অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, “আওয়ামী লীগের পতাকাতলে কেউ যদি অবৈধ বিক্ষোভ করার সাহস করে, তবে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।”

বুধবার (২৯ জানুয়ারি) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে এ কথা বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ফেসবুকে লিখেছেন, “আগস্টে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো ন্যায্য বিক্ষোভ বন্ধ বা নিষিদ্ধ করেনি। আমরা সমাবেশ করার স্বাধীনতা এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আজ সকালে গণমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সাড়ে পাঁচ মাসে কেবল ঢাকায় কমপক্ষে ১৩৬টি বিক্ষোভ হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিক্ষোভের ফলে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়েছে। তবু, সরকার কখনো বিক্ষোভ-সমাবেশের ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি।”

আওয়ামী লীগকে বিক্ষোভ করার সুযোগ দেওয়া উচিত কি না, এ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, “আমাদের কি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে বিক্ষোভ করার সুযোগ দেওয়া উচিত? জুলাই-আগস্টের ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগের কর্মীরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের হত্যায় অংশ নিয়েছিল। তাদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ডে শহীদ হয়েছেন কয়েকশ তরুণ শিক্ষার্থী, এমনকি নাবালক শিশুরাও। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় গণহত্যা, খুন ও তাণ্ডবের জন্য দায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার।”

শফিকুল আলম বলে, “গতকাল কয়েকজন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মীর সাক্ষাৎকারের বরাতে নিউইয়র্ক-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, শেখ হাসিনা তার ১৬ বছরের একনায়কত্বের শাসনামলে সরাসরি হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের নির্দেশ দিয়েছিলেন।” 

“তিনি একটি চোরতন্ত্র (ক্লেপ্টোক্রেসি) এবং খুনি শাসনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন একটি প্যানেল বলছে, শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে তার ঘনিষ্ঠরা ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত চুক্তি থেকে কোটি কোটি ডলার চুরির দায়ে হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে এখন তদন্ত চলছে।”

ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “প্রায় সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তি জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন। প্রায় তিন হাজার জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। শাপলা চত্বরের সমাবেশ এবং মাওলানা সাঈদীর বিচারিক রায়ের পর বিক্ষোভকারীদের ওপর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। পুলিশ বাহিনী হাসিনার শাসনামলে পুলিশ লীগে পরিণত হয়েছিল। হাসিনার একনায়কতন্ত্রে প্রায় ষাট লাখ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ভুয়া ও গায়েবি মামলা দেওয়া হয়। এমনকি, দেশের প্রথম হিন্দু প্রধান বিচারপতিকেও নির্মমভাবে মারধর করা হয়, পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়।“

ফেসবুকে আরো লেখা হয়েছে, “যতক্ষণ না আওয়ামী লীগ এই গণহত্যা, হত্যাকাণ্ড এবং প্রকাশ্য দুর্নীতির জন্য ক্ষমা না চাইবে এবং যতক্ষণ না তাদের অন্যায়কারী নেতাকর্মীরা বিচার ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করে তাদের অপরাধের জন্য বিচারকার্যের প্রক্রিয়া শুরু করে পাপমোচন করতে উদ্যোগ না নেবে এবং যতক্ষণ না আওয়ামী লীগ তাদের বর্তমান নেতৃত্ব ও ফ্যাসিবাদী আদর্শ থেকে নিজেকে আলাদা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিক্ষোভ করার অনুমতি দেওয়া হবে না।” 

মিত্রবাহিনী কি নাৎসিদের বিক্ষোভ করার অনুমতি দিয়েছিল, এ প্রশ্নও তুলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।

শফিকুল আলম লিখেছেন, “পৃথিবীর কোনো দেশ কি একদল খুনি এবং দুর্নীতিবাজ চক্রকে আবার ক্ষমতায় আসতে দেবে? কোনো দেশই জবাবদিহিতা ছাড়া স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরার অনুমতি দেয় না। বাংলাদেশের জনগণ এই খুনিরা কোনো প্রতিবাদ-সমাবেশ করলে তার বিরুদ্ধে কঠিন জবাব দেবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা দেশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো ধরনের প্রচেষ্টাকে সুযোগ দেব না। আওয়ামী লীগের পতাকাতলে কেউ যদি অবৈধ বিক্ষোভ করার সাহস করে তবে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।”

