সৌদির সড়কে মৃত্যুর ২০ দিন পর ফিরল মাসুকের মরদেহ
Published: 28th, January 2025 GMT
পরিবারের সুখশান্তি আর উন্নত জীবনের আশায় স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবাকে ছেড়ে মাত্র ৫ মাস আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশী গ্রামের মাসুক মিয়া। প্রবাসে চাকরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে ভালই কাটছিল তার জীবন। সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় থেমে গেল মাসুকের জীবনের চাকা।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ২০ দিন পর সড়কে নিহত মাসুক মিয়ার মরদেহ ফিরলো বাড়িতে। লাশ বাড়িতে পৌঁছার পর স্ত্রী সন্তানসহ আত্মীয়স্বজনের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
মাসুক মিয়া উপজেলার মিরাশী ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের জহুর আলীর ছেলে। সংসারে তার স্ত্রী ও দেড় বছরের আফনান নামে একমাত্র ছেলে রয়েছে।
পরিবার জানায়, মাসুক মিয়া মাত্র ৫ মাস পূর্বে চাকরি নিয়ে সৌদি আরব যান। ভালই চলছিল তার সহকর্মীদের নিয়ে প্রবাস জীবন। ৭ জানুয়ারি সৌদি আরবে এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মাসুক। মাসুকের মৃত্যুর পর সন্তানের লাশ দেখতে পাবেন কিনা এ নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়েন অসহায় বাবা-মা ও স্ত্রী স্বজন।
অবশেষে মৃত্যুর ২০দিন পর প্রবাসে তার সহকর্মী একই গ্রামের মাহমুদুর রহমান রুবেল সৌদির দূতাবাসের সহযোগিতায় লাশ নিয়ে দেশে আসেন। সোমবার ভোর রাতে লাশ পৌঁছায় হযরত শাহজালাল (রহঃ) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। সেখান থেকে পরিবারটির পক্ষে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য কামাল হোসেন লাশ গ্রহণ করে বাড়ি নিয়ে আসেন। সোমবার বিকেলে লাশ বাড়িতে পৌঁছার পর স্ত্রী সন্তান, বাবা-মা ও স্বজনের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
ঢাকা/মামুন/টিপু
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
সৌন্দর্যের সন্ধানে সুন্দরবনের গহীনে : প্রথম পর্ব
শৈশবে যারা গ্রামের সবুজ মাঠের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ শুনে বড় হয়, যৌবনে পড়াশোনা শেষ করে শহরে আসার পর কর্মব্যস্ততা তাদের বন্দি করে ফেলে। শহরের গঁৎবাধা জীবনে থেকে আকাশের পূর্ণ চাঁদ দেখার সুযোগ হয় না। দিনে চোখ রাখা হয় না আকাশের কার্নিশে লেপ্টে থাকা ভেজা মেঘের পালে। ক্লান্তিময় জীবনে প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে প্রকৃতির সান্নিধ্য বড় দাওয়াই। মানুষের গদগদ ভিড় আর গা ঘিনঘিন করা ধুলোবালির শহর ছেড়ে প্রশান্তির জন্য এবার যাচ্ছি প্রকৃতির বুকে। শুনেছি, ওখানে ভাসমান জাহাজ থেকে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন শুনে ঘুম ভাঙে। মাছের ঝাঁকের পেছনে ছুটে শিকারে মেতে ওঠে সাগরের ডলফিন। যাচ্ছি জল-জঙ্গল-জন্তু জানোয়ারের মিশেলে প্রকৃতির সৃষ্ট, বিশ্বের বড়ো ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে।
সুন্দরবনের এমন রূপ-সৌন্দর্যের কথা শোনার পর ভ্রমণের শখ অনেক আগে থেকেই ডালপালা মেলেছিল। সহকর্মীদের মধ্যেও চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল এটা আলোচনা করে যে, সাগরে দিন-রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতা কেমন হবে। অবশেষে সব গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি আমরা ট্রেনে চেপে বসলাম। দু’এক মিনিটের মধ্যে ট্রেনের ইঞ্জিন চালু হয়ে যাবে। ট্রেন ছাড়ার আগে খবর এলো যানজটের কারণে সহকর্মী খোকা ভাই স্টেশনে এসে পৌঁছাতে পারেনি। খোকা ভাইয়ের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। এতো আয়োজন করে অবশেষে ট্রেন মিস! এমন সময় খোকা ভাই ট্রেনে উঠে দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘আমি তো সময়মতোই এসে পৌঁছেছি, এটাই আমার স্টাইল!’ খোকাবাবুর এহেন রসিকতায় বিরক্ত হয়ে কেউ কর্ণপাত করল না। মনে মনে শুধু ভাবলাম, দারুণ দেখালে বুড়ো খোকা!
শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আমার সাথে সহধর্মিণী বন্যা, ছেলে ওয়াসী হাসান আর দুই বছরের মেয়ে সামিহা। দীর্ঘদিন পর সহকর্মীদের স্ত্রী-সন্তানরা এক হয়েছে। যাত্রা পথে ট্রেনে এক পরিবারের সঙ্গে অন্য পরিবারের জমিয়ে আড্ডা চলছে। ট্রেন ইঞ্জিনের সব শক্তি নিয়ে ছুটে চলেছে। রাত পৌনে বারোটায় এসে আমরা নামলাম খুলনা রেলস্টেশনে। সাড়ে বারোটায় আমরা পঞ্চাশজন রুপসা নদীর চার নম্বর ঘাটে এসে দাঁড়ালাম।
এমভি ফ্লামিঙ্গো জাহাজ আমাদের বরণ করার জন্য মাঝ নদীতে অপেক্ষা করছে। নদীর জলের উপর দিয়ে শীতল বাতাস ধেয়ে আসছে। আমরা ট্রলারে বসে পড়েছি। নদী থেকে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া কেমন শান্তির পরশ বুলাচ্ছে শরীরে। আমরা রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়ে আছি যার কারণে মনের টালমাটাল অবস্থা। মনে হচ্ছে আমরা চলেছি কোনো অ্যাডভেঞ্চারে। নদীর বুকে স্রোতের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর জলের উপর আলোর দৃশ্য দেখতে দেখতে জাহাজে পৌঁছে গেলাম। আমাদের শরবত আর মিষ্টিমুখ করিয়ে বরণ করা হলো। আন্তরিক আপ্যায়নে আমরা আপ্লুত হলাম। সত্যি বলতে এমন আন্তরিকতা আমাদের প্রত্যাশার মধ্যে ছিল না।
আধুনিক সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে জাহাজে। পরিপাটি করে সাজানো খাটের উপর সুসজ্জিত বিছানা। জাহাজের ভেতরে অন্দরসজ্জা এবং লাইটিংয়ে জমিদারী ছাপ রয়েছে। আধুনিক পর্যটন যে কোথায় পৌঁছেছে এসব তারই নমুনা। ভ্রমণের ক্লান্তি ও নিদ্রাহীনতায় সবার দেহ আড়ষ্ট হয়ে আছে। পেটে দানাপানি পড়ায় সবাই চাঙা হয়ে উঠল। আমরা রাত একটায় জাহাজে পরিবেশিত খাবার দারুণ উপভোগ করলাম। গাইড আল আমিন জানিয়ে দিল সবাই ৪০ ঘণ্টার জন্য নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবেন। তবে যাদের টেলিটকের সিম কার্ড আছে তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবেন না। নিরাপত্তার জন্য জাহাজে রাখা আছে অস্ত্রসহ বন বিভাগের সিকিউরিটি গার্ড, লাইফ জ্যাকেট। ধীরে ধীরে প্রায় সবাই শুয়ে পড়লো, নিভে গেলো রুমের লাইট। পূর্ণ চাঁদের আলোয় খোলা জলের উপর দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলল জাহাজ সুন্দরবনের দিকে।
কাঁচের জানালা দিয়ে চোখ মেলে দেখছি চারপাশ। কুয়াশায় মোড়ানো নদীর দুই পাশের গ্রামগুলো জোছনার আলোয় জেগে উঠেছে। দূরে দু’একটি জেলেনৌকা দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যপট সুন্দরভাবে দেখার জন্য জাহাজের ছাদে চলে এলাম। উপরে চোখ মেলতেই দেখি, আকাশের পাহারাদার হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চাঁদ আর তারা। এক মুহূর্তের জন্যও আকাশের বুক থেকে দৃষ্টি সরাতে মন চাইছে না।
