'পানিযুদ্ধের' পথে চীন ও ভারত, প্রবল ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
Published: 28th, January 2025 GMT
স্থানীয়দের বিক্ষোভ উপেক্ষা করে অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নদীর ওপর বাঁধ দিতে যাচ্ছে ভারত, উদ্দেশ্য হলো একই নদীর উজানে চীনের তৈরি বাঁধকে টেক্কা দেওয়া। কিন্তু এই দুই পাল্টাপাল্টি বাঁধ তৈরির দৌড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভাটির বাংলাদেশ।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নদীর ধারে জড়ো হয়েছেন একদল বিক্ষোভাকারী। পড়ন্ত বিকেলে শীত উপেক্ষা করে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
"আনে সিয়াং [সিয়াং মা] এর ওপর কোনো বাঁধ হবে না," পারং গ্রামের বিক্ষোভকারীদের স্লোগানে শোনা যায়।
পারং গ্রাম এবং আশেপাশের এলাকায় বাস করেন কৃষিজীবী 'আদি' নৃগোষ্ঠীর মানুষ। শত শত বছর ধরে অরুণাচলের পাহাড়ী এলাকায় বয়ে চলা সিয়াং নদীকে পবিত্র মেনে আসছেন তারা। কিন্তু বর্তমানে এই নদী, তাদের গ্রাম, এমনকি তাদের জীবিকা পড়তে যাচ্ছে হুমকির মুখে। কারণ সিয়াং নদীর ওপর তৈরি হতে যাচ্ছে ভারতের বৃহত্তম বাঁধ। রিপোর্ট- আল জাজিরা।
ভারত সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক ১৩.
তবে বাঁধ তৈরির খবরে অসন্তুষ্টির ছায়া নেমে এসেছে সিয়াং নদীর অববাহিকায় বসবাস করা কৃষিজীবী মানুষের মনে। সিয়াং নদীতে বাঁধ দিলে পুরোপুরি তলিয়ে যাবে অন্তত ২০টি গ্রাম, এছাড়া আংশিক নিমজ্জিত হবে ভাটির আরও ১২টি গ্রাম। ঘরছাড়া হয়ে পড়বে হাজারো মানুষ।
এলাকাবাসীর বিক্ষোভ দমন করতে আধা-সামরিক বাহিনী নামাতে নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকার। তবে এখনো এই অঞ্চলে কোনো সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি।
"সরকার আমাদের জমি নিয়ে নিচ্ছে, আমাদের সিয়াং মা’কে নিয়ে নিচ্ছে, এখানে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলায় পাঁয়তারা করছে। আমরা তা হতে দিতে পারি না," বলেন স্থানীয় বাসিন্দা গেগং জিজং। তিনি সিয়াং আদিবাসী কৃষক ফোরামের প্রধান।
"আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ এই বাঁধ হতে দেবো না।"
ভারত সরকারের মতে, বিক্ষোভাকারীরা ভুল বুঝছেন। অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু দাবী করেন, এই বাঁধের উদ্দেশ্য শুধু পানিবিদ্যুৎ নয়, বরং সিয়াং নদীকে বাঁচানো।
কিন্তু কার হাত থেকে সিয়াং নদীকে বাঁচাতে চাইছে ভারত?