ঢাকা/রফিক

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব ক ষ ভ কর র স ফ সব ক কর ম র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা

মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘঠিত গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতির স্মারক হয়ে অটল, নির্ভীক দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বলেই যেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক শহীদ শামসুজ্জোহা হল নির্মিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এই হলটি রাজশাহীবাসীর কাছে জোহা হল নামেই অধিক সমাদৃত। শহীদের রক্তস্নাত এই হল নির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগের ইতিহাস।

ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের অগ্রভাগে থাকা এক বলিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা ভেঙে আন্দোলন শুরু করলে সামরিক বাহিনী যখন মিছিলে গুলি করে তখন শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে ড. শামসুজ্জোহা গুলিবিদ্ধ হন। এর আগে তিনি বলেন, ‘আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না, যদি হয় তবে কারো গায়ে লাগার পূর্বেই সেটা আমার গায়ে লাগবে।’ সত্যি সত্যি গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরে তাকে রাজশাহী মিউনিসিপ্যাল অফিসে নিয়ে চিকিৎসা না দিয়ে ফেলে রাখা হয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ড. শামসুজ্জোহার অস্ত্রোপচার হয়। 

আরো পড়ুন:

ভয়াল রাতের গ্লানি

কক্সবাজার হানাদারমুক্ত দিবস ১২ ডিসেম্বর

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যার প্রতিবাদে শহীদ নূরুল ইসলাম নিজ হাতে রাজশাহীর সোনাদিঘীর মোড়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয় ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। তাকে লক্ষ্য করে মিউনিসিপ্যাল অফিস থেকে সেনাবাহিনী গুলি ছোঁড়ে। ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর পরপর তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করেন ‘শহীদ শামসুজ্জোহা হল
 যা ১৯৭১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চালু হয়। তখনও কেউ হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি এই হলই একদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষ্য দিবে।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। এরপর তারা জোহা হল, আব্দুল লতিফ হল, জিন্নাহ হল, আর্টস বিল্ডিং, সায়েন্স বিল্ডিং, মিলিটারি সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট, এক্সপেরিমেন্টাল স্কুল বিল্ডিং ও বহু স্টাফ কোয়ার্টারে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রথমেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ধ্বংস করে। এরপর তারা একে একে সকল হল, স্টাফ কোয়ার্টারের গৃহস্থালি জিনিসপত্র এবং লাইব্রেরির বইপত্রসহ ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি লুটপাট করে। পাক বাহিনী হাবিব ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় শাখাও লুট করে এবং জোহা হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঐ সময়ে যেসব জিনিস নষ্ট করা হয়েছিল সেসবের আনুমানিক মূল্য ছিল বাইশ লক্ষ চৌষট্টি হাজার টাকা। 

এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক শাসনকর্তা লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান ৫ জুলাই, ১৯৭১ সালে রাজশাহী সফর করেন। ঐ সময়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করলে তাকে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল কর্মচারি কাজে যোগ দিয়েছেন এবং ২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খুলবে। অথচ পাকিস্তানি হায়েনারা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে তখন নরক বানিয়ে রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে এরা রাজাকার ও আল-বদরদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী কাটাখালি, মাসকাটা দীঘি, চৌদ্দপাই, শ্যামপুর, ডাশমারী, তালাইমারী, রানীনগর ও কাজলার কয়েক হাজার নারী-পুরুষকে ধরে এনে এই সবুজ ক্যাম্পাসের মাটিতে তাদেরকে হত্যা করে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারিদের ওপরে পাকবাহিনী চালায় বর্বর নির্যাতন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে বসবাসরত অংক বিভাগের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতে প্রথম এদের নৃশংসতার শিকার হন। নির্যাতনের পরে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান তার নাম পরিবর্তন করে ‘দেবদাস’ রাখেন এবং ১০ মে তারিখে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করেন। ইংরেজিতে লিখিত এই প্রতিবাদপত্রে তিনি D Das (দেবদাস) হিসেবে বাংলা ও ইংরেজিতে স্বাক্ষর করেন। বিষয়টি জানতে পেরে পাক সামরিক বাহিনী ১২ মে তাকে গ্রেফতার করে অতিথি ভবনের দোতলার একটি ছোট কক্ষে আটকে রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা এগারো দিন বন্দি রাখার পর তাকে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী সালেহ আহমদসহ গাড়িতে করে পাবনায় নিয়ে যাওয়া হয়। পাবনায় তিন/চার দিন রাখার পর মুজিবুর রহমান দেবদাসকে সামরিক প্রহরায় নাটোর পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেও তার ওপরে চলে নির্যাতন। তিন মাস বন্দি জীবন কাটানোর পর তাকে ৫ সেপ্টেম্বর ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নির্যাতনের কারণে একটা সময়ে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েং ফেলেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের মতো ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের প্রধান ড. রফিককেও আটকে রেখে প্রায় আটদিন ধরে তার ওপরে নির্যাতন চালানো হয়।