নিচের দিকে পানি আর পানি, কোথাও কিছু নেই জলের বুকে দু’একটা জাহাজ ছাড়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের মতো গতি পেয়ে গেল বাতাস। মনে হলো শীতল বাতাস আমাকে ছাদ থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সিড়ি বেয়ে নামার সময় জাহাজের ইঞ্জিনের পাশে কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালাম। জাহাজের পিছনে বাঁধা আছে কাঠের ট্রলার। বরফ-শীতল দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। জলের কলকল ছলছল ছাড়াও একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। রাতে, জাহাজের কাচের জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত শেষে ভোর হয়েছে, সূর্য উঠেছে পূর্ব আকাশে। চুপিচুপি চলে এসেছে সকাল। জেগে উঠে কাচের জানালা দিয়ে দেখি সূর্যের আলোর স্পর্শে দিগন্ত থেকে কুয়াশার পর্দা উঠে গেছে। ঠিকরে পড়ছে উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি। দুই পাশে সাগরঘেঁষা বনের প্রাচীর জেগে উঠেছে। গাছের পাতাগুলো চকচকে সবুজ, সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে পাতাগুলোর ওপর। মনে হচ্ছে এ যেন সাগরের দু’পাশে মানব সৃষ্ট সবুজের বেড়াজাল। হঠাৎ জাহাজের এক স্টাফ দরজায় কড়া নেড়ে বলল, আন্ধারমানিক চলে এসেছি আমরা, দশ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হোন। বনে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠলো উত্তেজনায়।
নোঙর করা জাহাজ থেকে ট্রলারে ওঠার পর ভটভট শব্দে সচল হলো ইঞ্জিন। কিছুক্ষণ পর বনের বেলাভূমিতে পা রাখলাম আমরা। এখানে আকাশ উজ্জ্বল, যন্ত্রণাকর নীল, কেবল সমুদ্রের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট টুকরো মেঘের দল। বাতাস স্থির, চারপাশ ঝিম মেরে আছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই, পাখিরা ডাকছে না। বনজুড়ে ভীতিকর গাম্ভীর্য আর অশেষ নির্জনতা বাসা বেঁধে আছে। কেউ নির্জনতায় হারিয়ে যেতে চাইলে এমন জায়গার কোনো বিকল্প নেই। পরিচর্যা না করায় বুনো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। বড় গাছগুলোর ডালপালাজুড়ে অনেক পরগাছা ও পরজীবী উদ্ভিদ ইচ্ছেমতো আঁকড়ে ধরে বেড়ে উঠেছে। যেন পরজীবীরা ডালপালা মেলে রীতিমতো বুনো সংসার সাজিয়েছে বড় বৃক্ষের গায়ে। আমাদের গাইড সুন্দরী, গেওয়া, গরানসহ বিভিন্ন গাছের সাথে পরিচিত করে দিল। ও বলল, চিরসবুজ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী; এই বৃক্ষের নামানুসারে সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে। গাছের সজীবতা দেখে মনে হচ্ছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও এই গাছের ক্ষতি হয় না।
সামনে এগিয়ে গিয়ে ইট বালুর তৈরি একটা সরু রাস্তায় উঠলাম। পর্যটকদের সুরক্ষার জন্য রাস্তার দুইপাশে বাউন্ডারি করে দেওয়া হয়েছে, যাতে বন্যপ্রাণী আক্রমণ করতে না পারে। বনের ভেতরে গাছপালাগুলো এতটাই ঘন যে কয়েক হাত দূরের কিছুও দেখা যায় না। সবুজে ঘেরা গহীন বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলছি। বড় বড় গাছের ফোকর দিয়ে চুঁইয়ে আসা সূর্যরশ্মি জঙ্গলকে আবছাভাবে আলোকিত করে রেখেছে। বনের নরম মাটিতে হরিণ আর বানরের পদচিহ্ন আঁকা। একটি বিষয় আশ্চর্য লাগছে, তা হলো বড় গাছের চারপাশে শূলের মতো খাড়া হয়ে আছে অসংখ্য শ্বাসমূল। এই শ্বাসমূলগুলোই প্রকৃতির সৈনিক হয়ে সুন্দরবনকে রক্ষা করে যাচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
