগস্টের আগে ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে ৫৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তাদের পেটোয়া বাহিনীর হামলায়। জুলাই বিপ্লবে ৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।’’
ঢাকা/নাজমুল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এনপ সরক র র স গঠন র র জনগণ র র জন চ র কর র জন য আপন র ব এনপ অপর ধ আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
হামাস যে কারণে আত্মসমর্পণ করবে না
ফিলিস্তিনের গাজা। একে আপনি যেভাবেই ডাকুন না কেন–গণহত্যা কেন্দ্র, রক্ত ঝরানোর এক অনন্ত চক্র, যন্ত্রণা ও মৃত্যুকূপ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির কিংবা ইসরায়েলের বড় অংশ একে যেভাবে দেখছে অর্থাৎ একে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষাও করতে পারেন। তেল আবিবের অ্যাশকেনাজি ইহুদিরা পশ্চিমা বুদ্বুদে বাস করে, সকালে ক্যাপুচিনোতে চুমুক দেয় আর তাদের যোগব্যায়ামের শিক্ষকের কথা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। অথচ অদূরেই ঘটছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, যা স্রেব্রেনিৎসা বা রুয়ান্ডার পর বিশ্বে দেখা যায়নি। একটা বিষয় তারা কেউই যেন বুঝতে পারছে না–হামাস আত্মসমর্পণ করবে না। হয়তো ধারণা করা হয়েছিল, গাজা থেকে হামাসের নেতারা এক সময়ের ফাতাহর মতো অর্থ নিয়ে পালাবেন। কিন্তু ১৮ মাসের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং দুই মাসের অনাহারের পরও তা না ঘটায় এটি স্পষ্ট–ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর শত্রুকে কতটা কম বোঝেন!
ইসরায়েলের সর্বশেষ ‘প্রস্তাব’ ছিল মূলত আত্মসমর্পণের আহ্বান। সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ৪৫ দিনের জন্য খাদ্য ও পানি সরবরাহ এবং হামাসকে নিরস্ত্র করার দাবি জানিয়েছিল ইসরায়েল। হামাসের জবাব ছিল: তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত, যদি বিনিময়ে কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি হুদনা বা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। মানে তারা আর নতুন টানেল খনন করবে না, অস্ত্র উন্নত করবে না এবং গাজার শাসনব্যবস্থা অন্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করবে। হামাস শুরুতেই তারা যে দুটি শর্ত দিয়েছিল, সেগুলো থেকে একচুলও সরেনি: তারা নিরস্ত্র হবে না এবং তাদের দাবি, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে যাক এবং এই যুদ্ধের পুরোপুরি অবসান ঘটুক।
আত্মসমর্পণ করবে না হামাস
হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না, তার অনেক কারণ রয়েছে। দিনরাত তারা এবং গাজার জনগণ যে দুর্দশা ভোগ করছে, তারপরও তারা পিছু হটছে না। মার্চে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার পর দেড় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। হামাসের প্রথম সারির নেতৃত্ব, বেসামরিক সরকার, পুলিশ বাহিনী এবং প্রায় সব হাসপাতাল শেষ হয়ে গেছে। রাফাহ শহর ধ্বংস করা হচ্ছে। তবুও নির্বাসনে যাওয়ার জন্য তাদের বিপুল অর্থ প্রস্তাব করলেও, তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রয়াত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত হয়তো অনেক আগেই নির্বাসনে চলে যেতেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন ১৯৮২ সালে পশ্চিম বৈরুতে পিএলও বাহিনী ঘেরাও হওয়ার পর। ফাতাহও এতক্ষণে বিদেশে পাড়ি জমাত। কিন্তু এই উদাহরণ হামাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেন?
