চাঁদাবাজি ও মজুতদারি বন্ধ করতে না পারায় নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ সরকার
Published: 29th, January 2025 GMT
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ ও মজুতদারি বা অযৈাক্তি মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবিলা করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাই নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
আজ বুধবার ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫: সংকটময় সময়ে প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফাহমিদা বলেন, সিপিডির পর্যবেক্ষণে পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ডিম, রুই মাছ, হলুদ, গম, মসুর ডাল, চিনি, গরুর মাংস, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল এবং পাম তেলসহ ১৪টি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষণে দামের ওঠানামা এবং অদক্ষতার জন্য বেশ কিছু বাধা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে, প্রাথমিক বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে মজুতদারি, কমিশন এজেন্ট বা গুদাম পরিচালনাকারীদের আধিপত্য, অপর্যাপ্ত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি পদ্ধতি, উচ্চ উপকরণ খরচ, নিম্নমানের সংরক্ষণ এবং পরিবহন সুবিধা এবং সামগ্রিক সরবরাহকে প্রভাবিত করে এমন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, চালের বাজার ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত জটিল। সে কারণে সিপিডি চালের সরবরাহ শৃঙ্খলে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা নিরূপণের জন্য মাঠ পর্যায়ে একটি অনুসন্ধানমূলক জরিপ পরিচালনা করে, বিশেষ করে মাঝারি-পাইজাম চাল। যার লক্ষ্য ছিল প্রধানত দামের যে অস্থিরতা তার মূল কারণগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করা।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় অসংখ্য বাজার এজেন্ট রয়েছে। বাজার মূল্যের ওপর গুদাম মালিকদের বা অটো রাইস মিলারদের উল্লেখযোগ্য আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ ধান চাষীরা প্রায়শই সঠিক দাম পান না। কিন্তু ভোক্তারা অযৌক্তিকভাবে উচ্চ মূল্যের সম্মুখীন হন, যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশে পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে একটি অকার্যকর অর্থনীতি রেখে গেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশ্লেষণে মধ্যস্থতাকারীদের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
সিপিডি বলছে, অর্থনীতিতে মুল্যস্ফীতির চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছে এবং নীতি সুদহারও বৃদ্ধি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উপর উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির বোঝা কমাতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহ-পক্ষীয় ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন করেছে, যেমন ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করা এবং ঢাকার ভেতরে ও বাইরে ন্যায্য মূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা করা। তবে দুঃখের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে চাঁদাবাজি, মজুদদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলি এখনও পর্যন্ত বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সংস্থাটি আরও বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী এবং জরুরি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
রাজস্ব প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে ২০২৫ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.
২০২৫ অর্থবছরের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অর্থবছরের বাকি সময় ৪৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে যা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। সামগ্রিকভাবে কর রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। কর রাজস্বের দুটি উৎসেই (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত ও বহির্ভূত) একই চিত্র দেখা গেছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ওই সময়ে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক আহরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জুলাই-আগস্টের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে শ্লথগতি এর বড় কারণ। কর রাজস্ব আহরণের পরিস্থিতি বহুলাংশেই সরকারকে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধিতে ধাবিত করেছে। তবে আইএমএফের শর্তপূরণের চাপও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান উচ্চ-মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিতে এ ধরনের উদ্যোগ মোটেই কাম্য নয়। কারণ পরোক্ষ কর সকল ধরনের আয়ের মানুষের জীবনেই প্রভাব ফেলে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ত যপণ য পদক ষ প যপণ য র ব যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাস্থ্যে গবেষণা কাজে আসছে না, আছে অনিয়মের অভিযোগ
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি গবেষণা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। গবেষণা কাজের অনেকগুলোই দেওয়া হয়েছে পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। বেশ কিছু কাজ ঠিকঠাক সম্পন্নও হয়নি। ফলে সরকারের টাকা নষ্ট হয়েছে, কিন্তু এসব গবেষণার কোনো সুফল মানুষ পায়নি।
অন্তত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) ও রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) গত আট বছরের করা বেশ কয়েকটি গবেষণা ও জরিপের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি শাখার অধীনে করা এসব গবেষণা ও জরিপের অনেকগুলোর ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি, আর্থিক অনিয়ম, গবেষণা প্রতিবেদন জমা না দেওয়া, গবেষণাপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করাসহ নানা অসংগতি রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য দিতে গড়িমসি করেছেন। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে গত বছরের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বারবার যোগাযোগ করেও তাঁদের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বিভ্রান্তিকর তথ্যও দিয়েছেন।
তবু তাঁদের দেওয়া তথ্যেই এসবের আলামত দেখা যাচ্ছে। আরেকটি সমস্যা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাড়া ঢাকার বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানকে গবেষণাকাজ দেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দল বা গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের কাজ দিতে হবে এবং ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানের কথাও মাথায় রাখতে হবে। অধ্যাপক সায়েবা আক্তার সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনএনসিডিসি জানিয়েছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে আট বছরে তারা ৫১টি গবেষণা ও ৬৯টি সার্ভে বা জরিপ করেছে। এই মোট ১২০টি কাজে খরচ হয়েছে ৯১ কোটি ২১ লাখ টাকা। গবেষণার জন্য প্রতিবছর গড়ে খরচ করা হয়েছে ১১ কোটি টাকার মতো।
আর সিডিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ বছরে তারা ১৫টি গবেষণাকাজ শেষ করেছে। তবে এ কাজে ব্যয়ের হিসাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। জরিপের বিষয়ে কোনো তথ্যই দেয়নি। তবে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনগুলো থেকে কিছু বরাদ্দের তথ্য পাওয়া গেছে।
যেসব বিষয়ে গবেষণা ও জরিপ হয়েছে, সেগুলো হলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার রোগীর নিবন্ধন, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি, আর্সেনিকজনিত রোগ, থ্যালাসেমিয়া, মানসিক স্বাস্থ্য, প্রশমনসেবা, বায়ু ও শব্দদূষণ, কিডনির রোগ, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় অ্যান্টিভেনম তৈরি, সড়ক দুর্ঘটনা ও পানিতে ডোবা মানুষের চিকিৎসা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, এসব গবেষণার সময় তিনি এই পদে ছিলেন না। তবে অভিযোগগুলো তিনি তদন্ত করবেন।
গবেষণা প্রতিবেদন লাপাত্তাগোদ রোগ নির্মূল এবং মাটিবাহিত কৃমি (এসটিএইচ) নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে একটি জরিপের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা দিয়েছিল সিডিসি। এই জরিপের কোনো প্রতিবেদন জমা পড়েনি। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপের এই মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদন ছাড়াই।
গত ৩ মার্চ প্রথম আলো সিডিসির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদকে এ অনিয়মের অভিযোগ জানায়। এক মাস পর ৭ এপ্রিল তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এই প্রতিবেদক। তিনি বলেন, এসব যখন ঘটেছে, তখন তিনি পরিচালক ছিলেন না। এরপর তিনি তাঁর কার্যালয়ের অন্য একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে সেই কর্মকর্তা কথা বলতে চাননি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা–বিষয়ক একটি প্রকল্পে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ও সহকারী পরিচালক মো. আশরাফুল আলমকে ৩০ লাখ টাকা দেয় সিডিসি। হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এ কাজে অডিট আপত্তি জানিয়ে বেশ কিছু অনিয়ম চিহ্নিত করেছে।
যেমন একক প্রতিষ্ঠান বাছাই পদ্ধতিতে কাজটি সরাসরি দেওয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে। এ গবেষণায় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) নীতিগত অনুমোদন ছিল না। ৫১টি হাসপাতালকে নমুনা হিসেবে নেওয়ার কথা ছিল, নেওয়া হয়নি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো জরিপ প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ এবং কাজটিতে সরকারি টাকার অপচয় হয়েছে।
৮ এপ্রিল কথা হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ও সহকারী পরিচালক মো. আশরাফুল আলমের সঙ্গে। দুজনই বলেন, অডিট আপত্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাঁদের কোনো কিছুই জানায়নি।