জানা গেল, শ্বাসমূল না থাকলে বড় গাছগুলো লবণে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। শ্বাসমূল কার্বন ধরে রাখার কারণেই এই বনাঞ্চলকে ম্যানগ্রোভ বন বলা হয়। শ্বাসমূলের কাণ্ড ও মূলে কার্বন জমা হয়ে থাকে। জোয়ার-ভাটার সময় উদ্ভিদরাজি লবণাক্ত পানি দ্বারা প্লাবিত হলেও শ্বাসমূল ছাকনির মাধ্যমে লবণ বের করে নেয়। শ্বাসমূলের এক হেক্টর বনভূমি প্রায় ৩,৭৫৪ টন কার্বন জমা রাখতে পারে।
আন্ধারমানিক গাছের ডালে দু’চারটা বানর-হনুমান আর বানর ছাড়া অন্য প্রাণী চোখে পড়ছে না। গভীর বনের ভেতরে প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরপুর থাকলেও নেই পাখির কলতান। ভেবেছিলাম, বনের গাছগাছালি থেকে ধ্বনিত হবে পাখির কলরব। পাখির দেখা না পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। গাইড বলল, মন খারাপ করবেন না। যে বনে ফলজ বৃক্ষ নেই সেখানে পাখি থাকে না। পরবর্তী স্পটগুলোতে শরীরে শিহরণ জাগানো দৃশ্যপটে ভরপুর। সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে বাঘ বানর, বন্যশূকর, হরিণসহ জন্তুজানোয়ারের বাস।
আমরা বনের বাঁক ঘুরে ঘাটের কাছে ফিরে এলাম। এখানে সাততলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। টাওয়ারে উঠে পাখির চোখে গভীর বন ও নদীর দৃশ্য দেখে জাহাজে ফিরে এলাম। গাইড জানিয়ে দিল পরবর্তী স্পষ্ট গভীর সাগরের পাশে অবস্থিত জামতলা সী বিচ ও কটকা। সেখানে পৌঁছাতে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা লাগবে। সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে অসংখ্য খালবিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। জলের বাইরে সবুজ ছাড়া আর কিছুই নেই চোখে পড়ার মতো। সাগরের ঢেউ ডিঙিয়ে আর গহীন অরণ্য পাড়ি দিয়ে জাহাজ ছুটে চলল জামতলা সী-বিচের দিকে।
অবসর সময়ে আড্ডা মানেই পিছনের ব্যস্ততা ভুলে গিয়ে অলস সময়কে রঙ্গিন ও প্রাণবন্ত করে তোলা। সহকর্মীরা আড্ডা, খেলাধুলা, গল্পে মেতে উঠে মুঠো-মুঠো সময় পার করতে থাকল। সহকর্মী তুষার, আলমগীর, মোতালেব, নাইমুল আঙুল রেখেছে ক্যারামের স্ট্রাইকে। সৌমেন, মুশফিক, মোজাম্মেল, পরিমল মোনাজাতের মতো হাত তুলে তাস খেলায় মগ্ন। কঁচি-কাচারা বসিয়েছে লুডুর আসর। জনাব ইয়াসিন আলী, আবু নাফিজ স্যার, রনী ভাই সোফায় হেলান দিয়ে জম্পেশ আড্ডা জমিয়েছেন। আসলে এমন আড্ডা আর গল্পের মধ্যেই জীবনের আসল সুখ লুকায়িত। এদিকে বয়োজ্যেষ্ঠ খোকা ভাই ও বয়োকনিষ্ঠ ইকবালের মধ্যে দাবার প্রতিযোগিতা চলছে। বুড়োকে ঘায়েল করতে মোটা ভ্রুর নিচ দিয়ে দাবার কোটে গভীর অন্তর্ভেদি চোখ রেখেছে ইকবাল। দাবা খেলা ছাড়া বুড়োকে কখনো এতটা চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখা যায়নি। ইকবাল মাঝিদের জাল গুটোনোর মতো আস্তে আস্তে সংকুচিত করে ফেলল বুড়োর দাবার গুটি। খেলায় হেরে লজ্জায় পাকা কুমড়োর মতো ধারণ করলো খোকা বাবুর মুখাবয়ব।
সাউন্ড বক্সে বেজে চলেছে হিন্দী সিনেমার গান। কোমর দুলিয়ে হাত নেড়ে নৃত্যশিল্পীর ভঙ্গিতে উদ্দাম নেচে যাচ্ছে কয়েকজন । হাসি-উচ্ছ্বাস, গল্প, নাচের ভিড়ে সবাই বেমালুম ভুলে গেছে সভ্য শহরের অলি-গলির কথা। সময় মধ্য দুপুর। দুপুরের ভোজ সেরে দিগন্তের বাঁকে চোখ রাখলাম। আকাশের বুকে ঝুলে থাকা সূর্যটা নির্দয়ভাবে নদীর বুকে তাপ ঢালছে অবিরত। জাহাজের ছাঁদে এসে দাঁড়ালাম। নদীর দুইপাশে সবুজে ছাওয়া বনে এতো বৃক্ষ যার কোনো শেষ নেই। বনের এমন বর্ণাঢ্য সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করে চোখ ক্লান্ত হয় না। বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে এমন দৃশ্যপট দেখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ভরাট মুখাবয়ব-তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মধ্যবয়স্ক, মোটাসোটা আকৃতির জাহাজের মাস্টার হাবিবউল্লাহ। গভীর মনোযোগ দিয়ে জাহাজ চালিয়ে যচ্ছেন। কাছে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে প্রশ্ন করছি, মাস্টার খোলাখুলিভাবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে বনে কোথায় কি আছে আর কবে কি ঘটনা ঘটেছে সবই তার নখদর্পণে। হাবিবউল্লাহ বলল, স্যার, সুন্দরবনজুড়ে দর্শনীয় অনেক স্থান আছে। দর্শনীয় স্থানগুলো একটির চেয়ে অন্যটি আলাদা বৈশিষ্টের, যার কারণে সুন্দরবন বেশি সুন্দর। হঠাৎ আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল, দেখুন, তীরের বালুচরে রোদ পোহাচ্ছে দুটো কুমির। আজ শীত কম তাই সব কুমির ডাঙ্গায় ওঠেনি। কুমির একদিন রোদ পোহালে কয়েক দিন না খেয়ে থাকতে পারে। কুমিরের দিকে তাকিয়ে ভয়ের একটা শিহরণ নাড়া দিয়ে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে। হাবিবুল্লাহ সতর্ক করে বলল, স্যার, জঙ্গলের ভেতরে বা সাগরের জলে কোন ধরনের বীরোচিত কাজ করতে যাবেন না। তাহলে কিন্তু বাঘের নয়তো কুমিরের খাদ্য হয়ে যাবেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বেলা তিনটা। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ার কারণে জলের উপর আলো পড়ে ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। আমাদের ট্রলারে জামতলা ঘাটে নামিয়ে দেয়া হলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে আর ছেলের হাত ধরে জামতলা সী বিচের দিকে হাঁটছি। ওরা হঠাৎ যেন কোন বন্যপ্রাণী দেখে ভয় না পায়। বনজুড়েই ভীতিকর গাম্ভীর্য আর নির্জনতা বাসা বেঁধে আছে। মেঠো পথের বামপাশে চোখে পড়ছে হেতালের ঝোপ আর টাইগার ফার্ন। বাঘের লুকিয়ে থাকার আদর্শ জায়গা এগুলো। শোনা যায়, এখানে প্রায়ই দেখা মেলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। এখানে প্রত্যেকটি প্রাণী নিজের মতো করে ভয়ংকর। কিছু দূর যাওয়ার পর চোখে পড়লো ঘন জঙ্গল। লম্বা লম্বা ছন বনে চিত্রা হরিণের দল ঘাস খেতে ব্যস্ত। আমাদের আগমন টের পেয়ে হরিণগুলো মাথা নিচু করলো। তারপর, বিশৃঙ্খলভাবে ধূসর ঝোপের পথ ধরে দিক-বিদিগ ছুটছে শুরু করলো।
