নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ভয়াবহ ও নৃশংস নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রাকিবুল ইসলাম।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক টাইমলাইনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নৃশংসতা, স্বপ্ন ও পঙ্গুত্ব’ শীর্ষক একটি স্ট্যাটাসে ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

ওই স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, “২০১৩ সালের ১০ ফ্রেবুয়ারি, আসর নামাজের পর আনুমানিক বিকাল ৫টার সময় আমি হাজী মো.

মহসিন হলে নিজ রুম নম্বর ৫৫৫ তে পড়াশোনা করছিলাম। হঠাৎ হেলাল উদ্দিন সুমন আমার রুমে আসে এবং জানায় যে, গোলাম রসুল বিপ্লব আমাকে তার রুমে (৪৬২ নম্বর) ডেকেছে। সুমন আমার জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তার কথার মধ্যে বেয়াদবি ও উগ্রতা ছিল। আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে আবু জাহিদ রিপন, জাহিদুল ইসলাম, আহসান হাবিব রানা ও হেলাল উদ্দিন সুমন আমার রুমে আসে। ওরা সবাই মিলে আমাকে রুম থেকে টেনেহিঁচড়ে ৪৬২ নম্বর রুমে নিয়ে যায়।”

স্ট্যাটাসে তিনি আরো বলেন, “সেখানে আমি জহিরুল ইসলাম ওরফে সরকার জহির রায়হান, ফরহাদুজ্জামান তুষার ও দেওয়ান বদরুল হাসান তুষারদের দেখতে পাই। আবু জাহিদ রিপন আমার মোবাইল নিয়ে বলে, তুই তো শিবির করিস। এই বলে সে আমার মোবাইল চেক করে। এরপর বলে যে, তুই তো হলের সভাপতি। তুই অনেক চালাক। সেজন্য তোর মোবাইলে কিছু নাই। এ কথা বলার পরই আবু জাহিদ রিপন আমাকে থাপ্পর ও ঘুষি মারা শুরু করে। সাথে সাথে মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, জাহিদুল ইসলাম, আহসান হাবিব রানা ও হেলাল উদ্দিন সুমন আমার উপর বর্বর ও হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে এবং আমার মুখে, বুকে ও পিঠে লাথি মারতে শুরু করে।”

অমানবিক কায়দায় তারা আমার উপর অত্যাচার শুরু করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি ফ্লোরে পড়ে গেলে ওরা রুমে থাকা লাঠি, রড, লোহার পাইপ, ব্যায়াম সামগ্রী বের করে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অনবরত পিটাতে থাকে। আমাকে মারায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, আবু জাহিদ রিপন ও জাহিদুল ইসলাম। তাদের অত্যাচারে পিপাসার্ত ও দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে আমি পানি চাইলে ওরা তাদের প্রস্রাব বোতলে করে নিয়ে এসে বলে, এই নে পানি না প্রস্রাব খা।”

তিনি আরও বলেন, “ধারাবাহিকভাবে মেরে ক্লান্ত হয়ে গেলে ওরা আমাকে ৪ তলার ৪৬২ নম্বর রুমের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় (উল্লেখ্য, রুমের জানালায় কোন গ্রিল ছিল না)। উপর থেকে পড়ে আমার দুই পা ভেঙে ১৩ টুকরা হয়ে যায়। আমার দুটো পা মাটিতে ডেবে যায়। আহত অবস্থায় আমি ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোনরকম হাঁটতে  হাঁটতে (হাঁটুতে ও হাতে ভর করে) রেজিস্ট্রার ভবনের কাছে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়ির নিচে আশ্রয় নেই (উল্লেখ্য, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে শাহবাগ মোড়ে শুরু হয়ে অব্যাহত থাকা গণজাগরণ মঞ্চের কারণে ক্যাম্পাসে কোন রিক্সা বা যানবাহন ছিল না)। মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, আবু জাহিদ রিপন, দেওয়ান বদরুল হাসান তুষার ও জাহিদুল ইসলাম আমার খোঁজ পেয়ে দ্রুত রেজিস্ট্রার ভবনে আসে এবং ওখান থেকে আমাকে টেনেহিঁচড়ে বস্তার মত করে রিক্সায় তুলে হলে নিয়ে যায়।”

হলের হাউজ টিউটরবৃন্দ বাঁধা প্রদান করলে তারা তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ওরা আমাকে আবার ৪৬২ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। সেখানে রানা, মেহেদী, রিপন, বিপ্লব ও জাহিদ আমাকে আবার মারতে শুরু করে। পরবর্তীতে ওরা আমাকে ধরে হল প্রোভোস্টের রুমে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় সিড়ির সাথে আমার মাথা বাড়ি দেয়। আমার সেন্স কিছুটা কার্যকর হওয়ার কারণে হাত দিয়ে তখন রক্ষা পাই। সেখানে রানা, মেহেদী, রিপন, বিপ্লব ও জাহিদদের সাথে এবি সিদ্দিক রাহাত যোগ দেয় এবং লাঠি-রড দিয়ে আমার মাথায়, পিঠে, বুকেসহ সমস্ত শরীরে আঘাত করে। রাহাত আমার বুকের ওপর উঠে দাড়িয়ে গালিগালাজ করে। এশার আজান দেওয়া পর্যন্ত সবাই মিলে এভাবে নির্যাতন করতে থাকে।”

“আমিতো ভেবেছিলাম এ জীবনের হয়ত আর বাবা-মাকে দেখতে পারব না। পরিবারের সদস্য ও ভাই-বোনদের মুখগুলো বারবার আমার চোখে ভাসছিল। এ কেমন নির্যাতন! ওরা আমাকে প্রথম পর্যায়ে মেরে রুমের জানালা দিয়ে ফেলে দিল। তখনই তো আমি পঙ্গু প্রায়। ভেবেছিলাম এ যাত্রায় হয়ত বেঁচে যাব। একটা ছেলেকে পঙ্গু করেও ওরা ছাড়ল না। আবার হলে এনে ইচ্ছামত মারল। বিশ্বাস করেন, আমার শরীরটা আর নিতে পারছিল না,” যুক্ত করেন তিনি।

রাকিবুল ইসলাম বলেন, “সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমরা অভিভাবক ভাবি। অথচ দেখেন তারা আমার সাথে কেমন আচরণ করল! হল প্রোভোস্ট আলী আক্কাস ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর এ এম আমজাদ আমার নির্যাতনের খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমি ও অন্য দুই ভিকটিমদের বাঁচাতে তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং ওদের নির্বিঘ্নে নিযার্তনের সুযোগ করে দিয়েছে। ওরা নিযার্তন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পুলিশ ডেকে পুলিশের গাড়িতে আমাকে তুলে দেয়। তখন পুলিশ আমার অবস্থা বেশি একটা ভালো না দেখে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায় আমার উভয় পা বিভিন্ন স্থানে ভেঙে ১৩ টুকরা হয়ে গিয়েছে। এতটা নিযার্তনের পরেও ওদের অত্যাচার ও জীবননাশের হুমকির কারণে আমি পরবর্তীতে একাডেমিক ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি।”

রাকিবুল ইসলাম আরো বলেন, “আমার নির্যাতিত হওয়ার খবর পেয়ে আমার আম্মা ফিরোজা বেগম ও দুলাভাই জাকির হোসেন খান আমাকে ছাড়ানোর জন্য প্রক্টর এ এম আমজাদ এর কাছে যায়। সে তখন বলে যে, ‘এই ছেলে অনেক বড় নেতা তাকে ছাড়া হবে না।’ আমার মা ও ভাইদের সাথে প্রক্টর আমজাদ অনেক খারাপ ব্যবহার করে। ওদের অত্যাচারে আমি মানষিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

তিনি লেখেন, “অদ্যবধি আমি ওদের আঘাতের ফলে শারীরিক ক্ষতি বয়ে বেড়াচ্ছি। ওদের নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে আমি আমার সন্তানকে কোলে নিতে পারি না। দুনিয়াতে বাবা হিসেবে এর চেয়ে বড় কষ্ট কি হতে পারে বলেন! ওরা আমার সন্তানের হক কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমি এখনো কোনকিছু ঠিকমত ধরতে পারি না, ভালোভাবে দাঁড়িয়ে-বসে নামাজ পড়তে পারি না। সিড়িতে উঠতে কষ্ট হয়, কোন ধরনের চাপ নিতে পারি না, রোদে গেলে মাথা ও দাঁতে ভীষণ জ্বালাপোড়া করে, রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না, প্রায়ই ঘুমের মধ্যে ওইদিনের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। প্রায়ই হঠাৎ বমি হতে থাকে এবং স্বাভাবিক চলাফেরা বা বসতে পারি না। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সকল অঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ব্যথা এবং কষ্ট অনুভব হয়।”

দেশে-বিদেশে অনেক ডাক্তার দেখিয়েও সমাধান হয়নি উল্লেখ করে তিনি আরো লেখেন, “এখনো ছাত্রলীগের নির্যাতনে পঙ্গু হওয়া শরীরটা নিয়ে দিকবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছি। এই আশায় যে, আমি ভালোভাবে দাঁড়িয়ে-বসে নামাজ পড়তে পারব ও আমার সন্তানকে একটু ভালোকরে কোলে নিতে পারব। সমাজে একটু স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারব। জানি না মহান মনিব তাঁর আশ-শাফি (রোগ নিরাময়কারী) নামের উসিলায় আমার প্রতি রহম করবেন কি-না।”

ওই স্ট্যাটাসে রাকিবুল ইসলাম তার ওপর নির্যাতনকারীদের পরিচয় দিয়েছেন। অভিযুক্ত নির্যাতনকারী সরকার জহির রায়হান ২০০৯-১০ সেশনের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মুহসিন হল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, বাড়ি চাঁদপুর। নির্যাতনকারী এবি সিদ্দিক রাহাত শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ২০০৭-৮ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন, তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে। বর্তমানে তিনি এনএসআই এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে চাকরি করছেন।

অভিযুক্ত নির্যাতনকারী হেলাল উদ্দিন সুমন পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন, তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে। অভিযুক্ত মেহেদী হাসান ২০০৮-০৯ সেশনের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মহসিন হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাড়ি ঝিনাইদহ।

অভিযুক্ত আবু জাহিদ রিপন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬-০৭ সেশনের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বর্তমানে মতিঝিলে সাউথইস্ট ব্যাংকের দিলকুশা ব্রাঞ্চে চাকরি করছেন, বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। অভিযুক্ত গোলাম রসুল বিপ্লব ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০০৬-০৭ সেশনের শিক্ষার্থী, বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনিতে। অভিযুক্ত আহসান হাবিব রানা ২০০৭-০৮ সেশনের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, বাড়ি ঝিনাইদহ। বর্তমানে তিনি একটি প্রাইভেট ল ফার্মে কর্মরত আছেন।

অভিযুক্ত নির্যাতনকারী দেওয়ান বদরুল হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ সেশনের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, বাড়ি ফেনী। বর্তমানে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। অভিযুক্ত জাহিদুল ইসলাম (মোহাব্বত) ২০০৮-০৯ সেশনের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে। বর্তমানে তিনি যশোরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত মুহসিন হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ আলী আক্কাস বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক। অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন প্রক্টর ড. এ এম আমজাদ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক।

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ হ দ ল ইসল ম র ক ব ল ইসল ম হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

ছাত্রলীগের নির্যাতনে পঙ্গু ঢাবি শিক্ষার্থী রাকিবুল, লিখলেন নৃশংসতার গল্প

নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ভয়াবহ ও নৃশংস নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রাকিবুল ইসলাম।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক টাইমলাইনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নৃশংসতা, স্বপ্ন ও পঙ্গুত্ব’ শীর্ষক একটি স্ট্যাটাসে ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

ওই স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, “২০১৩ সালের ১০ ফ্রেবুয়ারি, আসর নামাজের পর আনুমানিক বিকাল ৫টার সময় আমি হাজী মো. মহসিন হলে নিজ রুম নম্বর ৫৫৫ তে পড়াশোনা করছিলাম। হঠাৎ হেলাল উদ্দিন সুমন আমার রুমে আসে এবং জানায় যে, গোলাম রসুল বিপ্লব আমাকে তার রুমে (৪৬২ নম্বর) ডেকেছে। সুমন আমার জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তার কথার মধ্যে বেয়াদবি ও উগ্রতা ছিল। আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে আবু জাহিদ রিপন, জাহিদুল ইসলাম, আহসান হাবিব রানা ও হেলাল উদ্দিন সুমন আমার রুমে আসে। ওরা সবাই মিলে আমাকে রুম থেকে টেনেহিঁচড়ে ৪৬২ নম্বর রুমে নিয়ে যায়।”

স্ট্যাটাসে তিনি আরো বলেন, “সেখানে আমি জহিরুল ইসলাম ওরফে সরকার জহির রায়হান, ফরহাদুজ্জামান তুষার ও দেওয়ান বদরুল হাসান তুষারদের দেখতে পাই। আবু জাহিদ রিপন আমার মোবাইল নিয়ে বলে, তুই তো শিবির করিস। এই বলে সে আমার মোবাইল চেক করে। এরপর বলে যে, তুই তো হলের সভাপতি। তুই অনেক চালাক। সেজন্য তোর মোবাইলে কিছু নাই। এ কথা বলার পরই আবু জাহিদ রিপন আমাকে থাপ্পর ও ঘুষি মারা শুরু করে। সাথে সাথে মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, জাহিদুল ইসলাম, আহসান হাবিব রানা ও হেলাল উদ্দিন সুমন আমার উপর বর্বর ও হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে এবং আমার মুখে, বুকে ও পিঠে লাথি মারতে শুরু করে।”

অমানবিক কায়দায় তারা আমার উপর অত্যাচার শুরু করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি ফ্লোরে পড়ে গেলে ওরা রুমে থাকা লাঠি, রড, লোহার পাইপ, ব্যায়াম সামগ্রী বের করে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অনবরত পিটাতে থাকে। আমাকে মারায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, আবু জাহিদ রিপন ও জাহিদুল ইসলাম। তাদের অত্যাচারে পিপাসার্ত ও দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে আমি পানি চাইলে ওরা তাদের প্রস্রাব বোতলে করে নিয়ে এসে বলে, এই নে পানি না প্রস্রাব খা।”

তিনি আরও বলেন, “ধারাবাহিকভাবে মেরে ক্লান্ত হয়ে গেলে ওরা আমাকে ৪ তলার ৪৬২ নম্বর রুমের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় (উল্লেখ্য, রুমের জানালায় কোন গ্রিল ছিল না)। উপর থেকে পড়ে আমার দুই পা ভেঙে ১৩ টুকরা হয়ে যায়। আমার দুটো পা মাটিতে ডেবে যায়। আহত অবস্থায় আমি ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোনরকম হাঁটতে  হাঁটতে (হাঁটুতে ও হাতে ভর করে) রেজিস্ট্রার ভবনের কাছে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়ির নিচে আশ্রয় নেই (উল্লেখ্য, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে শাহবাগ মোড়ে শুরু হয়ে অব্যাহত থাকা গণজাগরণ মঞ্চের কারণে ক্যাম্পাসে কোন রিক্সা বা যানবাহন ছিল না)। মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, আবু জাহিদ রিপন, দেওয়ান বদরুল হাসান তুষার ও জাহিদুল ইসলাম আমার খোঁজ পেয়ে দ্রুত রেজিস্ট্রার ভবনে আসে এবং ওখান থেকে আমাকে টেনেহিঁচড়ে বস্তার মত করে রিক্সায় তুলে হলে নিয়ে যায়।”

