রেলওয়ে শ্রমিক দলের দুই গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক এম আর মঞ্জুর ও পেয়ার আহমেদ। রেলে এখন তাদের কথাই আইন। আধিপত্য বিস্তারে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়ানোর পাশাপাশি রেলকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন এই দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এখন আর তাদের টেবিলে পাওয়া যায় না। কাজ ফেলে তারা দলবল নিয়ে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রীতিমতো তালিকা তৈরি করে রেলের পূর্বাঞ্চলে বদলি বাণিজ্যে নেমেছেন। কেউ বদলি কিংবা বদলি ঠেকাতে দ্বারস্থ হচ্ছেন তাদের। শুধু তারাই নন, রেলে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের দুই যুবদল নেতাসহ তাদের পরিবারের আট সদস্য।

দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৬ বছর একটানা রেলওয়েকে নিয়ন্ত্রণ করেছে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন শ্রমিক লীগ সমর্থিত রেলওয়ে শ্রমিক লীগ। কাউকে পরোয়া করতেন না সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এখনকার মতো তারাও দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। টেন্ডার, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, বদলি নিয়ন্ত্রণ, রেলের সম্পদ ভোগদখল– সব কিছুতেই ছিলেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই সব দাপুটে নেতা আত্মগোপনে। এখন তাদের স্থান নিয়েছে বিএনপির অঙ্গসংগঠন শ্রমিক দল সমর্থিত রেলওয়ে শ্রমিক দল। ফলে এক দখলদার গোষ্ঠীর বিদায়ের পর আরেক দখলদারের কবলে রেলওয়ে। ধীরে ধীরে শ্রমিক লীগ নেতাদের কায়দায় রেলের সেই ‘রাজত্ব’ নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছেন বিএনপি সমর্থিত নেতারা। তাদের দাপটের কাছে অসহায় রেলের বড় কর্তারা। 

নিয়ন্ত্রণে মরিয়া দুই গ্রুপ
রেলে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া রেলওয়ে শ্রমিক দলের বিবদমান দুটি গ্রুপ। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় এখন নিজেদের শক্তি দেখাতে চাইছেন তারা। এ নিয়ে মারামারি-কোন্দলের ঘটনাও ঘটছে। সিআরবিতে একাধিকবার গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিক দল নেতা এম আর মঞ্জুর ও পেয়ার আহমেদ অনুসারী নেতাকর্মীকে নিয়ে সিআরবিতে ঘোরাফেরা করছেন। তারা তো কাজ করছেন না, তাদের সঙ্গে থাকা কর্মীরাও কাজ ফেলে নেতাদের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেপরোয়া আচরণে কর্মকর্তারাও ভয়ে থাকেন।

রেলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগের শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীর মতো একই কায়দায় এ কাজটি করছেন রেল শ্রমিক দলের নেতারা।
এ ব্যাপারে শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এম আর মঞ্জুর সমকালকে বলেন, রেলের শ্রমিক-কর্মচারীর সুবিধা-অসুবিধা আমাদের দেখতে হয়। এ কারণে রেলের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিসে আমাদের যেতে হয়। 

নেপথ্যে আট ভাই
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদরদপ্তর সিআরবি এবং পাহাড়তলীতে (সিসিএস ও কারখানা) টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে দুই যুবদল নেতার বিরুদ্ধে। তারা হলেন নগরীর খুলশী থানার যুবদলের আহ্বায়ক হেলাল হোসেন ওরফে পিচ্ছি হেলাল ও নগর যুবদলের সদস্য সাখাওয়াত কবির সুমন ওরফে ক্যাডি সুমন। প্রভাব খাটিয়ে তাদের অপর আট ভাই টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের মারধর ও অফিস থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। 

একাধিক ঠিকাদার জানিয়েছেন, ক্যাডি সুমনের ভাই এনায়েত কবির বাংলাদেশ রেলওয়ে স্পেয়ার্স অ্যান্ড সাপ্লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি। তাঁর ভাই আহসানুল কবির নোমান, এনামুল নোটন ও জিএম মোর্শেদ সুজনও রেলের ঠিকাদার ব্যবসায়ী। এ ছাড়া পিচ্ছি হেলালসহ চার ভাই মোক্তার হোসাইন, মাসুদ হোসাইন ও মোহাম্মদ শাহিন ঠিকাদার ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে চুপিসারে ব্যবসা করলেও এখন রাতারাতি স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। দুই পরিবারের আট ভাইয়ের হুমকি-ধমকিতে আতঙ্কে থাকেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদা ও দখলবাজিতে নেমেছেন খুলশী থানা যুবদলের আহ্বায়ক হেলাল হোসেন ও ক্যাডি সুমনের অনুসারীরা। কিছুদিন আগে হেলালের অনুসারী ছাত্রদল কর্মী আলী হায়দার রেলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক প্রকৌশল বিভাগের অফিসে ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে আসেন। কয়েকজনকে প্রকাশ্যে মারধর করেন। তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন একাধিক ব্যবসায়ী। তাদের কে কতদিন রেলে আসতে পারবে না, তাও বলে দেন তারা। এই সময়ের মধ্যে দেখা গেলে ফল ভালো হবে না বলেও হুমকি দেন। এতে অনেক ঠিকাদার ভয়ে রেলে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে যুবদল নেতার ভাই এনায়েত কবির সমকালকে বলেন, আমরা সাংগঠনিকভাবে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কাউকে কোনো ধরনের হুমকি দিইনি। রাজনৈতিক কারণে কেউ হয়তো এটা করেছে। অভিযোগ অস্বীকার করেন যুবদল নেতা হেলালও।

