বরিশাল বিভাগের নদনদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিভাগের অন্তত ২০টি নদীর পানি প্রায় শতভাগ লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। অথচ ১০ বছর আগেও এ সংখ্যা ছিল চারটি। এমন পরিস্থিতিতে লবণাক্ত পানির প্রভাবে এরই মধ্যে বিভাগে ৫২ ভাগ ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে ফসল উৎপাদন। আসছে দিনগুলোয় উৎপাদন আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বরিশাল মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, সেচের জন্য নদীর পানিতে ০ দশমিক ৭ ডিএস পার মিটার এবং মাটিতে ২ ডিএসের নিচে পার মিটার লবণাক্ততা থাকতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি চালানো গবেষণায় দক্ষিণাঞ্চলের নদীর পানিতে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ ডিএস পার মিটার ও মাটিতে সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস পার মিটার লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। আগে সাগর সংলগ্ন নদীতে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা পাওয়া যেত। এ নদীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ হলো– আন্ধারমানিক, আগুনমুখা ও বিষখালী। বর্তমানে এই তিনটিসহ বিভাগের অভ্যন্তরীণ যেমন বরিশাল নগরী সংলগ্ন কীর্তনখোলা, কারখানা, ভোলা সংলগ্ন মেঘনা, পিরোজপুরের বলেশ্বরের মতো মোট ২০টি নদীর পানি শুকনো মৌসুমে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। তবে বর্ষা মৌসুমে জোয়ার-ভাটার প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে লবণাক্ত পানি সরে যায়।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বরিশাল দপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা একীম মামুন বলেন, ‘জোয়ারে লবণ পানি ঢুকে নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়। ১০ বছর আগে শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) সাগরসংলগ্ন তিন থেকে চারটি নদীতে লবণ পানি পৌঁছাত। সেটি এখন প্রতিবছর বৃদ্ধি পেতে পেতে অভ্যন্তরীণ প্রায় ২০টি নদীতে পৌঁছায়। কীর্তনখোলার পানিতে লবণের অস্তিত্ব মেলে ২০২১ সালে। নদীর পানিতে লবণ বাড়লে এর প্রভাব মাটিতেও পড়ে। মাটির লবণাক্ততা ৮ ডিএস পার মিটার অতিক্রম করলে তা ফসল উৎপাদনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।’
পটুয়াখালী মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়মিত বৃষ্টিপাত ও গরম মৌসুমে তাপমাত্রা সহনীয় থাকলে লবণাক্ততার সমস্যা হয় না। কিন্তু প্রতিবছর মৌসুমের বিপরীত আবহাওয়া বিরাজ করে। বর্ষা মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত হয় না। আবার গরমে তাপমাত্রা হয় অসহনীয়। নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ১০ বা ১২ ডিএস পার মিটার অতিক্রম করলে সংলগ্ন জমি চাষাবাদযোগ্যতা হারায়। এ কারণে লবণাক্ততা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বরিশাল মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুষমা রানী হালদার বলেন, ‘গত কয়েক বছর মাটি ও পানি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুকনো মৌসুম তথা নভেম্বর মাস থেকে এখানে নদীগুলোয় লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। ফলে এখানে পানি ও মাটির গুণাগুণ হ্রাস পাচ্ছে। পরীক্ষার পর এ খবর কৃষকদের জানিয়ে দেওয়া হয়।’
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, বিভাগে চাষযোগ্য ৮ লাখ ২ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৪ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর বা ৫২ শতাংশ লবণাক্ততায় আক্রান্ত। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত সাগরপারের জেলা পটুয়াখালী। সেখানে ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৮০ হেক্টর বা ৩৯ শতাংশ জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত। এ ছাড়া সাগরপারের আরেক জেলা বরগুনায় ২৪ শতাংশ, ভোলায় ২৪ শতাংশ জমি লবণাক্ততার বিষের কবলে পড়েছে। লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমি সবচেয়ে কম ঝালকাঠি জেলায় মাত্র ১ শতাংশ। এ ছাড়া বরিশালে ৩ ভাগ ও পিরোজপুরে ৯ ভাগ জমি লবণাক্ততার কবলে পড়েছে।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুরাদুল হাসান বলেন, ‘বৃষ্টিপাত বেশি হলে নদী ও মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ কিছু কমে এবং বৃষ্টি কম হলে আবার বাড়ে। তবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালীর চরমন্তাজের জমি স্থায়ীভাবে লবণাক্ততার দিকে যাচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকলে এসব এলাকায় লবণ সহনশীল ফসল চাষ করতে হবে।’
দক্ষিণাঞ্চলে নদীর পানি ও জমির লবণাক্ততা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং উন্নয়ন সংগঠন হাঙ্গার প্রজেক্ট। বেলার বরিশাল সমন্বয়ক লিংকন বায়েন বলেন, পটুয়াখালীর নদনদীতে লবণাক্ততা তিন ভাগ থাকাকালে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা সতর্ক করেছিলাম। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় এখন সেটা ৩৯ ভাগে পৌঁছেছে। ভবিষ্যতে লবণাক্ততা শত ভাগে উন্নীত হওয়া অসম্ভব কিছু না।
হাঙ্গার প্রজেক্টের বরিশাল সমন্বয়ক নিগার আফরোজ মিতা বলেন, আগামী ১০ বছরে অবস্থাটা কী ভয়াবহ হবে, তা এখনই ভাবতে হবে। তখন ফসল উৎপাদন শূন্যের কোটায় নেমে আসতে পারে। তাই সময়ক্ষেপণ না করে এখনই উত্তরণের পথ ঠিক করতে হবে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ড এস প র ম ট র
এছাড়াও পড়ুন:
যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন রাজ্যে এখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে; সেখানে এখনই রোহিঙ্গাদের নিরাপদভাবে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা জাতিসংঘসহ সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি, যাতে রাখাইন রাজ্যে শান্তি এবং স্থিতি অবস্থা ফিরে আসে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করে। আশা করছি আমরা সফলভাবে রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন করতে পারব।’
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার শহরে রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব ‘মহা সাংগ্রাং পোয়ে’ উৎসবের দ্বিতীয় দিনে ‘শুভ রাখাইন সাংগ্রেং ১৩৮৭’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন খলিলুর রহমান। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কথাগুলো বলেন তিনি।
কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। রাখাইন সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশ সকল ধর্মের, নৃগোষ্ঠীর, সংস্কৃতির একটি দেশ। আমাদের দেশে এই সময়টা হচ্ছে উৎসবের সময়। আমরা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করেছি। আজ রাখাইনদের সাংগ্রেং পেয়েতে এসেছি। ভালোই লাগছে।’ তিনি সবাইকে রাখাইন নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, মিয়ানমার সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হওয়া বর্তমান সরকারের বিশাল কূটনৈতিক সফলতা। এটি সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপটি প্রয়োজন ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য।
এর আগে গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেন খলিলুর রহমান। আশ্রয়শিবিরের একটি মসজিদে তিনি জুমার নামাজ আদায় করেন।
এ প্রসঙ্গে খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বলেছি জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। সেই সম্মেলনে রোহিঙ্গারা যেন সংঘবদ্ধভাবে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেন। তাঁদের মধ্যে যেন নেতৃত্ব তৈরি করা যায়, যাতে নিরাপদে স্বদেশে ফেরত যেতে পারেন। আগামী ঈদে যেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে পারেন, তার জন্য চেষ্টা চলছে।’