উত্তর হলো- চীন।
দুই দেশের ঠুনকো সম্পর্ক
ভূরাজনৈতিক কারণে পানি সরবরাহ, পানি নিরাপত্তা নিয়ে অনেকদিন ধরেই ভারত ও চীনের মাঝে রয়েছে রেষারেষি। এর রেশ ধরে সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনাও দেখা যাচ্ছে কিছু বছর যাবত।
যে সিয়াং নদী নিয়ে দুই দেশের মাঝে অশান্তি চলছে, তার উৎপত্তি তিব্বতের মেদং এলাকায়, কৈলাস পর্বতে। স্থানীয়ভাবে নদীটির নাম ইয়ারলুং জাংবো/সাংপো। তিব্বত থেকে নদীটি অরুণাচলে প্রবেশ করে, হয়ে যায় প্রশস্ত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসে নদীটি মিশে যায় বঙ্গোপসাগরে।
ভাবছেন, কী সেই নদী? তাকে আমরা চিনি ব্রহ্মপুত্র নদ নামে।
গত মাসে চীন জানায়, ইয়ারলুং জাংবো নদীর ওপর তারা তৈরি করতে যাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ। বাঁধটি বসবে ঠিক ভারত-চীন সীমান্ত ঘেঁষে, মেদং অঞ্চলে। ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নির্মিত হবে বাঁধটি। তবে এই বাঁধের কারণে কী পরিমাণ গ্রাম বা বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এ বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। বছরে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এ থেকে।
ইয়ারলুং জাংবো এবং তার শাখা-প্রশাখার ওপর এর আগেও ছোট ছোট বাঁধ দিয়েছে চীন। তবে এটাই হবে সর্ববৃহৎ, জানিয়েছেন বি আর দীপক, দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক।
চীনের এই ঘোষণার পরপরই বাঁধের বিপরীতে বাঁধ দেওয়ার কথা ভাবে ভারতের সরকার। ভারতের মতে, চীন বাঁধ দিলে সিয়াং নদীর গতিপথে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। কিন্তু ভারত পাল্টা একটি বাঁধ দিতে পারলে এই প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, আর হুটহাট বন্যা বা খরার সম্ভাবনাও কমে যাবে।
স্থানীয়দের বুঝ দিতে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা বলেন, চীন যে কোনো সময়ে তাদের বাঁধ খুলে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে সিয়াং নদীর তীর। এমন দুর্ঘটনা এড়াতেই পাল্টা বাঁধ দিতে হবে ভারতকে।
কিন্তু এত কাছাকাছি দুইটি বাঁধ দিলে আদতে ওই নদীর অববাহিকায় যে লাখ লাখ মানুষ বাস করেন, তাদের উপকার না হয়ে বরং অপকার হওয়ারই ঝুঁকি রয়েছে, হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পরিবেশবাদী এবং বিশেষজ্ঞরা। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
চীন এবং ভারত এই দুই দেশের ওপর দিয়েই যেসব নদী গেছে, সেসব নদীর পানি নিয়ে দেশ দুটির রেষারেষি নতুন কিছু নয়। তবে চীনের বাঁধের বিপরীতে সিয়াং নদীতে ভারত পাল্টা একটি বাঁধ দিলে আগুনে বরং ঘি ঢালা হবে, অধ্যাপক দীপক বলেন।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান লোয়ি ইন্সটিটিউট ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলে, তিব্বতীয় মালভূমিতে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে চীন। আর এর মাধ্যমে আসলে দেশটি ভারতের অর্থনীতির 'গলা চেপে ধরার' ক্ষমতাও রাখে।
পানি যখন অস্ত্র
চীনের ইতিহাসে ইয়ারলুং জাংবোকে বলা হয় 'বেয়াড়া নদী'। চীনের অন্য সব নদীর মতো সে পশ্চিম থেকে পূর্বে যায়নি, বরং তীক্ষ্ণ এক বাঁক নিয়ে দক্ষিণে চলে গেছে, প্রবেশ করেছে ভারতে। সীমান্ত ঘেঁষে এই নদীতে চীনের বাঁধ বসবে, এতে ভারতের দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে বই কি।
দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক সাহেলি চট্টজার মতে, এই বাঁধ ব্যবহার করে ভারতের ভেতরে এই নদীর পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে চীন। আর এতে দুই দেশের সম্পর্কেও প্রভাব পড়বে।
এই মতের সাথে সম্মতি জানিয়ে অধ্যাপক দীপক বলেন, এই নদীর ভাটিতে অবস্থিত ভারত ও বাংলাদেশ, দুই দেশেরই আশঙ্কা আছে যে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে চীন। এই বাঁধ অনেক বিশাল পরিমাণে পানি ধরে রাখতে পারে- ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার - এটাই বেশি ভয়ের ব্যাপার।
সমঝোতায় রয়েছে ঘাটতি
সুপেয় পানি ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘের একটি চুক্তি আছে, যাতে অংশ নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। ভারত বা চীন কেউই ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তবে এ দুই দেশ ২০০২ সালে আলাদা একটি চুক্তি করে, যাতে বলা হয় বর্ষার মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের পানি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য একে অপরকে সরবরাহ করবে তারা।
কিন্তু ২০১৭ সালে ভুটানের কাছাকাছি চীন-ভারত সীমান্তে এক সামরিক সংঘর্ষের পর বেইজিং থেকে এ তথ্য সরবরাহ ব্যহত হয়। সে বছর বসন্তেই আসামে একের পর এক বন্যা দেখা দেয়, এতে নিহত হন অন্তত ৭০ জন, বাস্তচ্যুত হন চার লাখ মানুষ।
