কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ফরহাদ মজহার দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করছেন ‘চিন্তা’। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’, ‘মোকাবিলা’, ‘এবাদতনামা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’, ‘ক্ষমতার বিকার’ ইত্যাদি। ফরহাদ মজহারের জন্ম ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে। সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলির হাজারীপাড়ায় উবিনীগের আরশিনগর বিদ্যাঘরে ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সমকালের প্রতিনিধি সেলিম সরদার।

সমকাল: ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে?

ফরহাদ মজহার: আমি ভালোই দেখছি। আমরা যদি জনগণের ইমোশন, তারা কী চায় তা প্রপারলি অনুধাবন করতে পারি তাহলে ইতিবাচকভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার আন্তরিকতা এবং তা সমাধানের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ওপর থেকে অগণতান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হবে। গণঅভ্যুত্থানের মৌলিক অভিপ্রায় হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করতে হবে। কাটাছেঁড়া করা বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান অবশ্যই বাতিল করতে হবে। নতুন গঠনতন্ত্রের জন্য গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বাতিলের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধান মানা হলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী সংবিধানকে সমর্থন দেওয়া হবে। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, বাহাত্তরের সংবিধান কার্যত পাকিস্তানি আমলের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা তৈরি। কারণ সত্তরের নির্বাচনে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মাধ্যমেই গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়া সেই পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। স্বাধীন দেশে নতুনভাবে গণপরিষদ গঠন না করে সংবিধান তৈরি করা যায় না।

সমকাল: আপনি যে গঠনতন্ত্রের কথা বলছেন, সেখানে আপনি কী কী দেখতে চান?

ফরহাদ মজহার: প্রথমত, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ বা আইন প্রণয়নের অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে না। ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, মানুষের জানমাল-জীবিকা বিনষ্ট করে এমন কোনো আইন বা নীতি রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে না। তৃতীয়ত, আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ , প্রাণবৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক যত সম্পদ আছে, সামষ্টিকভাবে জনগণ সেসব সম্পদের মালিক। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিনষ্ট ও বিষাক্ত করার কোনো আইন বা নীতি রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারবে না। আমাদের আবাস এবং সম্পদ যেন কোনোভাবে বিষাক্ত না হয়, নষ্ট না হয়, বিদেশি শক্তি লুট করতে না পারে– তা নিশ্চিত করতে হবে। এই সম্পদকে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং অবাধ বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে রূপান্তর করাই এখনকার কাজ। আইন, আদালত, প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জনগণের আর্থসামাজিক, আত্মিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে শক্ত গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। এই দেখুন, কত অল্প কথায় আমরা নতুন বাংলাদেশের গঠনতান্ত্রিক রূপকল্প নির্ণয় করতে পারি। আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, সেটা এভাবেই ঠিক করতে হবে।

সমকাল: জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে আপনার অভিমত কী?

ফরহাদ মজহার: জনগণ ও রাজনৈতিক দল এক না। নতুন গঠনতন্ত্রে জনগণই নির্ণয় করে দেবে কারা আসলে রাজনৈতিক দল, কারা মাফিয়া আর লুটেরা শ্রেণির লুটপাটের জবাব। গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সব ক্ষেত্রেই নতুন করে শুরু করতে হবে। বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কথা শুনতে হবে– তারা কেমন বাংলাদেশ চায়। এই ঈশ্বরদীর জনগণকেও বলতে দিতে হবে– দেশের আইনকানুন কীভাবে থাকলে তারা বাঁচতে পারবে। জনগণের কথা শুনতে হবে। কমিশন বানিয়ে ওপর থেকে এলিট বা অভিজাত শ্রেণির কথাবার্তার তামাশা করে লাভ নেই। জনগণের মনের ভাষা বুঝতে হবে।

সমকাল: অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ছয় মাস পূরণ করেছে। এদের নিয়ে কিছু বলবেন?

ফরহাদ মজহার: আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই সরকার সাংবিধানিক সরকার নয়। বর্তমান সংবিধানে এ রকম কোনো সরকার গঠনের নিয়ম নেই। এ সরকার অসাংবিধানিক। তা ছাড়া বিদ্যমান সংবিধান রক্ষায় শপথ নিয়ে গঠিত সরকার সংবিধান বাতিল বা সংস্কার করতে পারে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূলত সেনাবাহিনীর সমর্থনের ভিত্তিতে কাজ করছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোকেও শুরু থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে সহায়ক শক্তি হিসেবে যুক্ত করা যেত। তারা ন্যাশনাল গার্ডিয়ান কাউন্সিলের ভূমিকা রাখতে পারত। সেটা হলে এখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা সহজ হতো। মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সময়ের জন্য এ দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু শুধু সেনাবাহিনীর সমর্থনে কোনো সরকার ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সোসাইটিতে পাওয়ারফুল অ্যাক্টিভিস্ট না থাকলে দেশ এগোবে না।

সমকাল: এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কী করার আছে?

ফরহাদ মজহার: গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সেই সামষ্টিক অভিপ্রায়কে মান্য করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা। কিন্তু বিএনপি এখন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয় প্রসঙ্গে বিএনপির কথা যদি বলি, তাহলে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপি এখন যা করছে তা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হওয়া জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিএনপি সতর্ক না হলে এ দেশ ক্রমেই গৃহযুদ্ধের দিকে এগোবে।

সমকাল: আপনি নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে কৃষকদের পরিস্থিতি কী?

ফরহাদ মজহার: আমরা প্রায় তিন লাখ কৃষক পরিবার নিয়ে কাজ করি। দীর্ঘকাল ধরে বিপুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি। একেকটা পর্যায়ে আমাদের কাজ বেড়ে গেছে। যদি আমরা জনগণের সরকার গঠন করতে সক্ষম হই তাহলে এই কৃষকদের নিয়ে অনেক বড় কাজ করার ইচ্ছা আছে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। কারণ ড.

মুহাম্মদ ইউনূস সাধারণ মানুষ নিয়ে চিন্তা করেন। তিনি তো গরিবদের নিয়েই কাজ করেন। ফলে আমরা আশা করি, অতি সহজে তাঁকে আমরা অনেক সমস্যার কথা জানাতে পারব। সার এবং কীটনাশক ছাড়া নয়াকৃষির যে দশটা নীতি, এটা দ্বারা একরপ্রতি উৎপাদন আড়াই থেকে তিন গুণ করা যায়। আমরা উৎপাদনের হিসাব একটি ফসল ধরে করি বলে সামগ্রিকভাবে একরপ্রতি উৎপাদন বাড়ল, নাকি প্রাণ-প্রকৃতি আরও ধ্বংস করলাম; তার হিসাব করি না। নয়াকৃষিতে আমরা খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য কৃষিকে গুরুত্ব দিই; তথাকথিত মডার্ন কৃষি না, যেটা ক্ষতিকর।

সমকাল: দেশে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে এই সরকারকে কতদিন সময় দেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?

ফরহাদ মজহার: এটা আগে থেকে বলা মুশকিল। আমি যতটুকু জানি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীতে চিন্তাশীল নেতা আছেন, যারা জনগণ নিয়ে ভাবেন। অনেকে বলেন, আমরা জনগণের জন্য কাজ করি, তাদের ভালোর জন্য কাজ করি। ফলে এ সরকার যতদিন ভালো কাজ করবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকব। আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাইনি। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, এই সরকারকে তারা সমর্থন, সহযোগিতা করবেন। এটা বিচক্ষণ নীতি। আমরা ইসলামী সরকার চাইছি বলে ভারত যে ক্যাম্পেইন করছে, এটা ভুল ধারণা। যতটকু বুঝি, চরমোনাই পীরের যে দল, তারাও চাইছে এই সরকার দীর্ঘকাল থাকুক।

সমকাল: নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কী বলবেন?

ফরহাদ মজহার: নির্বাচনের জন্য যখনই কোনো দল অযথা চাপ দেবে তখন আপনি বুঝবেন, সেই দলের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমরা কেমন দেশ চাই– জনগণের কাছ থেকে তার রায় নিতে হবে। গঠনতন্ত্র জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করে, আর আইন জনগণের ইচ্ছাকে আইনি ভাষায় ব্যক্ত করে।

সমকাল: আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মূল্যায়ন করুন। ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল এভাবে ধসে পড়ল কেন?

ফরহাদ মজহার: পপুলারিজমে ভর করে যে ফ্যাসিজম গড়ে উঠেছিল, এটা যে দুর্বল এবং ঠুনকো, তা শেখ হাসিনার মাথায় ছিল না। ছাত্রদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাদের যে রাজনৈতিক কৌশল, এর শক্তি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে ছাত্রদের এই প্রজ্ঞা ও কৌশলের হাতে; পরাস্ত হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণে। বাকশাল থেকে হাসিনা সরকার পর্যন্ত আমরা দীর্ঘকাল থেকে এই ফ্যাসিজমের সমালোচনা করছি। ছাত্র-তরুণদের সচেতন করার চেষ্টা করেছি। পলিটিক্যাল এডুকেশন যে এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যেতে পারে– এটা শেখ হাসিনা অনুমানই করতে পারেননি।

সমকাল: শেখ হাসিনাকে অনেক ঝানু রাজনীতিবিদ বলা হতো। তিনি বুঝতে পারলেন না কেন?