তবে হুমকি পাওয়া রেলের প্রকৌশল বিভাগের ব্যবসায়ী ও পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহম্মদ বলেন, বিএনপির অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ আমলে নির্বিঘ্নে রেলে ঠিকাদারি ব্যবসা করেছেন। এখন দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পছন্দের ঠিকাদার ছাড়া অন্যদের রেলে যেতে দিচ্ছেন না। তারা আমাকে ছয় মাস রেল অঙ্গনে যেতে নিষেধ করেছেন। তাই এখন রেলে যাচ্ছি না। একইভাবে অন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও এমন আচরণ করছেন তারা।

বদলি বাণিজ্যে নেতারা
রেলে সংগঠনটির দুটি গ্রুপ থাকলেও মঞ্জুর গ্রুপটি শক্তিশালী। নিজেদের কমিটিকে বৈধ বলে দাবি করেন এই সংগঠনের নেতারা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বদলি বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন রেল শ্রমিক দলের নেতারা। প্রায় এক হাজার কর্মচারীর একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে থাকা কর্মচারীদের সরিয়ে বিএনপি-শ্রমিক দল সমর্থক নেতাকর্মীকে সেসব পদে পদায়ন করা হচ্ছে। এতে হয়রানিমূলক বদলি হয়ে অনেক সাধারণ কর্মচারীকে চলে যেতে হচ্ছে দূর-দূরান্তে। বদলি ঠেকাতে অনেকে টাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছেন নেতাদের কাছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে রেলের পূর্বাঞ্চলের সদরদপ্তর সিআরবির বিভিন্ন শাখায় কর্মরত একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, বঞ্চিতদের পদোন্নতি ও পছন্দের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসার নামে বদলি বাণিজ্য করছেন শ্রমিক দল নেতারা। পছন্দের জায়গায় যেতে এবং বদলি ঠেকাতে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ।

রেলওয়ে শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক এম আর মঞ্জুর বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে আমাদের দুই হাজারেরও বেশি কর্মচারীকে দফায় দফায় হয়রানিমূলক বদলি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এখন এক হাজার কর্মচারী অবসরে চলে গেছেন। হয়রানির শিকার কর্মরত হাজারখানেক কর্মচারীর তালিকা আমরা তৈরি করেছি। এখন তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে কাউকে বসাতে গেলে, কাউকে তো সরাতেই হবে। তবে কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

বড় স্থাপনায় নৈরাজ্য
রেলের সবচেয়ে বড় স্থাপনা হচ্ছে চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই)। নগরীর হালিশহর এলাকায় অবস্থিত বিশাল-বিস্তৃত কেপিআই অন্তর্ভুক্ত সিজিপিওয়াই শাখার শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন জিয়াউল হাসান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে হঠাৎ করেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এই নেতা। অভিযোগ উঠেছে, স্টোরকিপারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার সুযোগে রেলের মূল্যবান মালপত্র হরিলুট শুরু করেছেন তিনি। অনেকটা প্রকাশ্যেই পাচার করেন মালপত্র। এসব দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছেন রেলের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। 

সিজিপিওয়াইর সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আরএনবি সদস্য জানিয়েছেন, যে স্টোর থেকে মালপত্র বের করা হয়েছে, সেটি তালা লাগানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। তালার চাবি থাকে জিয়াউলের কাছে। তালা না ভেঙে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো তিনিই এসব বের করে দিয়েছেন। এভাবে ওই কর্মচারী মালপত্র বের করে নিয়ে যান। এবার নৌবাহিনীর একটি টিমের হাতে ধরা পড়ায় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে জিয়াউল হাসান বলেন, ওই ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই। শ্রমিক দল সিজিপিওয়াই ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক হলেও ক্ষমতা খাটাই না।
এ ব্যাপারে অপর গ্রুপের নেতা পেয়ার আহমেদের অফিসে গেলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য বদল ন ত ল গ সরক র ন ত কর ম ব যবস য় কর ম র এক ধ ক ব র কর র কর ন ক র কর দল ন ত ক কর ম স আরব স গঠন ব এনপ সদস য আওয় ম করছ ন র লওয় সমর থ র আহম

এছাড়াও পড়ুন:

রেল সেতুতে ধাক্কা, রূপসা নদীতে ডুবল লাইটারেজ জাহাজ

খুলনায় রূপসা রেল সেতুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে রূপসা নদীতে ডুবে গেছে লাইটারের জাহাজ এমভি সেভেন সার্কেল-২৩। জাহাজটিতে ১ হাজার ১৭৫ টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ছিল বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

জাহাজের সুকানি ইমাম হোসেন লিটু ও গ্রীজার অমিত কুমার শীল জানান, তারা মোংলা বন্দরের হারবাড়িয়া এলাকা থেকে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল নিয়ে রূপসায় সেভেন রিংস সিমেন্ট ফ্যাক্টরির দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় রূপসা রেল সেতুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে জাহাজটি ডুবে যায়।

জাহাজে থাকা ১৩ জন কর্মচারীকে জাহাজ কর্তৃপক্ষের ২টি ট্রলার এসে উদ্ধার করে তীরে উঠায়।

ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে জাহাজটি উদ্ধার কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