প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা এবং সহিংসতা দেশটিকে যেমন চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, তেমনি গাজার ধ্বংসস্তূপ ফিলিস্তিনি সংগ্রামকেও ভিন্ন রূপ দিয়েছে। গাজা এখন সব ফিলিস্তিনির কাছে পবিত্র ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এই যুদ্ধে গাজার এমন কোনো পরিবার নেই, যাদের স্বজন শহীদ হয়নি বা যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়নি। হামাস বা অন্য কোনো প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে এই জনগণ থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। সমষ্টিগত কষ্ট যত বাড়ছে ততই তাদের নিজেদের ভূমিতে টিকে থাকার ইচ্ছাশক্তিও বাড়ছে; যেমনটা নিরস্ত্র দক্ষিণ হেবরনের কৃষকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন। আরও একটি বিষয়, ইসরায়েলের নির্দয় আচরণের কারণেই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রেরণা জন্মেছে।
ইসরায়েলের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’
ইসরায়েল শুধু জমি বা নিয়ন্ত্রণই চায় না। তারা সব সময় আরও বেশি চায়। তাদের ধর্ম অঞ্চলের অন্য সব ধর্মের ওপর আধিপত্য বিস্তার না করা পর্যন্ত তারা থামে না। এমনকি ইস্টার সানডেতে খ্রিষ্টানরাও মুসলমানদের মতোই এই আচরণের শিকার হয়। তাদের বসতি স্থাপনের কাজ যুদ্ধের সময়ের তুলনায় শান্তির সময়েই আরও বাড়ে। যেমন অসলো চুক্তির পর তারা পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন করে।
বস্তুত ইসরায়েল কখনোই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে বিশ্বাসী ছিল না, কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং তাদের উত্তরসূরিদের মনে সব সময় শুধু একটি রাষ্ট্রের ধারণাই ছিল। ইতামার বেন গভির, বেজালেল স্মোত্রিচ এবং নেতানিয়াহু মিলে যা করছেন, তা হচ্ছে ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করা’; অর্থাৎ ডেভিড বেন গুরিয়ন যে ফিলিস্তিনিদের ‘ইসরায়েলের ভূমি’ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন, সেটা সম্পন্ন করা।
আজ যদি হামাস আত্মসমর্পণ করে, গাজাও আত্মসমর্পণ করে, সেটি হবে পুরো ফিলিস্তিনি আন্দোলনের আত্মসমর্পণ। এটি এ কারণে নয় যে, সব ফিলিস্তিনি ধর্মপ্রাণ বা ফাতাহ অজনপ্রিয়। বরং এ কারণে যে, প্রতিরোধই এখন দখলদারিত্ব অবসানের একমাত্র পথ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল গাজা, পশ্চিম তীর, জেরুজালেম এবং নিজ দেশের ভেতরের সব ফিলিস্তিনির ওপর যে দুর্ভোগ চাপিয়ে দিয়েছে, তার ব্যাপকতা এমন যে এখন হামাসের ভাগ্যই ফিলিস্তিনের ভাগ্য হয়ে গেছে।
তবে হামাস থেকে ফাতাহ আলাদা এ কারণে যে, হামাস একটি ধর্মীয় সংগঠন। এই যুদ্ধের সূচনা তারা করেছিল আল-আকসা মসজিদে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের অনুপ্রবেশের প্রতিক্রিয়ায়। গাজার ফিলিস্তিনিরা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে, সেটার অর্থ খোঁজার জন্য তারা নিজেদের ধর্মের দিকেই ফিরে যাচ্ছে।
কৌশলগত কারণ
হামাস যে লক্ষ্যে স্থির, এ সংগঠন যে দুর্নীতির বাইরে, তার পেছনের কারণ তাদের সম্মিলিত শৃঙ্খলা ও ইমান। বিষয়টি সবার ওপরই প্রভাব ফেলেছে।
রিফাত রাদওয়ান। ২৩ বছর বয়সী একজন প্যারামেডিক পেশাজীবী, যাঁর মৃত্যুর মুহূর্তের কথা তিনি রেকর্ড করেছেন। মৃত্যুর আগে আল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করছিলেন যেন তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত না পড়ার জন্য ক্ষমা পান। তিনি হয়তো খুব ধার্মিক ছিলেন না এবং স্পষ্টতই হামাসের সদস্যও ছিলেন না, কিন্তু মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে ক্ষমা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস কতটা গভীর ছিল। যদি কখনও গাজার ফিলিস্তিনিদের সাহস ও আত্মত্যাগের কোনো প্রতীক খোঁজা হয়, রাদওয়ানই ছিলেন সেই প্রতীক। মৃত্যুশয্যাতেও তিনি ইমানের পরিচয় দিয়েছেন। গাজার ইমানও তদ্রূপ ধ্বংস হবে না। হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না, তার আরও কিছু কৌশলগত কারণও রয়েছে। একটি সংগঠন হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ যাই হোক, যেমন তামিল টাইগার বা চেচেন বিদ্রোহীদের মতো অনেক বিদ্রোহী দল বড় সামরিক শক্তির দ্বারা নির্মূল হয়েছে আবার ইটিএর মতো দলও লক্ষ্য অর্জন না করেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারপরও হামাস বিশ্বাস করে, তারা ইতোমধ্যে তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছে। সেই লক্ষ্য ছিল–ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংগ্রামকে আবারও বিশ্বের মানবাধিকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বেড়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ৫৩ শতাংশ ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক মত পোষণ করে, যা ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
জনমতও হামাসের পক্ষে, যেখানে হেরেছে ইসরায়েল। বিশেষ করে সেই সব দেশে, যেখানে হামাস নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত, মানুষকে বলা হয়েছে তারা যেন হামাসকে সন্ত্রাসী হিসেবে ভাবে। কিন্তু মানুষ ক্রমেই সেই ধারণা থেকে সরে আসছে। এমনকি যদিও তারা ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে ভয়ংকর অপরাধ হিসেবেই দেখে।
যদি ইসরায়েল চায় এই যুদ্ধকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে শেষ করতে, তবে তারা নিশ্চিত থাকতে পারে–একই লক্ষ্য প্রতিটি ফিলিস্তিনির মনেও স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। নেতানিয়াহু যতদিন এই ব্যর্থ অভিযানে গাজায় এগিয়ে যাবেন, ততদিন ইউরোপের বড় দেশগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যেমন ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার দিকে আরও এগিয়ে যাবে। v
ডেভিড হার্স্ট: মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক; মিডল ইস্ট আই থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত