ব্যক্তির ইচ্ছা ও চাহিদার বেশির ভাগই রাষ্ট্র ‍ও বৃহত্তর সমাজের নিয়মবহির্ভূত। এ কারণে নাগরিকের ভেতর রাষ্ট্র ও সভ্যতার প্রতি সব সময় অসন্তোষ থাকে। যুক্তিটি দিয়েছিলেন সিগমন্ড ফ্রয়েড তাঁর ‘সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্ট’ গ্রন্থে। মানুষের রাজনৈতিক আচরণ কী দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, তা নিয়ে আরও মতবাদ ও তত্ত্ব রয়েছে। 

কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসক কী কারণে শোষকে পরিণত হয় বা জনগণ কেন তাকে শোষক মনে করে; ভোট ব্যবস্থায় নাগরিক মনস্তত্ত্ব কীভাবে প্রার্থীরা নিজ স্বার্থে কাজে লাগায়; কেন জনতা দাবি আদায়ে সহিংস হয়ে যেতে পারে– এসব বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, আমলা ও নাগরিক প্রতিনিধিদের ধারণা থাকা অপরিহার্য। ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হলে ক্ষমতা কাঠামো ও ক্ষমতার বিপজ্জনক দিকগুলো নিয়ে জানা থাকতে হবে– অনেকটা ওষুধের প্যাকেটের ব্যবহারবিধির মতো। ক্ষমতাচর্চা করলে ক্ষমতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও জানতে হবে বৈ কি!

রাজনীতিতে শক্তি প্রয়োগ, বিরোধী মতবাদ নিশ্চিহ্ন করার প্রবণতা এ অঞ্চলের প্রবহমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি; আর রাজনৈতিক হত্যা, নির্যাতন, অসহিষ্ণুতা আমাদের লালিত রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব। যে কারণে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মানুষের রাজনৈতিক আচরণ ও মনস্তত্ত্ব বুঝে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়।

অনেকের ধারণা, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ বিগত সরকারের নাগরিক মনস্তত্ত্ব বোঝার ব্যর্থতা; রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতা; সর্বোপরি জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সবচেয়ে প্রভাবশালী পদ্ধতি ভোটাধিকার প্রক্রিয়া অংশগ্রহণমূলক না হওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে মানুষের রাজনৈতিক আচরণ কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করা যায়? 
দৈবচয়নের ভিত্তিতে অনেককেই প্রশ্ন করেছিলাম, ‘রাজনীতিবিদ’ শব্দটি শুনলে মাথার মধ্যে কী ধারণা আসে? বেশির ভাগই বলেছেন, ক্ষমতাবান, উগ্র এবং জনসাধারণের অধিকার লুণ্ঠনকারীর ছবি মাথায় আসে। ‘আমলা’ শুনলে বেশির ভাগের অহংকারী, গোমড়ামুখো চেহারা মনে হয়। অপরদিকে কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও আমলার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তারা ‘জনগণ’ সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন? বেশির ভাগই উত্তরে বলেন, রাষ্ট্র কীভাবে চলে– সাধারণ মানুষ বোঝে না। 

তার মানে, রাজনীতিবিদ, আমলা ও জনগণের সম্মানজনক সম্পর্ক রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় হলেও বাংলাদেশে সেটি অনুপস্থিত। কারণ সম্ভবত রাজনীতিবিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, আমলার ক্ষমতা প্রদর্শন, জনসাধারণের আইন অমান্য করার প্রবণতা। বিস্ময়করভাবে আমাদের দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস সাধারণত ‘অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হয় না; বরং এক ধরনের ‘রাজনৈতিক আচরণ’ হিসেবে বিবেচিত। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোতে তাদের এমন অবস্থান সবাই যেন মেনে নিয়েছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দমন-পীড়নের জন্য তারাই ‘ফুট সোলজার’।

প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা কেন সহাবস্থানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরিতে ব্যর্থ? কেন এক দলের কর্মী অন্য দলের কর্মীকে রাস্তায় ফেলে বেদম লাঠিপেটা, এমনকি খুন করে ফেলে? 
সহনশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টিতে যেসব উপাদান প্রয়োজন, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সবার জন্য সুশিক্ষা ও উন্নত মনোজগৎ। সহনশীলতার সংস্কৃতি সবার চিন্তা ও কাজে তখনই প্রতিফলিত হবে যখন শিক্ষার ভিত্তি হবে সহমর্মিতা, মর্যাদা ও সমাজের কল্যাণ। সুস্থভাবে জীবন যাপন করার জন্য মনস্তত্ত্বে দুটি আস্থার খুব প্রয়োজন। একটি আধ্যাত্মিক আস্থা, আরেকটি জাগতিক। আধ্যাত্মিক আস্থা হলো সৃষ্টিকর্তা; আর জাগতিক আস্থা রাষ্ট্র বা প্রতীকী অর্থে সরকার। যখন এই দুয়ের মধ্যে দুটির ওপর থেকেই মানুষের আস্থা ভঙ্গ হয়, তখন সে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। 
প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা উঠে যায় কখন? রাজনীতিবিদদের হঠকারিতা, আমলাদের দুর্নীতি, নাগরিক সমাজের ঢালাও সমালোচনামূলক কার্যক্রম এবং সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যাপারে বিভ্রান্ত করে। তখন রাষ্ট্রের এক অংশের প্রতি আরেক অংশের অনাস্থা তৈরি হয়, অবিশ্বাস জন্ম নেয়। রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের সম্পর্কের ম্যাট্রিক্স এলোমেলো হয়ে যায়।

‘হোয়াই নেশনস ফেইল’ গ্রন্থে রবিনসন এবং ড্যারন অ্যাসমগলু বলেছেন, কোনো দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ না করতে পারলে রাষ্ট্র ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে; সাম্রাজ্যে অন্ধকার নেমে আসে। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এম.

জেরল্ড বলেছেন, বর্তমানে অনেক দেশের রাজনৈতিক আচরণে আত্মপ্রেম প্রক্রিয়া চলমান। রাজনীতিবিদ নিজের প্রয়োজন নিয়ে ভাবিত, জনগণ গোষ্ঠীস্বার্থে বিভক্ত, আমলাদের অগ্রাধিকার তাদের সুযোগ-সুবিধা। কেউ ভাবছে না– কীসে সবার ভালো, সবাই মিলে ভালো থাকা যাবে।  
কোনো রাষ্ট্র তখনই উন্নত হয় যখন সামাজিক সম্পর্কগুলো সুবিন্যস্ত থাকে। অপরাধীর সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক যেমন ব্যবস্থা নেওয়ার, জনসাধারণের সঙ্গে আমলার সম্পর্ক যেমন সেবা দেওয়া-নেওয়ার; তেমনি রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ী– প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সুবিন্যস্ত সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কই বিভিন্ন পক্ষের রাজনৈতিক আচরণের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মিশে আছে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা এবং বিপরীত ধারাকে দমন করার দীক্ষা। 
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম কথা সমাজে সম্প্রীতি ও সহনশীলতা নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ী যদি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে না পারেন; শিক্ষক যদি নির্ভয়ে পড়াতে না পারেন; জনগণ যদি বুক ফুলিয়ে চলতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর হয়ে যাবে। 

ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণ নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক দ্বারা। কেউ যদি রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নির্যাতিত হয়, তার কাছে সুনাগরিকসুলভ আচরণ আশা করা বৃথা। সে হয়ে উঠবে নৈরাজ্যবাদী, যে কিনা প্রাচীন দার্শনিক সিসেরোর মতো মনে করবে, রাষ্ট্র হলো সবচেয়ে বড় শোষক। অন্যদিকে নাগরিক যদি রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়, তাহলেও গণতন্ত্রের সঠিক স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের ম্যাট্রিক্স যত ছন্দময় হবে দেশ তত এগিয়ে যাবে।