নাজমুল হক যশোরে বদলি হয়ে গেছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রটোকল অনুযায়ী গবেষণা করেছেন। সিডিসি কখনো আপত্তি তোলেনি। আর আশরাফুল আলম বলেন, তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিজস্ব কমিটি থেকে নীতিগত অনুমোদন নিয়েছেন বলে বিএমআরসির অনুমোদনের দরকার হয়নি। গবেষণায় কয়টি হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল, তা তাঁর মনে নেই। তাঁরা গবেষণায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ জেলা হাসপাতাল ও মেঘনা উপজেলা হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
তবে আশরাফুল আলমের কাছ থেকে গবেষণা প্রস্তাব ও গবেষণা প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। ২০২২-২৩ সালে সিডিসির লাইন ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
টাকাগুলো সব গেল কইগত ২৭ জানুয়ারি এনসিডিসি আট বছরে করা তাদের মোট ১২০টি গবেষণা ও জরিপের তালিকা প্রথম আলোকে দেয়। লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক জাকির হোসেনের সই করা তালিকাটিতে গবেষণা বা জরিপের শিরোনাম, সাল, প্রতিষ্ঠানের নাম, কত টাকার চুক্তি—সেসব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এগুলোর মধ্যে ৮২টি গবেষণা বা জরিপের প্রধান গবেষকের (প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর বা পিআই) নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও রয়েছে।
অধ্যাপক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে দুটি প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা চুক্তি মোতাবেক টাকা পায়নি; কম পেয়েছে।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি সিএমইডি হেলথ। প্রতিষ্ঠানটি মূলত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য গবেষণা করতে দেয় এনসিডিসি। এ জন্য ৪০ লাখ টাকার চুক্তি করা হয়। তবে করোনা অতিমারি শুরু হওয়ায় গবেষণা শেষ হয়নি।
সিএমইডি হেলথের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার এ মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনসিডিসির পক্ষ থেকে আমাদের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। আমরা যেটুকু কাজ করেছিলাম, সে জন্য ১৫ লাখ ১৯ হাজার ১২১ টাকার একটি চেক দেওয়া হয়।’
একই অর্থবছরে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সামাজিক যোগাযোগ, আবেগজনিত বিকাশ এবং শিশুযত্নের ওপর গবেষণা করার জন্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) সঙ্গে এনসিডিসি চার কোটি টাকার চুক্তি সই করে। এটিও করোনা মহামারির কারণে শেষ হয়নি।
এনসিডিসি বলছে, তারা চার কোটি টাকাই সিআইপিআরবিকে দিয়েছে। তবে সিআইপিআরবি প্রথম আলোকে বলেছে, তারা পেয়েছে ৪৪ লাখ ৪৬ হাজার ২৮৭ টাকার একটি চেক। সিএমইডি হেলথ ও সিআইপিআরবি এ-সংক্রান্ত নথি প্রথম আলোকে দিয়েছে।
ওই সময় এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির কম টাকা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভ্যাট-ট্যাক্স কেটে রেখে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়েছে।
আমরা আর মামুরা বৃত্তান্তবেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমিনেন্স ২২ বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হায়দার তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একাধিকবার গবেষণার জন্য সিডিসি ও এনসিডিসিতে প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে গবেষণাকাজ পেলেও সিডিসি ও এনসিডিসি থেকে একটি কাজও তাঁরা পাননি। তাঁর অভিযোগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি গোষ্ঠী গবেষণাকাজ ও অর্থ নিয়ন্ত্রণ করে।
একই অভিযোগ করেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি-সংক্রান্ত একটি গবেষণার জন্য তিনি দরপত্র জমা দিতে পারেননি। কারণ, নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যেন কাজটি পান, সেভাবেই গবেষণার শর্ত তৈরি করা হয়েছিল।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, শর্ত ছিল গবেষণা কর্মসূচির পরিচালককে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপক হতে হবে এবং প্রধান গবেষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপক হতে হবে। কাজটি পেয়েছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) একজন সহযোগী অধ্যাপক।
ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে প্রায় দুই যুগ কাজ করেছেন। তাঁর দাবি, আওয়ামী লীগ আমলে নানা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তিনি এবং অবসরের বয়স হওয়ার আগেই ২০২৪ সালের শুরুতে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন।
ডা. হাবিবুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ক্যানসার নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক কাজ, রোগী দেখা ও গবেষণা করার পরও আমি কাজটি করার জন্য প্রস্তাবই জমা দিতে পারিনি।’
এনসিডিসির দেওয়া ১২০টি গবেষণা ও জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোট ৩৭টি প্রতিষ্ঠান কাজগুলো পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে সিআইপিআরবি, ১২টি। বাংলাদেশে ডায়াবেটিক সমিতি ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো পেয়েছে ১০টি কাজ। আইসিডিডিআরবি ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা ৯টি করে গবেষণাকাজ পেয়েছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক বিএসএমএমইউ) পেয়েছে ৮টি।