আরও কিছুটা পথ পেরুনোর পর জঙ্গলের ধারে চোখে পড়ছে বানর, হনুমান। কোনটা নীরবে বসে আছে। কোনটা প্রতিধ্বনি তুলছে ডাকের হুঙ্কারে। ওরা চেঁচামেচি করে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে কাছে না ভিড়তে। ওয়াসী হঠাৎ বলল, আব্বু আমি বানরকে মুখ ভেংচিয়েছি ও আমার পিছু নিয়েছে। ভয়ে ছেলের চোখ ধাতুর মুদ্রার মতো চকচক করছে। আমি ওকে শক্ত করে ধরে তেড়ে আসা বানরের দিকে চোখ রাঙ্গাতেই জন্তুটা পিছু হটল। কিছু সময় লাগলো ওয়াসীর হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়ানি নিয়ন্ত্রণে আসতে। এবার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হলো ওয়াসী। ও আমার জামা ধরে টানছে। জরুরি তাগিদ দিয়ে বলল, চলো পালাই, আব্বা। না হলে, বাঘ টেনেহিঁচড়ে আমাদের বনের ভেতরে নিয়ে যাবে। আমি অভয় দিয়ে বললাম, বাবা সাথে থাকতে কোন ভয় নেই তোমার। এ ভীতিকর অনুভূতি বর্ণনা করা অসম্ভব। কেউ জঙ্গলে এমন ভয়ের অভিজ্ঞতা নিজে অর্জন না করলে তা অনুভব করতে পারবে না। এ ধরনের রোমহর্ষক ও রহস্যময় প্রকৃতির মুখোমুখি হলে ভয়ে মানুষের ভাষা হারিয়ে যায়।
চলতি পথে প্রচুর জামগাছ চোখে পড়ছে, যার কারণে সৈকতটির জামতলা নামের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া গেল। আমরা প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে জামতলা সী-বিচে পৌঁছালাম। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত এ সমুদ্র সৈকতটি নির্জন এবং পরিচ্ছন্ন । তবে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের মতো মসৃণ নয় তীর। তীরে বালু নেই আছে বেলেমাটি। বেলাভূমির মাটিতে কাঁকড়ার শিল্পকর্ম চোখে পড়ার মতো। সাগরের বুকে দৃষ্টি মেলে সাগরের বিশালতা কে কল্পনা করা কঠিন। দিগন্তে তাকাতেই দেখা গেল সাগরের নীল জল আর দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ আলিঙ্গন করছে। বাতাস আর ঢেউ অধিকার করে রেখেছে সমুদ্রকে। সাগরের বুক থেকে সাদা ঢেউ নাচতে নাচতে চাবুকের মতো শপাং শপাং শব্দ করে আছড়ে পড়ছে তীরের বুকে। তীব্র জোয়ার আর ঢেউয়ের কারণে তীর তরতর করে ডুবে যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে তীরে সৃষ্টি হচ্ছে সাদা ফেনা।
তীরের পিছনে কেওড়া ও সুন্দরী গাছের ছাল বাকল, ডালপালা কিছুই নেই। জোয়ারের পানিতে ধুয়ে গাছের শেকড়গুলো চকচক করছে। মরা গাছের ডালপালার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, কেউ মৃত তিমির কঙ্কাল দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। আইলার আগে এখানটা কেমন ছিল জানি না। তবে মৃত গাছেরও যে অপূর্ব সৌন্দর্য থাকতে পারে, জামতলা সৈকতে না এলে বুঝতে পারতাম না। গাইড দশ মিনিটের মধ্যে ফিরতি পথে ট্রলারে যেতে অনুরোধ করলো। আমরা যখন পরবর্তী স্পট কটকা যাওয়ার উদ্দেশ্য ট্রলারে বসে পড়েছি, সূর্য ততক্ষণে নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। সমুদ্রের উপর দিগন্তের ওপারে লাল দেখাচ্ছে সূর্যটাকে। তার মানে সময়টা শেষ বিকেল। (চলবে)
তারা//