গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ করে ভারত যাওয়ার পর অনেক অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা আমাদের সামনে উত্থাপিত হয়েছে। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, কৃষক, রিকশাচালক, অটোচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে রাজপথে নেমে দাবি উত্থাপন করতে দেখা গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ছাত্রলীগের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও চোখে পড়েছে। ছাত্র সংগঠনটি এখন নিষিদ্ধ। তবে ২৬ জানুয়ারির (রোববার) দিবাগত রাতটি এ ক্ষেত্রে ভিন্নই বলতে হবে। কারণ তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘এলিটিজমের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।


২৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে যান। সে সময়কার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অধ্যাপক মামুন আহমেদ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উত্তেজিত আচরণ করছেন; যা কোনোভাবেই শিক্ষকসুলভ বলার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণ বিগত সরকারের আমলে যে প্রশাসন ছিল, তার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই অপ্রীতিকর ও উস্কানিমূলক আচরণের বিপরীতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা মামুন আহমেদের দুঃখপ্রকাশসহ কয়েক দফা দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি তখন সেই সংঘর্ষ থামাতে দৌড়ে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। যদিও তাতে আন্দোলন থামেনি, সংঘর্ষও হয়েছে; কিন্তু হাসনাত যে এমন বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে সেখানে গিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের, সে জন্য অবশ্যই তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। তিনি সে রাতের সংঘাত হয়তো থামাতে পারেননি; কিন্তু কিছুটা হলেও এর মাত্রা যে কমেছে তা বলাই বাহুল্য। সংঘর্ষে আহত হলেন সেই শিক্ষার্থীরা, যারা মাত্র কয়েক মাস আগে পতিত সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের গুন্ডাদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন; আবার এ সংঘর্ষ হয়েছে তাদের সঙ্গে, যারা সে সময় ছিলেন রাজপথের সহযোদ্ধা।


এর পরদিন সোমবার জানা গেল, ২০২৪-২৫ সেশন থেকে সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ভর্তি করা হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। কিন্তু সংকট কতটা কেটেছে? শিক্ষাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মতে, এই সংকটের শুরু ওই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঢোকানোর পর থেকেই। তিনি এই সংকটের মূলে হাত দেওয়ার কথা বলেন। আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই একটা সংকট। এতগুলো কলেজ, যেখানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী কোনোভাবেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার কাঠামো দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। এ জন্য একটি নয়, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লাগবে। এ ক্ষেত্রে কলেজগুলোকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাগ করতে হবে। এই সাতটি কলেজ নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে অথবা একটি বোর্ডের অধীনে আনা যেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাঙা দরকার। মনে হচ্ছে এটি চলছে; কিন্তু আসলে এটি চলছে না। পড়াশোনার মান, পরীক্ষা, শিক্ষক– সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরেই এর সমাধান চিন্তা করতে হবে। এ জন্য নড়াচড়া করতে হবে। চুপচাপ বসে থেকে আলস্য দেখালে হবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যথযথ সক্রিয় হওয়া দরকার। আগের সরকার বিষয়টি ফেলে রেখেছিল; এই অন্তর্বর্তী সরকারও এ বিষয়ে সমাধানের পথে সক্রিয় কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি।’


দুই.


এখন কেউ আর কলেজ থাকতে চায় না; সবাই বিশ্ববিদ্যালয় হতে চায়। এই সাত কলেজ যদি বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করে, তাহলে এমন আরও যেসব কলেজ আছে, সেগুলোও একই দাবি জানাতে পারে। সেই দাবি কি মেনে নেওয়া সম্ভব? এর পেছনে রয়েছে সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি। শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সেভাবে চোখে পড়ে না; যেমনটা আমাদের সমাজে দেখা যায় ‘কলেজ শিক্ষার্থী’র বদলে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী’ তকমার দাম বেশি; আবার প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা বা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা অথবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার সার্টিফিকেটের তুলনা। অথচ কোনো শহরতলির কলেজে পড়া একজন শিক্ষার্থী সমাজে যে ভালো কিছু করতে পারেন, সেই বাস্তবতা আমরা তৈরি করতে পারিনি। এর পেছনে রয়েছে অর্থনীতির সঙ্গে কর্মসংস্থান এবং কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিক্ষার আন্তঃসম্পর্ক তৈরি করতে না পারা।


বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পর উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণার জায়গা। এখানে সবাই আগ্রহী নাও হতে পারে বা সবার প্রয়োজন নাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবে এবং সমাজের বিভিন্ন দিকের তাগিদ অনুযায়ী গবেষণা করবে। শুধু ক্লাসরুমে পড়ানো আর সার্টিফিকেট দেওয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হবে বিশ্বজ্ঞান এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। বাংলাদেশে ষাটের দশকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন, শিক্ষকরাও আন্দোলন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ওঠে। পরে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।


এখন ৫০টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; অথচ ওই চারটি বাদে আর কোনো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেটাও গত কয়েক দশকে ভেঙে পড়েছে। বিগত সরকারের আমল থেকে তা পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে। তখন থেকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা হয়ে ওঠে সরকারের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের একটি সম্প্রসারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সৃষ্টির কি হবে না হবে, সেটা ঠিক করেছে সরকার ও তার আজ্ঞাবহ প্রশাসন। জ্ঞানচর্চার বেশি দরকার নেই, তার দরকার অনুগত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠী; যারা সরকারকে সেবা করবে, সরকার যা বলবে সেটাকে সমর্থন করবে– এ ধরনের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন বদলে এখন যাদের নেওয়া হচ্ছে, তারাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন; কারণ এই শিক্ষকরাও দলবাজ। এর বাইরে লবিংমুক্ত নিয়োগ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা যায়নি। বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন বা সংস্কার না হলে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক দু’দিকেই আধিপত্যের দলবাজি রাজনীতি চলতে থাকবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে এবং শিক্ষক যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান, তাদের পক্ষেও কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে।


তিন.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার মাধ্যমে সাত কলেজের সংকট শেষ হয়নি। কিন্তু কলেজগুলো নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে এখনও তেমন কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এ ক্ষেত্রে প্রথমত, সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা এখানে তুলে ধরা হলো–


১. কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করে সমাধান আসবে না। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে দিয়ে কয়েকটি কলেজ নিয়ে একেকটি আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে।
২. ওই বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড কর্তৃক কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন তদারক করা হবে।
৩. প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
৪. শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা সীমিত করা যেতে পারে।
৫. ভর্তি পরীক্ষা এবং সেমিস্টার পরীক্ষায় মান নিয়ন্ত্রণ করা হবে কেন্দ্রীয়ভাবে।
৬. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি নির্ধারণে সম্ভাব্য বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডের বিশেষায়িত কমিটি থাকবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডের প্রশাসনিক ও পরিচালনা কমিটিতে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে। 
৮. সব কলেজের সুযোগ-সুবিধা একরকম নয়। এ জন্য কলেজগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। 
৯. গবেষণার জন্য যৌক্তিক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
১০. পাঠদান বাদে সব কাজ অনলাইনে নিশ্চিত করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অনলাইন তথ্য হস্তান্তর করা হবে। এ জন্য ডেটাবেজ আপডেটসহ শিক্ষার্থীদের সার্বিক সহযোগিতায় বিশেষায়িত বিভাগ থাকতে হবে।


শাহেরীন আরাফাত: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
shaherin.arafat1@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ত কল জ স ত কল জ র শ ক ষ র থ ন শ চ ত কর ত সরক র র স ঘর ষ এ জন য দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি

প্রতিবছর সারা বিশ্বে ১ মার্চ আন্তর্জাতিক বৈষম্যবিহীন দিবস হিসেবে পালিত হয়। অর্থাৎ সেদিন নতুন করে উচ্চারিত হয় যে সারা বিশ্ব যেন শূন্য-বৈষম্যের বিশ্ব হয়। অসমতা বা বৈষম্যের আলোচনায় বারবার উঠে আসে অর্থনৈতিক অসমতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য। তাই আয়ের বৈষম্য কিংবা সম্পদের অসমতা নিয়ে সবাই সোচ্চার।

একইভাবে, ফলাফলের অসমতা নিয়ে যত কথা হয়, সুযোগের বৈষম্য নিয়ে তত কথা হয় না। অসমতা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান অঙ্গনে প্রতিফলিত হতে পারে—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক অঙ্গনে। বৈষম্য ঘটে ঘরে, বাইরে, দেশজ পরিপ্রেক্ষিতে, আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে অসমতা কিংবা বৈষম্য শুধু শুদ্ধ অর্থনৈতিক বিষয়ই নয়, এর একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রিকতাও আছে। আসলে বৈষম্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার লঙ্ঘন, সামাজিক ন্যায্যতার দলন ও অন্যায্য পক্ষপাত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বৈষম্য অত্যন্ত গভীর—সত্যটি অতীত ও নিকট অতীতে বারবারই পরিলক্ষিত হয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক আলোচনা বা বিতর্কের জায়গাটি সরকারি দল কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে দখল করে রাখে ও বিরোধী দলের সব কর্মকাণ্ড নিষ্পেষিত হয়। প্রহসনমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেওয়া হয় না এবং সেই জায়গায় সরকারি দল একচ্ছত্রভাবে বিরাজ করে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা যদি বলি, তাহলে সেখানে যেকোনো রকমের বিকল্প মতকে শায়েস্তা করেছে ক্ষমতাসীন দল। জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা, অন্যান্য পেশাজীবী, সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে।