হলের হাউজ টিউটরবৃন্দ বাঁধা প্রদান করলে তারা তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ওরা আমাকে আবার ৪৬২ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। সেখানে রানা, মেহেদী, রিপন, বিপ্লব ও জাহিদ আমাকে আবার মারতে শুরু করে। পরবর্তীতে ওরা আমাকে ধরে হল প্রোভোস্টের রুমে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় সিড়ির সাথে আমার মাথা বাড়ি দেয়। আমার সেন্স কিছুটা কার্যকর হওয়ার কারণে হাত দিয়ে তখন রক্ষা পাই। সেখানে রানা, মেহেদী, রিপন, বিপ্লব ও জাহিদদের সাথে এবি সিদ্দিক রাহাত যোগ দেয় এবং লাঠি-রড দিয়ে আমার মাথায়, পিঠে, বুকেসহ সমস্ত শরীরে আঘাত করে। রাহাত আমার বুকের ওপর উঠে দাড়িয়ে গালিগালাজ করে। এশার আজান দেওয়া পর্যন্ত সবাই মিলে এভাবে নির্যাতন করতে থাকে।”

“আমিতো ভেবেছিলাম এ জীবনের হয়ত আর বাবা-মাকে দেখতে পারব না। পরিবারের সদস্য ও ভাই-বোনদের মুখগুলো বারবার আমার চোখে ভাসছিল। এ কেমন নির্যাতন! ওরা আমাকে প্রথম পর্যায়ে মেরে রুমের জানালা দিয়ে ফেলে দিল। তখনই তো আমি পঙ্গু প্রায়। ভেবেছিলাম এ যাত্রায় হয়ত বেঁচে যাব। একটা ছেলেকে পঙ্গু করেও ওরা ছাড়ল না। আবার হলে এনে ইচ্ছামত মারল। বিশ্বাস করেন, আমার শরীরটা আর নিতে পারছিল না,” যুক্ত করেন তিনি।

রাকিবুল ইসলাম বলেন, “সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমরা অভিভাবক ভাবি। অথচ দেখেন তারা আমার সাথে কেমন আচরণ করল! হল প্রোভোস্ট আলী আক্কাস ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর এ এম আমজাদ আমার নির্যাতনের খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমি ও অন্য দুই ভিকটিমদের বাঁচাতে তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং ওদের নির্বিঘ্নে নিযার্তনের সুযোগ করে দিয়েছে। ওরা নিযার্তন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পুলিশ ডেকে পুলিশের গাড়িতে আমাকে তুলে দেয়। তখন পুলিশ আমার অবস্থা বেশি একটা ভালো না দেখে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায় আমার উভয় পা বিভিন্ন স্থানে ভেঙে ১৩ টুকরা হয়ে গিয়েছে। এতটা নিযার্তনের পরেও ওদের অত্যাচার ও জীবননাশের হুমকির কারণে আমি পরবর্তীতে একাডেমিক ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি।”

রাকিবুল ইসলাম আরো বলেন, “আমার নির্যাতিত হওয়ার খবর পেয়ে আমার আম্মা ফিরোজা বেগম ও দুলাভাই জাকির হোসেন খান আমাকে ছাড়ানোর জন্য প্রক্টর এ এম আমজাদ এর কাছে যায়। সে তখন বলে যে, ‘এই ছেলে অনেক বড় নেতা তাকে ছাড়া হবে না।’ আমার মা ও ভাইদের সাথে প্রক্টর আমজাদ অনেক খারাপ ব্যবহার করে। ওদের অত্যাচারে আমি মানষিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

