কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ফরহাদ মজহার দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করছেন ‘চিন্তা’। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’, ‘মোকাবিলা’, ‘এবাদতনামা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’, ‘ক্ষমতার বিকার’ ইত্যাদি। ফরহাদ মজহারের জন্ম ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে। সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলির হাজারীপাড়ায় উবিনীগের আরশিনগর বিদ্যাঘরে ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সমকালের প্রতিনিধি সেলিম সরদার।

সমকাল: ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে?

ফরহাদ মজহার: আমি ভালোই দেখছি। আমরা যদি জনগণের ইমোশন, তারা কী চায় তা প্রপারলি অনুধাবন করতে পারি তাহলে ইতিবাচকভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার আন্তরিকতা এবং তা সমাধানের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ওপর থেকে অগণতান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হবে। গণঅভ্যুত্থানের মৌলিক অভিপ্রায় হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করতে হবে। কাটাছেঁড়া করা বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান অবশ্যই বাতিল করতে হবে। নতুন গঠনতন্ত্রের জন্য গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বাতিলের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধান মানা হলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী সংবিধানকে সমর্থন দেওয়া হবে। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, বাহাত্তরের সংবিধান কার্যত পাকিস্তানি আমলের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা তৈরি। কারণ সত্তরের নির্বাচনে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মাধ্যমেই গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়া সেই পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। স্বাধীন দেশে নতুনভাবে গণপরিষদ গঠন না করে সংবিধান তৈরি করা যায় না।

সমকাল: আপনি যে গঠনতন্ত্রের কথা বলছেন, সেখানে আপনি কী কী দেখতে চান?

ফরহাদ মজহার: প্রথমত, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ বা আইন প্রণয়নের অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে না। ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, মানুষের জানমাল-জীবিকা বিনষ্ট করে এমন কোনো আইন বা নীতি রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে না। তৃতীয়ত, আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ , প্রাণবৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক যত সম্পদ আছে, সামষ্টিকভাবে জনগণ সেসব সম্পদের মালিক। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিনষ্ট ও বিষাক্ত করার কোনো আইন বা নীতি রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারবে না। আমাদের আবাস এবং সম্পদ যেন কোনোভাবে বিষাক্ত না হয়, নষ্ট না হয়, বিদেশি শক্তি লুট করতে না পারে– তা নিশ্চিত করতে হবে। এই সম্পদকে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং অবাধ বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে রূপান্তর করাই এখনকার কাজ। আইন, আদালত, প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জনগণের আর্থসামাজিক, আত্মিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে শক্ত গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। এই দেখুন, কত অল্প কথায় আমরা নতুন বাংলাদেশের গঠনতান্ত্রিক রূপকল্প নির্ণয় করতে পারি। আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, সেটা এভাবেই ঠিক করতে হবে।

সমকাল: জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে আপনার অভিমত কী?

ফরহাদ মজহার: জনগণ ও রাজনৈতিক দল এক না। নতুন গঠনতন্ত্রে জনগণই নির্ণয় করে দেবে কারা আসলে রাজনৈতিক দল, কারা মাফিয়া আর লুটেরা শ্রেণির লুটপাটের জবাব। গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সব ক্ষেত্রেই নতুন করে শুরু করতে হবে। বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কথা শুনতে হবে– তারা কেমন বাংলাদেশ চায়। এই ঈশ্বরদীর জনগণকেও বলতে দিতে হবে– দেশের আইনকানুন কীভাবে থাকলে তারা বাঁচতে পারবে। জনগণের কথা শুনতে হবে। কমিশন বানিয়ে ওপর থেকে এলিট বা অভিজাত শ্রেণির কথাবার্তার তামাশা করে লাভ নেই। জনগণের মনের ভাষা বুঝতে হবে।

সমকাল: অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ছয় মাস পূরণ করেছে। এদের নিয়ে কিছু বলবেন?

ফরহাদ মজহার: আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই সরকার সাংবিধানিক সরকার নয়। বর্তমান সংবিধানে এ রকম কোনো সরকার গঠনের নিয়ম নেই। এ সরকার অসাংবিধানিক। তা ছাড়া বিদ্যমান সংবিধান রক্ষায় শপথ নিয়ে গঠিত সরকার সংবিধান বাতিল বা সংস্কার করতে পারে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূলত সেনাবাহিনীর সমর্থনের ভিত্তিতে কাজ করছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোকেও শুরু থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে সহায়ক শক্তি হিসেবে যুক্ত করা যেত। তারা ন্যাশনাল গার্ডিয়ান কাউন্সিলের ভূমিকা রাখতে পারত। সেটা হলে এখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা সহজ হতো। মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সময়ের জন্য এ দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু শুধু সেনাবাহিনীর সমর্থনে কোনো সরকার ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সোসাইটিতে পাওয়ারফুল অ্যাক্টিভিস্ট না থাকলে দেশ এগোবে না।

সমকাল: এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কী করার আছে?