ভিন্নতর মত, অন্য রকমের দৃষ্টিভঙ্গি, কোনোরকমের সমালোচনাই সহ্য করা হতো না।
দেশের নীতিমালা নির্ধারণে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। সেখানে বিত্ত ও ক্ষমতার পক্ষপাত ছিল সুস্পষ্ট। দরিদ্র, প্রান্তিক গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যাশা এবং চাওয়া-পাওয়া কখনো ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।

নানান সময়ে লোকদেখানো অংশগ্রহণমূলক আলাপ-আলোচনার একটা ভাব তৈরী করা হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো কার্যকর কোনো জন–অংশগ্রহণ ছিল না। নারী জনগোষ্ঠী নানান সময়ে কথা বলেছেন বটে, কিন্তু কখনোই তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

দেশের যে জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক অঙ্গনের কণ্ঠস্বরের ক্ষেত্রে প্রান্তিক সীমায় রেখে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা হচ্ছেন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। তাঁদের আমরা সব সময় দেশের ভবিষ্যৎ করে রেখে দিয়েছি, তাঁদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি। তরুণ সমাজের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আমরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতাকে আমাদের সমাজ বিবর্তন ও সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারিনি। তরুণ-শক্তির এ অপচয় বৈষম্যের এক বিশাল নেতিবাচক ফলাফল।

সামাজিক দিক থেকে ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, আশরাফ-আতরাফের বৈষম্য আমাদের সমাজে আজও বিদ্যমান। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধায় বঞ্চিত। তারা বঞ্চিত সম্পদে, ঋণ সুবিধায়, তথ্যপ্রযুক্তি সেবায়। এ কারণে কর্মনিয়োজন ও আয়ের দিক থেকেও তারা বঞ্চণার শিকার হয়।

পরিবেশ-নাজুক অঞ্চলে যেসব প্রান্তিক মানুষের বাস, তাঁরাও ক্রমবর্ধমান অসমতার শিকার হন। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যকার নিম্নবর্ণের মানুষেরা এবং আশরাফ-আতরাফদের মধ্যে আতরাফেরা সামাজিক বৈষম্যমূলক একটি স্থানে অবস্থান করেন। সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশে নগর ও পল্লির মধ্যকার বৈষম্যের কথা সুবিদিত।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতার প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে? রাজনৈতিক অঙ্গনে মানুষকে একটি জায়গায় বড় সুযোগ দিত হবে, তাঁরা বলবেন কোন কোন অর্থনৈতিক অসমতার প্রতিকার তাঁরা চান। এটা বলার জায়গা ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের থাকতে হবে।

সমাজ অঙ্গনে ধর্মীয় বৈষম্যের কথা বারবার নানান আলোচনায় উঠে এসেছে। নানান সময়ে নানান ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের নিরাপত্তার অভাবের কথা উল্লেখ করেছে, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্যাহত করার অভিযোগও উঠেছে। এসবই বৈষম্যমূলক আচরণ। কারণ, ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিকেরই সমান অধিকার।

সামাজিক অঙ্গনে অসমতা শুধু সামষ্টিক পর্যায়েই বিরাজ করে না, একধরনের বৈষম্য ব্যষ্টিক ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। যেমন পরিবারের মধ্যে নারীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, খাদ্যগ্রহণ, মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আর্থিক স্বাবলম্বনের ক্ষেত্রে একটি লক্ষ্যণীয় বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়। বয়োকনিষ্ঠদের মতামতও পরিবারের মধ্যে উপেক্ষিত হয়। কর্মক্ষেত্রেও ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যে নানান মাত্রিকতার বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়।

সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বহু বৈষম্য লক্ষণীয়। নগর সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্র ও সরকার প্রায়ই যতটা উদ্‌গ্রীব থাকে, গ্রামীণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহ অনেক সময়ে ততটা পরিলক্ষিত হয় না। বহু ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিল্প ও সংস্কৃতিকে মূল ধারায় প্রবিষ্ট করার জন্য একটি অনধিকার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তেমনিভাবে যেসব অঞ্চলে