এ ছাড়া সাতটি করে গবেষণাকাজ পেয়েছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও সিআরআইএল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এরপর দুটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে চারটি করে, তিনটি প্রতিষ্ঠান তিনটি করে এবং আটটি প্রতিষ্ঠান দুটি করে। বাদ বাকি ১৮টি প্রতিষ্ঠান গবেষণাকাজ পেয়েছে ১টি করে।
এনসিডিসি ও সিডিসি থেকে পাওয়া তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকা গবেষকেরা বা প্রতিষ্ঠান বেশি কাজ পেয়েছে। কাজ পেয়েছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন উপাচার্যসহ আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
যেমন একটি গবেষণার ক্ষেত্রে প্রধান গবেষক হিসেবে দুজনের নাম উল্লেখ আছে। সূচনা ফাউন্ডেশনের সায়মা ওয়াজেদ হোসেন ও সিআইপিআরবির অধ্যাপক সায়দুর রহমান মাশরেকি। সায়মা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, সূচনা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এমন গবেষকেরা, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদস্য বা নেতা এবং ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন—এমন ব্যক্তিরা বারবার কাজ পেয়েছেন। বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বা সমর্থক হিসেবে পরিচিত কোনো চিকিৎসক বা গবেষক কাজ পাননি।
যিনি দাতা, তিনিই গ্রহীতাগবেষণার ক্ষেত্রে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। তহবিল বরাদ্দদাতা নিজেই যদি সেই গবেষণায় যুক্ত হন, তা হলে প্রশ্ন ওঠে তিনি নিজের স্বার্থে বরাদ্দটি দিয়েছেন কি না।
গবেষণার তালিকা দেখাচ্ছে, এনসিডিসি বা সিডিসির কাজ পেয়েছে মূলত ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলো। একমাত্র ব্যতিক্রম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। এ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগ সাপ ও সাপের বিষ (ভেনম) নিয়ে গবেষণা করে। প্রতিষ্ঠানটি সাতটি গবেষণা কাজ পেয়েছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর থাকার সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেনম রিসার্চ সেন্টারকে গবেষণার জন্য একাধিকবার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে অন্য গবেষকদের সঙ্গে তাঁর নামও ছাপা হয়েছে।
রোবেদ আমিন অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গবেষণায় যুক্ত হননি। তবে গবেষণা প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে তিনি সহায়তা করেছেন, লিখেছেন। তাঁর মতে, গবেষক হিসেবে এটা করতে কোনো বাধা নেই। ভিন্ন প্রসঙ্গে রোবেদ আমিন বলেন, অন্য রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী চিকিৎসকেরা আবেদন করেননি বলেই অর্থ বরাদ্দ পাননি।
চাই জবাবদিহিগবেষণার ফলাফল কাজে লাগানোর কোনো পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু দুই বছর গবেষণা ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রথম আলোর হাতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রকাশনাগুলো এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৭২ পৃষ্ঠার একটি বই। সেখানে ওই অর্থবছরে করা ১৭টি গবেষণার সংক্ষিপ্তসার ও মূল ফলাফল ছাপা হয়। এগুলোর ইনফোগ্রাফিকস নিয়ে ৭২ পৃষ্ঠার আরেকটি প্রকাশনা হয়। আবার এগুলোরই নির্বাহী সারসংক্ষেপ নিয়ে ৩৩ পৃষ্ঠার পুস্তিকা ছাপা হয়।
একই বিষয়ে তিনটি আলাদা প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন মূলত প্রভাবশালী দুজন উপ-কর্মসূচি পরিচালক (ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার বা ডিপিএম)। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ব্যাপক রদবদল হলেও তাঁরা একই পদে আছেন।
৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এনসিডিসির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে লাইব্রেরি নেই। গবেষণাপত্রগুলো এক জায়গায় সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন কর্মকর্তা দেখালেন, ২০২৩-২৪ সালের গবেষণাপত্রগুলো তাঁর আলমারির মধ্যে রয়েছে। দেখা গেল, বারান্দায় টয়লেটের কাছে বস্তায় ভরে অনেকগুলো গবেষণাপত্র রাখা।
একই দিনে সিডিসি কার্যালয়ে গিয়ে শোনা গেল, গবেষণাপত্রগুলো এক জায়গায় নেই। লাইন ডিরেক্টর বললেন, সেগুলো বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে আছে।
এসব গবেষণার কোনো প্রবন্ধ দেশে বা দেশের বাইরের কোনো সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে কি না, তা কেউ জানেন না বা জানার উপায় নেই। অন্যদিকে সরকার এসব গবেষণার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে কিছু করেছে কি না, তা-ও জানে না অধিদপ্তর।
২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) যৌথভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা কৌশলপত্র তৈরি করেছিল। সেখানে গবেষক, ব্যবস্থাপক ও নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েবা আক্তার বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দল বা গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের কাজ দিতে হবে এবং ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তিনি মনে করেন, এসব গবেষণা যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে যে এসব গবেষণা দেশ বা মানুষের কতটুকু কাজে লাগছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।