ফরহাদ মজহার: গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সেই সামষ্টিক অভিপ্রায়কে মান্য করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা। কিন্তু বিএনপি এখন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয় প্রসঙ্গে বিএনপির কথা যদি বলি, তাহলে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপি এখন যা করছে তা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হওয়া জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিএনপি সতর্ক না হলে এ দেশ ক্রমেই গৃহযুদ্ধের দিকে এগোবে।

সমকাল: আপনি নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে কৃষকদের পরিস্থিতি কী?

ফরহাদ মজহার: আমরা প্রায় তিন লাখ কৃষক পরিবার নিয়ে কাজ করি। দীর্ঘকাল ধরে বিপুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি। একেকটা পর্যায়ে আমাদের কাজ বেড়ে গেছে। যদি আমরা জনগণের সরকার গঠন করতে সক্ষম হই তাহলে এই কৃষকদের নিয়ে অনেক বড় কাজ করার ইচ্ছা আছে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। কারণ ড.

মুহাম্মদ ইউনূস সাধারণ মানুষ নিয়ে চিন্তা করেন। তিনি তো গরিবদের নিয়েই কাজ করেন। ফলে আমরা আশা করি, অতি সহজে তাঁকে আমরা অনেক সমস্যার কথা জানাতে পারব। সার এবং কীটনাশক ছাড়া নয়াকৃষির যে দশটা নীতি, এটা দ্বারা একরপ্রতি উৎপাদন আড়াই থেকে তিন গুণ করা যায়। আমরা উৎপাদনের হিসাব একটি ফসল ধরে করি বলে সামগ্রিকভাবে একরপ্রতি উৎপাদন বাড়ল, নাকি প্রাণ-প্রকৃতি আরও ধ্বংস করলাম; তার হিসাব করি না। নয়াকৃষিতে আমরা খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য কৃষিকে গুরুত্ব দিই; তথাকথিত মডার্ন কৃষি না, যেটা ক্ষতিকর।

সমকাল: দেশে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে এই সরকারকে কতদিন সময় দেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?

ফরহাদ মজহার: এটা আগে থেকে বলা মুশকিল। আমি যতটুকু জানি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীতে চিন্তাশীল নেতা আছেন, যারা জনগণ নিয়ে ভাবেন। অনেকে বলেন, আমরা জনগণের জন্য কাজ করি, তাদের ভালোর জন্য কাজ করি। ফলে এ সরকার যতদিন ভালো কাজ করবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকব। আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাইনি। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, এই সরকারকে তারা সমর্থন, সহযোগিতা করবেন। এটা বিচক্ষণ নীতি। আমরা ইসলামী সরকার চাইছি বলে ভারত যে ক্যাম্পেইন করছে, এটা ভুল ধারণা। যতটকু বুঝি, চরমোনাই পীরের যে দল, তারাও চাইছে এই সরকার দীর্ঘকাল থাকুক।

সমকাল: নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কী বলবেন?

ফরহাদ মজহার: নির্বাচনের জন্য যখনই কোনো দল অযথা চাপ দেবে তখন আপনি বুঝবেন, সেই দলের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমরা কেমন দেশ চাই– জনগণের কাছ থেকে তার রায় নিতে হবে। গঠনতন্ত্র জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করে, আর আইন জনগণের ইচ্ছাকে আইনি ভাষায় ব্যক্ত করে।

সমকাল: আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মূল্যায়ন করুন। ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল এভাবে ধসে পড়ল কেন?

ফরহাদ মজহার: পপুলারিজমে ভর করে যে ফ্যাসিজম গড়ে উঠেছিল, এটা যে দুর্বল এবং ঠুনকো, তা শেখ হাসিনার মাথায় ছিল না। ছাত্রদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাদের যে রাজনৈতিক কৌশল, এর শক্তি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে ছাত্রদের এই প্রজ্ঞা ও কৌশলের হাতে; পরাস্ত হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণে। বাকশাল থেকে হাসিনা সরকার পর্যন্ত আমরা দীর্ঘকাল থেকে এই ফ্যাসিজমের সমালোচনা করছি। ছাত্র-তরুণদের সচেতন করার চেষ্টা করেছি। পলিটিক্যাল এডুকেশন যে এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যেতে পারে– এটা শেখ হাসিনা অনুমানই করতে পারেননি।

সমকাল: শেখ হাসিনাকে অনেক ঝানু রাজনীতিবিদ বলা হতো। তিনি বুঝতে পারলেন না কেন?