এসব গোষ্ঠী বসবাস করে থাকে, সেখানকার শিক্ষালয়ে শিক্ষা প্রদান সেসব গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় না হয়ে বাংলা মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এ–ও লক্ষ করা গেছে যে ওই সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য রাষ্ট্রীয় সাহায্য, সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। এসব মিলিয়েই একটি সাংস্কৃতিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে তাঁদের পরিপ্রেক্ষিতে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একটি সমাজকে সমৃদ্ধ ও বেগবান করে।

বাংলাদেশের সমাজে মানসিক বৈষম্যের কথাও বহুজন বলেছেন। আমাদের সমাজে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধীগোষ্ঠীকে হীন বলে মনে করা হয় এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। তাদের অবস্থাকে আমরা সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দিয়ে দেখি না, তাদের বিষয়গুলো আমরা সঠিকভাবে বিবেচনা করি না।

তেমনিভাবে মানুষের প্রতি আচরণে আমরা বৈষম্যমূলক আচরণ করি। আমরা বহু সময়ে মানুষের ন্যূনতম সম্মানটুকু মানুষকে দিই না, যদি সেই মানুষটি হয় দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ। এটাও মানসিক বৈষম্যের একটি মাত্রিকতা।

একটি সমাজের অর্থনৈতিক অসমতাও শুধু একটি শুদ্ধ অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, অসমতা সমাজের ক্ষমতা-সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আসলে, সমাজের অর্থনৈতিক অসমতা এবং ক্ষমতা-সম্পর্ক পরস্পর পরস্পরকে জোরালো করে। অর্থনৈতিক সম্পদের ভিন্নতা সমাজে ধনী এবং দরিদ্র্য এ প্রান্তিক মানুষের এই অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক বিত্তবান ও ক্ষমতাশীল মানুষদের আরও বিত্ত গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

এই প্রক্রিয়ায় পুরো ব্যাপারটিই রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ী একটি স্থান করে নেয়, যার ফলে রাষ্ট্র নিজেই একটি স্বার্থান্বেষী মহলে পরিণত হয়। এর ফলে, দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠী আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারা রাজনৈতিক বলয়ে, সামাজিক গতিময়তায় এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় আরও বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়ে। এমনকি আইনের চোখেও তারা সুবিচার পায় না।

সুতরাং এ অবস্থায় মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায্যতা বিষয়টি শুধু কথার কথায় পর্যবসিত হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতা নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন অসমতা মানবাধিকার ও মানব–মর্যাদার পরিপন্থী।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতার প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে? রাজনৈতিক অঙ্গনে মানুষকে একটি জায়গায় বড় সুযোগ দিত হবে, তাঁরা বলবেন কোন কোন অর্থনৈতিক অসমতার প্রতিকার তাঁরা চান। এটা বলার জায়গা ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের থাকতে হবে। আসলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শুধু যে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে তা–ই নয়, সেই সঙ্গে অসমতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণকেও তাঁরা প্রভাবিত করতে পারবে।

যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক সেবার বলয়ে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর যে শুধু এসব সেবার প্রসারণ ঘটাবে তা–ই নয়, সেই সঙ্গে এসব সেবা সুযোগের গুণগত মান যে ভালো হয়, তা নিশ্চিত করা যাবে। ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরাও উন্নতমানের সামাজিক সুযোগ পাবেন।

বৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হলে, সেটার একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিপ্রেক্ষিত থাকতে হবে, সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের একটা দায়িত্ব থাকা প্রয়োজন। আমাদের চেতনায় এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে, আমাদের আচার-আচরণে, আমাদের কর্মকাণ্ডে আমরা প্রত্যেকে যদি সমতার প্রতি শ্রদ্ধাবান হই, তাহলে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে সেটা একটি বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করবে। সেই সঙ্গে যুক্ত হতে হবে সমাজের কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্রের কার্যক্রমে।

সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন, ইউরোপকে একলা চলতে হবে
  • আপনার আচরণ এমন হবে ভাবিনি: জামিলকে নূনা আফরোজ
  • সরকার জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মর্মবস্তু ধারণ করতে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে
  • ‘মাফিয়া বসদের মতো’ আচরণ করেছেন ট্রাম্প
  • ক্ষমতা অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • ক্ষমতার অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • রিয়াল মাদ্রিদকে বড় অঙ্কের জরিমানা উয়েফার
  • গার্দিওলার সঙ্গে সমর্থকদের বাজে আচরণে জরিমানা রিয়ালের
  • তরুণদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি