রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন ছোট-বড় ১৫টি মার্কেট রয়েছে। নানা অজুহাতে এসব মার্কেট থেকে প্রতি মাসে চাঁদা ওঠে কোটি কোটি টাকা। নকশা ভেঙে আর জালিয়াতি করে দোকানও বরাদ্দ দেয় সিন্ডিকেট। করপোরেশনের মার্কেটের নামকাওয়াস্তে ভাড়া রাজস্বে জমা হলেও বড় অংশই যায় সিন্ডিকেটের পকেটে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও গুলিস্তানের মার্কেটগুলোর সিন্ডিকেট পরিবর্তন হয়নি। এক গ্রুপ সরে যাওয়ার পর তার দখল নিয়েছে আরেক গ্রুপ।

গুলিস্তানের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি আফজাল হোসেন এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ীকে নিয়ে মার্কেটগুলোয় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। গুলিস্তানকেন্দ্রিক সরকারি এসব মার্কেটে তাদের হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দোকান বাণিজ্য বাস্তবায়ন করেছিলেন দেলোয়ার হোসেন দেলু, নাজমুল হুদা, মোজাম্মেল হক মজু, হুমায়ুন কবির মোল্লা ও জহিরুল ইসলাম সিন্ডিকেট। তাদের সবাই আওয়ামী লীগ আমলে মার্কেট মালিক সমিতির শীর্ষ পদে ছিলেন। মেয়র, কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতা সবার মধ্যে ভাগবাটোয়ারা সমন্বয় করতেন জাকের মার্কেটের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু। তাঁর বিরুদ্ধে মার্কেট থেকে শতকোটি টাকা লোপাটে দুদকেও অভিযোগ রয়েছে। বাকিদের মধ্যে ট্রেড সেন্টারের উত্তরের সভাপতি ছিলেন মোজাম্মেল হক মজু ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান। ট্রেড সেন্টার দক্ষিণের সভাপতি ছিলেন হুমায়ুন ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আফজাল। বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের  ঘটনায় করা মামলায় এরই মধ্যে নাজমুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাল্টে গেছে সিন্ডিকেট। পুরোনোদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য ও ট্রেড সেন্টারের উত্তরের সভাপতি মোজাম্মেল হক মজু। তাঁর সঙ্গে গোপনে আরও অনেকে রয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট (ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তর), বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট (ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ মার্কেট), নগর প্লাজা, সিটি প্লাজা ও জাকের সুপারমার্কেটে দোকান বরাদ্দের মাধ্যমে এই নতুন সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তারা এসব মার্কেটের কাগজপত্র জালিয়াতি করে ভুয়া ছবি ও পরিচয়পত্রের মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ দিয়ে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া সরকারি মার্কেটে প্রভাব খাটিয়ে নকশাবহির্ভূতভাবে শত শত দোকান বানিয়ে বিক্রি করা হয়।

এর আগে ব্যারিস্টার তাপস মেয়র হওয়ার পর এসব অবৈধ দোকান ভাঙা নিয়ে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।  মার্কেটের সিন্ডিকেট পরে বিষয়টি সমঝোতা করে নেয়। এখন সরকার পরিবর্তনের পর এসব মার্কেটে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দোকান বরাদ্দ নিয়ে আবার বাণিজ্য শুরু হয়েছে। দোকান বরাদ্দের নামে ব্যবসায়ীপ্রতি ৪-৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগ উঠেছে নতুন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তরের সভাপতি মজু ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যপদ বাগানোর পর পুরো সিন্ডিকেট করায়ত্তে নিয়েছেন। এর আগে এই বিএনপি নেতা আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আফজাল, কাউন্সিলর রতন ও আউয়াল হোসেনদের ম্যানেজ করেই চলতেন। নিয়মিত অংশ নিতেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে। নতুন সিন্ডিকেটে মজুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বিএনপির ২০ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি প্রার্থী আবদুল হক, বিএনপি নেতা আমজাদ হোসেন ও তাজুল ইসলাম। তারা পুরোনো সিন্ডিকেটের সদস্যদের নানাভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।


ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পতিত স্বৈরাচার সরকারের আমলের অনিয়ম-দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত অনেকেই এখন বিএনপিকে ব্যবহার করে অপকর্ম করছেন। এমনকি বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় করা মামলার বাদীকে ঘায়েল করতে তাঁকে এখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে হত্যা মামলার আসামি করা হচ্ছে। নানাভাবে হুমকি দিয়ে বাদীকে কোণঠাসা করে বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড আগের মতো ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে আগুন লাগে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী বিপণিবিতান বঙ্গবাজারে। ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় মার্কেটটির চারটি ইউনিটসহ আশপাশের আরও তিন মার্কেট। দোকান, মালপত্র ও নগদ টাকা পুড়ে নিঃস্ব হন শত শত ব্যবসায়ী। অনেক ব্যবসায়ী পরিকল্পিত আগুনের অভিযোগ করলেও তৎকালীন সরকার পাত্তা দেয়নি। এমনকি অভিযোগকারী ব্যবসায়ীরা হুমকি এবং মারধরের শিকার হন।

ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর গত ২২ অক্টোবর বঙ্গবাজারে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়ার অভিযোগ এনে ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন রিপন। এরই মধ্যে মামলার তদন্ত কাজ শুরু করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ। এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এ মামলা করে বেকায়দায় পড়েছেন ব্যবসায়ী রিপন। হত্যা মামলার আসামি করাসহ তাঁকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

ওই ব্যবসায়ী বলেন, মার্কেটের পুরোনো সিন্ডিকেট এখন নতুনভাবে ফিরে এসেছে। বিএনপিকে ব্যবহার করে একটি অসাধু চক্র মার্কেটে আগুন দেওয়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এতে আমি ও আমার পরিবার ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন। বঙ্গবাজার পোড়ানোর মামলায় একজন আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে চারটি মামলার আসামি করা হয়েছে। মিরপুর থানায় এসব মামলায় আমাকে জড়িয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। আমার চার ভাইকে আসামি করা হয়েছে। মামলা তুলে নিতে চিঠি পাঠিয়ে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। এখন আমি প্রাণভয়ে পালিয়ে আছি। আমার ব্যবসা-বাণিজ্যও দখলের হুমকি আসছে।

ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এর কর কর্মকর্তা আবু নাসের সমকালকে বলেন, আগে মার্কেটের নকশা ভেঙে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা দোকান বরাদ্দ দিতেন। গত ৫ আগস্টের পরও তারা বরাদ্দের নামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা উঠিয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। এবার মার্কেট যাচাই-বাছাই করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে। কোনো সিন্ডিকেটে কাজ হবে না।
মজুর বিএনপির সদস্য পদপ্রাপ্তি নিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু বলেন, মোজাম্মেল হক মজু বিএনপি করেন। সে হিসেবেই তাঁকে পদ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলে তাঁর কর্মকাণ্ড আমাদের জানা নেই। মার্কেটে ব্যবসা থাকার কারণে অনেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার প্রয়োজন হতে পারে। এসব বিষয়ে তিনি ভালো বলতে পারবেন। 
এসব অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা উত্তর ট্রেড সেন্টারের সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে মোজাম্মেল হক মজুর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর ব্যবহৃত মোবাইলে একাধিকবার কল ও মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এসব ম র ক ট ব যবস য় র ব এনপ র র সদস য আওয় ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শুক্র-শনিবার খোলা ডিএসসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়

ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের প্রয়োজনে সরকারি ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) আঞ্চলিক ও ওয়ার্ড সচিবের কার্যালয় খোলা রাখা হয়েছে।

শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ডিএসসিসি থেকে জানানো হয়েছে, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কার্যক্রম চলমান থাকায় নাগরিকত্ব সনদ এবং জন্ম-মৃত্যু সনদ সংক্রান্ত সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার ও শনিবার) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওয়ার্ড সচিবের কার্যালয় খোলা থাকবে। 

ঢাকা/এএএম/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