মো. সুমন জিহাদী; পিএইচডি ফেলো,
এআইটি, থাইল্যান্ড 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক স র জন ত ব দ র জন ত ক ব ব যবস থ জনগণ র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনের পর সংস্কার: নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা কি ভুলে যাব

২০২৪-এর জুলাই গণ–অভ্যুত্থান এ অঞ্চলে একাত্তরের জনযুদ্ধের পর একটি অনন্যসাধারণ নতুন ঘটনা। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের বা দলসমূহের নেতৃত্বে এ অভ্যুত্থান ঘটেনি, বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী এ অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন বটে, তবে তাঁরা জনগণের সঙ্গে মিলেমিশে, একাকার হয়ে।

অনেকে বলবেন, উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী অভ্যুত্থান, বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থান কি হয়নি? তা হয়েছে বটে, কিন্তু তার নেতৃত্বে ছিল বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দল বা দলসমূহ। তাদের নেতৃত্বে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ব্যাপক পেশাজীবী ও সর্বস্তরের জনগণ।

বলাই বাহুল্য, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তরের গণ-অভ্যুত্থান রূপ নিয়েছিল জনযুদ্ধে, যোগ দিয়েছিলেন কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে পূর্ববাংলার সব রাজনৈতিক দলের কর্মী, নানা পেশাজীবী ও ছাত্র–যুবক-সৈনিক এবং কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ।

সামরিক-স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনও শেষে অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল, কিন্তু সেই অভ্যুত্থান ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মতো একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানে রূপলাভ করতে পারিনি। তার আগেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া দলগুলোর নেতৃত্ব অভ্যুত্থানের লাগাম টেনে ধরে এরশাদ নেতৃত্বের সঙ্গে আপসরফা করে তথাকথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র নামে পুরোনো রাষ্ট্রকে রক্ষার তাগিদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্ব হাজির করে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

সেই ঘটনাকে বিচার করে দেখলে বলা যায়, এরশাদশাহির ক্ষমতা ভোগকারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ অবশেষে ক্ষমতাবহির্ভূত বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া (আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত ও ৫ দলীয় বামজোট) দলগুলোর নেতৃত্বের কাছে বৈঠকের মাধ্যমে আপসরফার ক্ষমতা হস্তান্তরে পরিণত হয়।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বিরোধী সব দল তখন মাসের পর মাস বলে এসেছিল, এরশাদের শাসনাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের সংবিধান একটি কলুষিত জনবিরোধী সংবিধান।

অতএব তারা এরশাদের পতন চান। সেই চিন্তা থেকে তখনকার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব সবাই ঐকমত্য হয়ে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামের একটি রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন এবং তাতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে সব দল স্বাক্ষর করেছিল। এসব কথা নিয়ে তখনকার সংবাদপত্র বড়বড় হেডলাইন করেছিল, আমাদের মনে আছে।

এ ধারণার বিতর্কটি শুধু ২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের পর উঠেছে বলে এখনো জনগণের কাছে, এমনকি রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেও ধারণাটির অস্পষ্টতা কাটেনি। যতই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা জনগণের সামনে হাজির করবে, ততই গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ ঘটবে বলে আশা করি।

এরশাদের পতন যখন আসন্ন, এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তাঁর সংবিধানের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের প্রচণ্ড ক্ষোভকে তখনকার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব একজন শাসক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে অগণতান্ত্রিক স্লোগান তোলে ‘একদফা এক দাবি এরশাদ তুই কবে যাবি’ বলে।

এতে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার অগণতান্ত্রিক সংবিধানের বিরুদ্ধে জনগণের উত্থিত ক্ষোভকে একজন ব্যক্তি এরশাদের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে তখনকার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব সফল হয়েছিলেন। অতএব নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আপসরফার ক্ষমতা হস্তান্তরের তথাকথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিতা’র ক্ষমতা হাতবদলের অভ্যুত্থান আর ২০২৪–এর জুলাইয়ের জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানের মধ্যে মৌলিকভাবে পার্থক্য রয়েছে।

এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থানের উপসংহার টানা হয়েছিল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ধুয়া তুলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রস্তাবে সবার সম্মতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ক্ষমতা গ্রহণ। উল্লিখিত সব কথা আমাদের জানা বিষয়, আলোচনার সুবিধার জন্য শুধু পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ামাত্র।

এরশাদের কাছ থেকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র বদৌলতে প্রাপ্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি অক্ষত ও অপরিবর্তিত অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ পায়। সেদিন ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পাওয়া বলতে আন্দোলনকারী দলগুলোর নেতৃত্ব জনগণকে বোঝাতে চাইলেন, এমনকি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, শুধু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাবে।

তখনই কেউ-কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, শুধু নির্বাচন, এমনকি শতভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয় না, যত দিন না রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন গঠিত হয়। তাঁদের মতে, এরশাদের পতনের পর তখন প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের জন্য গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

কিন্তু তখন সেই দাবি প্রধান হয়ে ওঠেনি এবং তা গুরুত্বও পায়নি। কারণ, আন্দোলনের অবসান হয়েছিল ‘একদফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’ নামের অগণতান্ত্রিক স্লোগানের মাধ্যমে এবং একটি আপসরফার ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র চুক্তির মাধ্যমে। এতেই সবার বিজয় হয়েছিল বলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক কর্মীরা এক ভ্রান্তির বিভ্রমে নিমজ্জিত হয়েছিল। এই ভ্রান্তির মোহমুক্তি ঘটতে বেশি দিন লাগেনি।

তত্ত্বাবধায়ক সকারের প্রধান সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বহুল আলোচিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে জনগণ দেখতে পেলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার সংবিধানের ধারালো নখ-দন্ত এরশাদ আমলের মতোই সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বিএনপি ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামের অঙ্গীকার করা রাষ্ট্র সংস্কারের চুক্তি বেমালুম ভুলে যেতে পারল এবং অস্বীকার করল। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টের বিরোধী আসনে বসে অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করা ‘তিন জোটের রূপরেখা’ বিষয়ে কোনো রা শব্দ উচ্চারণ করল না।

এমনকি পরবর্তী মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তারাও বিএনপির পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের ‘তিন জোটের রূপরেখা’ ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল। জনগণ এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে, কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন কিংবা নিরপেক্ষ নির্বাচনের বুর্জোয়া পার্লামেন্ট স্বৈরতান্ত্রিক বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ দিতে পারে না।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রসঙ্গে শুধু নির্বাচন ও পার্লামেন্টের দোহাই দেওয়া জনগণকে প্রতারণার শামিল। নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্র পরিচালনার অনুষঙ্গ বটে, কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের মাধ্যমেই স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ গেড়ে বসে। এরশাদ, হাসিনার একরোখা শাসন গেড়ে বসেছিল নির্বাচনের পথ ধরেই।

এ ছাড়া কোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়ার দায়িত্ব বা কাজ চার বা পাঁচ বছর মেয়াদের রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্তে গঠিত পার্লামেন্টের নয়। নির্বাচিত পার্লামেন্টের কাজ রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশন বা সংবিধান রূপান্তরের বা সংস্কারের নয়, তাদের কাজ রাষ্ট্রের বিদ্যমান কনস্টিটিউশনের আলোকে সরকার গঠন করে জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। রাষ্ট্রের সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের কাজ করতে পারে একমাত্র কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি বা নির্বাচিত গণপরিষদ। সেই কথাই প্রধান হয়ে উঠেছে এবারের ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর।

উল্লেখ্য, ২০২৪ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান ক্ষমতামুখী বা নির্বাচনবাদী কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। এ কথা অনায়াসে বিএনপি, জামায়াত স্বীকার করে নিয়েছে। এমনকি শুধু নির্বাচনের দাবিতেও এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। আমরা সবাই জানি, এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার আগে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এবং পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-তরুণ-জনগণের সম্মিলিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে।

সমাজে ও রাষ্ট্রে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কথাটির গভীরতা ও তাৎপর্য ব্যাপক। এ বৈষম্যবিরোধী দাবির ভিত্তিতেই একাত্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। গত ৫০ বছরে রাষ্ট্রের উদ্যোগে বৈষম্য সৃষ্টি এমন এক চরম আকার ধারণ করেছিল, যার প্রতিবাদে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে জনগণের সব পর্যায়ের মানুষকে আন্দোলনে শরিক হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অবশেষে তাতে যোগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রের সাধারণ সৈনিকেরাও। অতএব এ অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নীতির অবসান, অথবা বলা যায়, রাষ্ট্রের মাধ্যমে সাম্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, কখনো শুধু নির্বাচন নয়। অতীতের কোনো নির্বাচন, শুধু নির্বাচন সমাজে ও রাষ্ট্রে বৈষম্য কমাতে সাহায্য করেনি, বরং বৈষম্য বেড়েছে।

অভ্যুত্থান–পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, অভ্যুত্থানকারীদের আকাঙ্ক্ষা ক্ষমতামুখী নির্বাচনবাদীদের মতো নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে গিয়ে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল যথার্থভাবেই দাবি তুলেছে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের। তবে পার্লামেন্টে সরকার গঠনের নির্বাচন ও কনস্টিটিউশন রূপান্তরের নিমিত্তে গণপরিষদ নির্বাচন একই সঙ্গে হবে, নাকি আলাদাভাবে হবে, নাকি সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কনস্টিটিউশনের রূপরেখা প্রস্তুত করে গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে, তা নির্ভর করে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের ঐকমত্যের ওপর।

যাঁরা তড়িঘড়ি করে নির্বাচন দিয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র সংস্কার করার দাবি তুলছেন, তাঁরা নেহাতই ভুলভাবে কথা বলছেন। তাঁদের দাবি দেশে দেশে চিরাচরিত নিয়মে কনস্টিটিউশন তৈরি বা রূপান্তরের নিয়মের সঙ্গে মেলে না। নির্বাচনের দোহাই দিয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে সংবিধান সংশোধনের দাবি যাঁরা তুলছেন, তাঁদের সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আয়োজিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের পর পার্লামেন্টে বিএনপি-জামায়াতের প্রথম গঠিত সরকার কর্তৃক তিন জোটের রূপরেখার অঙ্গীকার ভঙ্গ করার ঘটনাকে মনে করে দেখতে অনুরোধ করব।

এ দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গিয়ে জনগণের সঙ্গে অঙ্গীকার ভঙ্গের ইতিহাস তো কম নেই। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নিকট অতীতের বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নের সঙ্গে বেইমানি! অতএব জনগণ অবশ্যই ভেবে দেখবে, ন্যাড়া মাথা বেলতলায় কয়বার যাবে!

শুধু নির্বাচনপন্থী দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি অন্যতম, জামায়াতও সেই পথের পথিক। আরও অনেক বামপন্থী বলে পরিচিত রাজনৈতিক দল উচ্চ কণ্ঠে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। যদিও কোনো রাজনৈতিক দলকে বামপন্থী বলে আখ্যায়িত করলে তার চরিত্র কিছুই বোঝা যায় না। একমাত্র গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমেই কোনো ফ্যাসিবাদী কনস্টিটিউশনকে গণমুখী বা গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশনে রূপান্তর করা যায়—এ কথা নির্বাচনের দাবিদার দলগুলো জেনেশুনেই এখনই নির্বাচনের দাবি তুলছে।