অংক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, ভাষা সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার এবং মনস্তত্ত্ব বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর মীর আবদুল কাইয়ুমকে ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৫ এপ্রিল ও ২৫ নভেম্বর তারিখে রাতের আঁধারে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। শহীদ সমাদ্দারের মরদেহের অংশবিশেষ কাজলা গ্রাম থেকে উদ্ধার করা গেলেও শহীদ হাবিবুর রহমানের কোনো সন্ধান মেলেনি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই না বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেনোগ্রাফার শেখ এমাজুদ্দীন, ইউডি এসিস্ট্যান্ট সাইফুল ইসলাম, ছুতার শফিকুর রহমান, ওয়ার্কস এসিস্ট্যান্ট কলিমুদ্দীন, ড্রাইভার আবদুল আলী, সাইকেল পিয়ন আব্দুল মজিদ ও মোহাম্মদ ইউসুফ, গার্ড মোহাম্মদ আফজাল, আব্দুর রাজ্জাক ও নুরু মিয়া, আর্দালি পিয়ন আব্দুল ওয়াহাব, বেয়ারা কোরবান আলী ও আবদুল মালেক, পিয়ন ওয়াজেদ এবং মোহন লাল নামের পনেরো জন কর্মচারিকেও পাকবাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে এখানে বর্বরতা চালায়। হলের ব্লকে ব্লকে তখন ছিল নির্যাতন কক্ষ। ক্যাম্পে বন্দি রাখা বাঙালিদের হলের করিডর ও কক্ষে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে মারধর করা হতো। নির্যাতনের পর বন্দিদের হত্যা করে পাশের বধ্যভূমিতে ফেলে দেওয়া হতো। হল সংলগ্ন জঙ্গলে লাশের স্তূপ ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে জানা যায় এই বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে এমনকি জীবিত অবস্থায়ও পুঁতে ফেলা হতো। আবুল বাশার নামের এক পিয়নের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জোহা হলের কাছে কমপক্ষে তিন হাজার লোককে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এমনকি আবুল বাশারকে কবর খনন কাজ করতেও বাধ্য করা হয়। 
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে ২০২১ সালে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার কর্তৃক মঞ্চস্থ হওয়া নাটক ‘জোহা হল কথা কয়’ এ গণকবর থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে আসা আবদুল মান্নানের বক্তব্য সংলাপ হিসেবে উপস্থাপিত হয় যেখানে পাক বাহিনীর বর্বরতার কথা উঠে এসেছে। এখানে আবদুল মান্নান বলছেন ‘পাকিস্তানি সেনারা লোহার সাঁড়াশি দিয়ে একটি একটি করে আমার হাতের আঙুলের নখ তুলেছে। বেয়োনেট দিয়ে একজনের চোখ বের করে ফেলল। চারপাশে বন্দি মানুষের গলা থেকে পশুর মতো আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। যখন চেতনা ফিরে এল তখন দেখি লাশের স্তূপের মধ্যে পড়ে আছি। পরনে কিছু নেই।’