“যখনই দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়, চীন সাথে সাথে তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়,” দাবী করেন অধ্যাপক দীপক।
ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে মেদং বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দেয় চীন। এর পর পরই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত। এর প্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেন, ভাটি অঞ্চলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, এবং বেইজিং ভাটির দেশগুলোর সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে।
এ মন্তব্যের পরও চীনের ওপর ঠিক ভরসা করতে পারছে না ভারত।
ভারত ও চীনের মাঝে সম্পর্কের তিক্ততা এত সহজে দূর হবে না, বলেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বিভিন্ন দুর্যোগের শিকার হয়েছে ভারত ও চীন। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে, এবং পানি নিয়ে এই দুই দেশের মাঝে টানাপোড়েন চলতেই থাকবে।
ভূমিকম্পের ভয়
ভূমিকম্পের দিক দিয়ে হিমালয় খুবই উর্বর একটি অঞ্চল। ২০ শতকের অন্তত ১৫ শতাংশ বড় ভুমিকম্প এই এলাকাতেই ঘটে, বলেন অধ্যাপক দীপক। এই মাসেরই ৭ তারিখেই তিব্বতের দিংরি অঞ্চলে এক ভুমিকম্পে নিহত হয়েছেন অন্তত ১২৬ মানুষ। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের অন্তত ১৪টি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ভুমিকম্পে। কিছু বাঁধের দেয়াল হেলে গেছে, কোথাও কোথাও ফাটল দেখা দিয়েছে। তিনটি বাঁধের পানি নিষ্কাশন করা হয়েছে, সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু গ্রামের বাসিন্দাদের। চীন ও ভারত যে দুটি নতুন বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, ভূমিকম্পে এর কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঝুঁকিতে পড়ে যাবে ভাটি অঞ্চলের অগুনতি মানুষ।
বাংলাদেশের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
বাঁধ নিয়ে ভারত ও চীনের মাঝে দড়ি টানাটানি চলছে বটে, কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। ব্রহ্মপুত্রের মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গেছে, কিন্তু দেশের ৬৫ শতাংশ পানিই আসে এই নদ দিয়ে, বলেন শেখ রোকন, ঢাকাভিত্তিক সংস্থা রিভারাইন পিপলের মহাসচিব।
"চীন ও ভারতের মাঝে এই 'বাঁধের বদলে বাঁধ' প্রতিযোগিতায় আমাদেরই ক্ষতি হবে বেশি," তিনি আল জাজিরাকে বলেন।
একই ভয় পাচ্ছেন মালিক ফিদা খান, ঢাকাভিত্তিক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর নির্বাহী পরিচালক।
"আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন, নেই, এমনকি বাঁধ তৈরিতে কী প্রযুক্তি ব্যবহার হতে পারে এরও তথ্য জানি না আমরা," তিনি বলেন।
মালিক ফিদা খান আরও বলেন, বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়ার আগে ব্রহ্মপুত্র তৈরি করেছে পাললিক বদ্বীপ। উজানে বাঁধ তৈরির কারনে পলিমাটির গতিপথে কোনো পরিবর্তন এলে আরও বেড়ে যেতে পারে ভাঙনের পরিমান।
একটি বাঁধ দিয়ে আরেকটি বাঁধের মোকাবিলা করা যায় না, তিনি বলেন। বরং ভাটি অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের ওপর বিশাল দুর্যোগ নেমে আসবে তাতে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান নীতি হলো হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করা, কিন্তু এই নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, শেখ রোকন মনে করেন।
"ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বাংলাদেশ-ভারত বা ভারত-চীনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, বরং এর অববাহিকার সব দেশ নিয়েই আলোচনায় বসা উচিত।"
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সাথে দিল্লীর সুসম্পর্ক ছিল। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের ওপর চীনের বাঁধ দেওয়া নিয়েও বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে কোনো যৌথ উদ্যগ দেখা যাচ্ছে না, বিশ্লেষকরা বলেন।
মালিক ফিদা খানের মতে, এই সুযোগে নিজেদের সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে পারে বাংলাদেশ ও ভারত। কিন্তু উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান এতটা আশাবাদী হতে পারছেন না।
"ভারত আর বাংলাদেশ একজোট হয়ে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও তাদের কাজে বাধা দেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হবে না," তিনি মনে করেন। যত সময় গড়াবে, এই বাঁধের কারণে ভাটির মানুষের ক্ষতির আশংকাও তত বাড়বে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ ম কম প ব যবহ র সরক র র সরবর হ এল ক য় র ওপর সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদাবাজি ও মজুতদারি বন্ধ করতে না পারায় নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ সরকার
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ ও মজুতদারি বা অযৈাক্তি মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবিলা করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাই নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
আজ বুধবার ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫: সংকটময় সময়ে প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফাহমিদা বলেন, সিপিডির পর্যবেক্ষণে পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ডিম, রুই মাছ, হলুদ, গম, মসুর ডাল, চিনি, গরুর মাংস, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল এবং পাম তেলসহ ১৪টি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষণে দামের ওঠানামা এবং অদক্ষতার জন্য বেশ কিছু বাধা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে, প্রাথমিক বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে মজুতদারি, কমিশন এজেন্ট বা গুদাম পরিচালনাকারীদের আধিপত্য, অপর্যাপ্ত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি পদ্ধতি, উচ্চ উপকরণ খরচ, নিম্নমানের সংরক্ষণ এবং পরিবহন সুবিধা এবং সামগ্রিক সরবরাহকে প্রভাবিত করে এমন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, চালের বাজার ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত জটিল। সে কারণে সিপিডি চালের সরবরাহ শৃঙ্খলে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা নিরূপণের জন্য মাঠ পর্যায়ে একটি অনুসন্ধানমূলক জরিপ পরিচালনা করে, বিশেষ করে মাঝারি-পাইজাম চাল। যার লক্ষ্য ছিল প্রধানত দামের যে অস্থিরতা তার মূল কারণগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করা।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় অসংখ্য বাজার এজেন্ট রয়েছে। বাজার মূল্যের ওপর গুদাম মালিকদের বা অটো রাইস মিলারদের উল্লেখযোগ্য আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ ধান চাষীরা প্রায়শই সঠিক দাম পান না। কিন্তু ভোক্তারা অযৌক্তিকভাবে উচ্চ মূল্যের সম্মুখীন হন, যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশে পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে একটি অকার্যকর অর্থনীতি রেখে গেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশ্লেষণে মধ্যস্থতাকারীদের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
সিপিডি বলছে, অর্থনীতিতে মুল্যস্ফীতির চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছে এবং নীতি সুদহারও বৃদ্ধি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উপর উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির বোঝা কমাতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহ-পক্ষীয় ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন করেছে, যেমন ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করা এবং ঢাকার ভেতরে ও বাইরে ন্যায্য মূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা করা। তবে দুঃখের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে চাঁদাবাজি, মজুদদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলি এখনও পর্যন্ত বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সংস্থাটি আরও বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী এবং জরুরি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
রাজস্ব প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে ২০২৫ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময় ছিল ১৭.৭ শতাংশ অর্থাৎ এখানে উল্লেখযোগ্য অবনতি দেখা গেছে।
২০২৫ অর্থবছরের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অর্থবছরের বাকি সময় ৪৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে যা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। সামগ্রিকভাবে কর রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। কর রাজস্বের দুটি উৎসেই (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত ও বহির্ভূত) একই চিত্র দেখা গেছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ওই সময়ে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক আহরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জুলাই-আগস্টের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে শ্লথগতি এর বড় কারণ। কর রাজস্ব আহরণের পরিস্থিতি বহুলাংশেই সরকারকে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধিতে ধাবিত করেছে। তবে আইএমএফের শর্তপূরণের চাপও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান উচ্চ-মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিতে এ ধরনের উদ্যোগ মোটেই কাম্য নয়। কারণ পরোক্ষ কর সকল ধরনের আয়ের মানুষের জীবনেই প্রভাব ফেলে।