তাদের দাবি, নির্বাচিত পার্লামেন্টই রাষ্ট্র সংস্কার করবে। কিন্তু তারা প্রকাশ্যভাবে বলার নৈতিক সাহস হারিয়েছে যে সাবেক বা বর্তমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও তার সংবিধান তারা রক্ষা করতে চায়! জনগণকে খুশি করার জন্য তাদেরও বলতে হচ্ছে, তারাও রাষ্ট্র সংস্কার চায়। পক্ষান্তরে ‘এখনই নির্বাচন দাও’ কথার অন্তর্নিহিত মর্ম হচ্ছে পুরোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও তার সংবিধানকে রক্ষা করা এবং ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারকে ভূলুণ্ঠিত করা। বলাই বাহুল্য, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে স্বয়ং বাহাত্তরের সংবিধানেই। অতএব গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংবিধানসভা একমাত্র পুরোনো ফ্যাসিবাদী সংবিধানের খোলনলচে বদলে নতুন গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশনের রূপদান করতে পারে।

অতীতে যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন শুধু নির্বাচনের দাবিতে যুগব্যাপী আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরা ফ্যাসিবাদী একরোখা সরকারের নটবল্টু ঢিলা করতে পারেননি। কারণ, ব্যাপক জনগণ তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিটি ছিল শুধু ৩০০ জন কোটিপতির পার্লামেন্টের ভোটে দাঁড়িয়ে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে গদি দখলের রাজনৈতিক দাবি।

এটা দৈনন্দিন জীবনে বৈষম্যের হাহাকারে দিনাতিপাত করা নানা পেশাজীবী ও কৃষক-মজুর-শ্রমিকের বা কোনো মধ্যবিত্তের দাবি ছিল না। অতএব সেই আন্দোলন ব্যর্থ না হয়ে যায়নি। সাধারণ মানুষের ব্যর্থ দিনযাপনের অবসানের দাবি ছাড়া কোনো আন্দোলন সফল হতে পারে না। এই সাধারণ সত্য আড়াল করার জন্যই অনেকে ২৪ জুলাইয়ের সফল অভ্যুত্থানের পেছনে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করেছে।

এখন যে বিতর্ক দৃশ্যমান হচ্ছে, ফ্যাসিবাদী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জনগণের অংশগ্রহণে একটি সফল অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর একটি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন হাজির করার দায়িত্ব কার—সরকার গঠন করার জন্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের, নাকি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন তৈরির জন্য নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের বা সংবিধানসভার? ইতিহাস বলে, অবশ্যই এ কাজ করতে পারে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংবিধানসভা।

একটি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন তৈরির প্রক্রিয়া সেই পথেই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি বা সংবিধানসভার ধারণা অনেকটা অনালোচিত বলা যায়।

এ ধারণার বিতর্কটি শুধু ২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের পর উঠেছে বলে এখনো জনগণের কাছে, এমনকি রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেও ধারণাটির অস্পষ্টতা কাটেনি। যতই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা জনগণের সামনে হাজির করবে, ততই গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ ঘটবে বলে আশা করি।

মকবুল আহমেদ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সাবেক অধ্যক্ষ। সাবেক সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)।

ই-মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মিয়ানমারকে ৩০ লাখ ডলার অনুদান দেবে এডিবি
  • বিএনপি কখনো বলেনি আগে নির্বাচন পরে সংস্কার, ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে: মির্জা ফখরুল
  • কোন কোন উপদেষ্টাকে সরাতে বলেছেন মির্জা ফখরুল
  • শুনেছি লাখের কাছাকাছি ‘আওয়ামী সন্ত্রাসী’ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে: তথ্য উপদেষ্টা
  • ম্যারাডোনাকে হত্যা করা হয়েছে
  • নির্বাচনের পর সংস্কার: নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা কি ভুলে যাব
  • মোনাজাতে ‘খালেদা জিয়ার নাম না নেওয়ায়’ ইমামকে যুবদল নেতার হুমকি
  • ঈদের মোনাজাতে ‘খালেদা জিয়ার নাম না নেওয়ায়’ ইমামকে হুমকি
  • ঈদের মোনাজাতে ‘খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা না করায়’ ইমামকে যুবদল নেতার হুমকি
  • পিআইও কার্যালয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণের পর মদন উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতিকে অব্যাহতি