তিনি লেখেন, “অদ্যবধি আমি ওদের আঘাতের ফলে শারীরিক ক্ষতি বয়ে বেড়াচ্ছি। ওদের নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে আমি আমার সন্তানকে কোলে নিতে পারি না। দুনিয়াতে বাবা হিসেবে এর চেয়ে বড় কষ্ট কি হতে পারে বলেন! ওরা আমার সন্তানের হক কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমি এখনো কোনকিছু ঠিকমত ধরতে পারি না, ভালোভাবে দাঁড়িয়ে-বসে নামাজ পড়তে পারি না। সিড়িতে উঠতে কষ্ট হয়, কোন ধরনের চাপ নিতে পারি না, রোদে গেলে মাথা ও দাঁতে ভীষণ জ্বালাপোড়া করে, রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না, প্রায়ই ঘুমের মধ্যে ওইদিনের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। প্রায়ই হঠাৎ বমি হতে থাকে এবং স্বাভাবিক চলাফেরা বা বসতে পারি না। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সকল অঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ব্যথা এবং কষ্ট অনুভব হয়।”

দেশে-বিদেশে অনেক ডাক্তার দেখিয়েও সমাধান হয়নি উল্লেখ করে তিনি আরো লেখেন, “এখনো ছাত্রলীগের নির্যাতনে পঙ্গু হওয়া শরীরটা নিয়ে দিকবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছি। এই আশায় যে, আমি ভালোভাবে দাঁড়িয়ে-বসে নামাজ পড়তে পারব ও আমার সন্তানকে একটু ভালোকরে কোলে নিতে পারব। সমাজে একটু স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারব। জানি না মহান মনিব তাঁর আশ-শাফি (রোগ নিরাময়কারী) নামের উসিলায় আমার প্রতি রহম করবেন কি-না।”

ওই স্ট্যাটাসে রাকিবুল ইসলাম তার ওপর নির্যাতনকারীদের পরিচয় দিয়েছেন। অভিযুক্ত নির্যাতনকারী সরকার জহির রায়হান ২০০৯-১০ সেশনের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মুহসিন হল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, বাড়ি চাঁদপুর। নির্যাতনকারী এবি সিদ্দিক রাহাত শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ২০০৭-৮ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন, তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে। বর্তমানে তিনি এনএসআই এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে চাকরি করছেন।

অভিযুক্ত নির্যাতনকারী হেলাল উদ্দিন সুমন পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন, তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে। অভিযুক্ত মেহেদী হাসান ২০০৮-০৯ সেশনের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মহসিন হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাড়ি ঝিনাইদহ।

অভিযুক্ত আবু জাহিদ রিপন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬-০৭ সেশনের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বর্তমানে মতিঝিলে সাউথইস্ট ব্যাংকের দিলকুশা ব্রাঞ্চে চাকরি করছেন, বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। অভিযুক্ত গোলাম রসুল বিপ্লব ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০০৬-০৭ সেশনের শিক্ষার্থী, বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনিতে। অভিযুক্ত আহসান হাবিব রানা ২০০৭-০৮ সেশনের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, বাড়ি ঝিনাইদহ। বর্তমানে তিনি একটি প্রাইভেট ল ফার্মে কর্মরত আছেন।

অভিযুক্ত নির্যাতনকারী দেওয়ান বদরুল হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ সেশনের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, বাড়ি ফেনী। বর্তমানে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। অভিযুক্ত জাহিদুল ইসলাম (মোহাব্বত) ২০০৮-০৯ সেশনের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে। বর্তমানে তিনি যশোরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত মুহসিন হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ আলী আক্কাস বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক। অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন প্রক্টর ড. এ এম আমজাদ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক।

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