ফরহাদ মহজার: শেখ হাসিনা যখন ড. ইউনূসের সঙ্গে ব্যক্তিগত ইগোতে গেছেন, যখন ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন বলে তাঁকেও নোবেল পেতে হবে, এমন হাস্যকর বিষয় সামনে আসে; তখন তাঁর প্রজ্ঞা সম্পর্কে সাধারণ মানুষও বুঝতে পেরেছে। তিনি রাজনৈতিক দল, ব্যবস্থা, ক্ষমতা প্রভৃতি সামষ্টিক বিষয়কে ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। এর পরিণতি এখন তিনি ভোগ করছেন।

সমকাল: আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আবার ফিরে আসা সম্পর্কে কিছু বলুন। আমরা কি সংশোধিত আওয়ামী লীগ দেখতে পাব?

ফরহাদ মজহার: আমি মানুষে বিশ্বাস করি। এটা সংশোধনের ব্যাপার না। যখনই সিস্টেমটা আমরা শক্ত করব, তখন এই শক্ত ব্যবস্থার সুফল আওয়ামী লীগ নিজেও দেখবে। আওয়ামী লীগেরও অনেকের মধ্যে পরিবর্তন হবে। 

সমকাল: আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিও উঠছে।

ফরহাদ মজহার: আওয়ামী লীগ দল ও দলটির নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে অপরাধীদের অবশ্যই শনাক্ত করতে হবে ও শাস্তি দিতে হবে। গত দেড় দশকে যেসব অপরাধ হয়েছে, তার ন্যায়বিচার হতে হবে। তবে আমি একতরফা বিচারের পক্ষপাতী নই। তারা যেন মনে বল পায়, ন্যায়বিচারে আস্থা রাখে, সেই পরিবেশ তৈরি করা দরকার। তাদের মব ট্রায়ালের কাছে ছেড়ে দেওয়া ভুল হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিগত শাসনামলে অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগের কোনো অনুশোচনা নেই। 

সমকাল: একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের শাস্তি হবে এবং দলটির মধ্যে অনুশোচনাও আসবে– এমন বিচার কি সম্ভব? 

ফরহাদ মজহার: বিচারের আগে আমরা নেলসন ম্যান্ডেলার স্ট্র্যাটেজি একটু ভাবতে পারি। আমি বিনয়ের সঙ্গে চিন্তা করতে বলব, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের আদলে একটি ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন করতে পারি কিনা। আওয়ামী লীগের নেতা যারা ভুল করেছেন, তাদের বলব– আসেন, আমরা ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনে যাই। আমি একতরফা বিচারের পক্ষে না। সত্য যখন আমরা জানি, তখনই কিন্তু ন্যায়বিচার হয়। আর যখন আমরা সত্য জানি না, তখন আপনাকে আমি যতই শাস্তি দিলাম, মনে হয় শাস্তিটা ঠিক হয়নি। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। 

সমকাল: তরুণদের কি এ ব্যাপারে ধারণা রয়েছে?

ফরহাদ মজহার: বাংলাদেশের তরুণরা একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। তার মানে সমাজ, ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ও জানাশোনা অনেক গভীর। তা ছাড়া বাংলাদেশের তরুণরা তো একটি অ্যান্টি কলোনিয়াল, অ্যান্টি ইম্পেরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘকাল তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

সমকাল: আপনি এখন সারাদেশে ঘুরছেন। সাধারণ মানুষ আগের চেয়েও বেশি আগ্রহ নিয়ে আপনার কথা শুনছে। তার আগে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় নিয়মিত বিরতিতে আপনি ঈশ্বরদী এসেছেন। এখানকার মানুষ, এখানকার পরিবেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

ফরহাদ মজহার: দেখুন, ঈশ্বরদীতে আমরা বহু বছর ধরে উবিনীগের মাধ্যমে চলাফেরা, বসবাস করি। আমরা তো এখন এই সমাজেরই একজন। এখানকার ভূমি খুবই উর্বর। এই অঞ্চলের মাটি ও মানুষের জন্য যথাসম্ভব ভালো কিছু করার প্রচেষ্টা আগেও যেমন ছিল, এখনও রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি গণমুখী হয়, তাহলে ঈশ্বরদীর মাটি ও মানুষের জন্য আরও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। 

সমকাল: অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ফরহাদ মজহার: আমার মতো নগণ্য মানুষের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য আপনাকে ও সমকালকে ধন্যবাদ।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গঠনতন ত র ব যবস থ জনগণ র র র জন ক ত কর পর ব শ র জন য ক জ কর ন র জন আওয় ম অপর ধ ব এনপ আগস ট ক ষমত সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না। 

এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল। 

মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি                                                             

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্বাচনের চাপ বাড়াতে ‘দ্রুত আন্দোলনে যাবে’ বিএনপি 
  • ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সব দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে
  • গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার: তারেক রহমান
  • চীনের বসন্ত উৎসবে প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা
  • আ. লীগের হরতাল-অবরোধ ঘিরে কঠোর হবে সরকার: প্রেস সচিব
  • বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
  • রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও জনগণের ‘ম্যাট্রিক্স’
  • জনগণের বিপক্ষে গেলে ৫ আগস্টের মতো পরিণতি হবে: তারেক রহমান
  • সবাইকে দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে: তারেক রহমান