আবদুল মান্নানকে ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর ভোরে বালিয়াপুকুর এলাকার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ধরে নেওয়ার সময় তার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, তাকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প জোহা হলে আটকে রাখা হয়েছিল। ক্যাম্পটি মূলত ছিল পাক বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। এখানে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা করা হতো এবং পেছনের ইটভাটায় লাশ ফেলে দেওয়া হতো। বন্দি থাকাকালীন আবদুল মান্নান ধীরে ধীরে চোখ পরিষ্কার হলে দেখতে পান, তার শরীরে কোনো কাপড় নেই। হলের যেই ঘরে তাকে আটকে রাখা হয় সেটির মেঝেতে প্রায় দুই ইঞ্চি পুরু হয়ে মানুষের মাথার চুল-রক্তজমাট বেঁধে আছে এবং ঘরে প্রচ- দুর্গন্ধ। চোখ খোলার পর তিনি আরও দেখেন, একজন মেঝেতে পড়ে আছেন। তিনি সেই বন্দির কাছ থেকেই জানতে পারেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল। আবদুল মান্নানের সঙ্গে তার আত্মীয় মীর রহমত আলীকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নির্যাতনের এক পর্যায়ে বেয়নেট দিয়ে মীর রহমত আলীর একটি চোখ তুলে নেওয়া হয়। পরে তার কী হয়েছিল তা আর জানা যায়নি। নির্যাতনকালে পাকবাহিনী খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আবদুল মান্নানের নখ তুলে ফেলার চেষ্টা করেছিল। ধরে নেওয়ার ঠিক ছয় দিন পর ২১ অক্টোবরের এক বিকালে আবদুল মান্নান সরকার বধ্যভূমির অসংখ্য গলিত ও অর্ধগলিত লাশের স্তূপের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান। 

স্বাধীনতার পর এই বধ্যভূমি থেকে বহু মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। জোহা হলে নির্যাতনের শিকার নারীর মাথার চুল, শাড়ি ও ছেঁড়া ব্লাউজও পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয় এবং ২০০৪ সালের ৯ ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের কাছাকাছি অবস্থিত। ইট, সুরকিতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি সমতল ভূমি হতে সিমেন্টের গোলাকার কালো বেদির উপর মাথা তুলে দণ্ডায়মান যা ৪২ ফুট উঁচু এবং ৬ স্তরবিশিষ্ট। এই স্মৃতস্তম্ভ ঘিরে একটি কংক্রিটের বেদি আছে আর বেদির মাঝখানে বড় একটি কূপ আছে। 

শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পাশের এই গণকবর থেকে প্রাপ্ত শহীদদের অজস্র হাড়গোড়, মাথার খুলি, দাঁত, শার্ট-কাপড় ও গণকবরের পবিত্র মাটি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজের পশ্চিম পাশ থেকে উদ্ধারকৃত শহীদের কংকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার প্রদর্শনী কক্ষের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৩৯৫ বঙ্গাব্দের ৭ চৈত্র এবং ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শহীদ শিক্ষকের স্ত্রী বেগম ওয়াহিদা রহমান, বেগম মাসতুরা খানম ও শ্রীমতী চম্পা সমাদ্দার এই প্রদর্শনী কক্ষের উদ্বোধন করেন। তিনটি গ্যালারিতে বিভক্ত এই শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুমের ব্যবহৃত পোশাক, জুতা, আইডেন্টিটি কার্ড ও শহীদ অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারের ব্যবহৃত কাঁসার থালা, জুতা, পোশাক এবং শহীদ কর্মচারি আবদুল মালেকের ব্যবহৃত প্লেট ও শহীদ ওয়াজেদ আলীর কাঁসার গ্লাস সংরক্ষিত আছে। এছাড়া শহীদ ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতি ধরে রাখতে এই সংগ্রহশালায় শহীদ শামসুজ্জোহা কর্নার আছে। 

ঊণসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ শামসুজ্জোহার রক্তের বিনিময়েও এই দেশ, এই মাটির বুকের ক্ষরণ বন্ধ হয়নি। বরং শহীদ শামসুজ্জোহার রক্তবিন্দু যেন স্ফুলিঙ্গের মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে এই দেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামকে দিয়েছে নতুন এক মাত্রা। আর এভাবেই শহীদের নামে নির্মিত হলটি ইতিহাসের ধারক বাহক হয়ে আজও অসংখ্য শহীদের রক্তচিহ্ন আগলে ধরে আছে। 

(তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ২০ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত জিয়াউল গনি সেলিমের প্রতিবেদন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা)

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা
  • গণহত্যার সত্য উন্মোচনে ফরেনসিক বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করছেন নিগার
  • ইসরায়েলের অংশগ্রহণের প্রতিবাদে ইউরোভিশনের ট্রফি ফেরত দিচ্ছেন সুইস সংগীতশিল্পী নেমো