ফরহাদ মহজার: শেখ হাসিনা যখন ড. ইউনূসের সঙ্গে ব্যক্তিগত ইগোতে গেছেন, যখন ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন বলে তাঁকেও নোবেল পেতে হবে, এমন হাস্যকর বিষয় সামনে আসে; তখন তাঁর প্রজ্ঞা সম্পর্কে সাধারণ মানুষও বুঝতে পেরেছে। তিনি রাজনৈতিক দল, ব্যবস্থা, ক্ষমতা প্রভৃতি সামষ্টিক বিষয়কে ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। এর পরিণতি এখন তিনি ভোগ করছেন।

সমকাল: আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আবার ফিরে আসা সম্পর্কে কিছু বলুন। আমরা কি সংশোধিত আওয়ামী লীগ দেখতে পাব?

ফরহাদ মজহার: আমি মানুষে বিশ্বাস করি। এটা সংশোধনের ব্যাপার না। যখনই সিস্টেমটা আমরা শক্ত করব, তখন এই শক্ত ব্যবস্থার সুফল আওয়ামী লীগ নিজেও দেখবে। আওয়ামী লীগেরও অনেকের মধ্যে পরিবর্তন হবে। 

সমকাল: আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিও উঠছে।

ফরহাদ মজহার: আওয়ামী লীগ দল ও দলটির নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে অপরাধীদের অবশ্যই শনাক্ত করতে হবে ও শাস্তি দিতে হবে। গত দেড় দশকে যেসব অপরাধ হয়েছে, তার ন্যায়বিচার হতে হবে। তবে আমি একতরফা বিচারের পক্ষপাতী নই। তারা যেন মনে বল পায়, ন্যায়বিচারে আস্থা রাখে, সেই পরিবেশ তৈরি করা দরকার। তাদের মব ট্রায়ালের কাছে ছেড়ে দেওয়া ভুল হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিগত শাসনামলে অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগের কোনো অনুশোচনা নেই। 

সমকাল: একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের শাস্তি হবে এবং দলটির মধ্যে অনুশোচনাও আসবে– এমন বিচার কি সম্ভব? 

ফরহাদ মজহার: বিচারের আগে আমরা নেলসন ম্যান্ডেলার স্ট্র্যাটেজি একটু ভাবতে পারি। আমি বিনয়ের সঙ্গে চিন্তা করতে বলব, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের আদলে একটি ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন করতে পারি কিনা। আওয়ামী লীগের নেতা যারা ভুল করেছেন, তাদের বলব– আসেন, আমরা ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনে যাই। আমি একতরফা বিচারের পক্ষে না। সত্য যখন আমরা জানি, তখনই কিন্তু ন্যায়বিচার হয়। আর যখন আমরা সত্য জানি না, তখন আপনাকে আমি যতই শাস্তি দিলাম, মনে হয় শাস্তিটা ঠিক হয়নি। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। 

সমকাল: তরুণদের কি এ ব্যাপারে ধারণা রয়েছে?

ফরহাদ মজহার: বাংলাদেশের তরুণরা একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। তার মানে সমাজ, ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ও জানাশোনা অনেক গভীর। তা ছাড়া বাংলাদেশের তরুণরা তো একটি অ্যান্টি কলোনিয়াল, অ্যান্টি ইম্পেরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘকাল তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

সমকাল: আপনি এখন সারাদেশে ঘুরছেন। সাধারণ মানুষ আগের চেয়েও বেশি আগ্রহ নিয়ে আপনার কথা শুনছে। তার আগে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় নিয়মিত বিরতিতে আপনি ঈশ্বরদী এসেছেন। এখানকার মানুষ, এখানকার পরিবেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

ফরহাদ মজহার: দেখুন, ঈশ্বরদীতে আমরা বহু বছর ধরে উবিনীগের মাধ্যমে চলাফেরা, বসবাস করি। আমরা তো এখন এই সমাজেরই একজন। এখানকার ভূমি খুবই উর্বর। এই অঞ্চলের মাটি ও মানুষের জন্য যথাসম্ভব ভালো কিছু করার প্রচেষ্টা আগেও যেমন ছিল, এখনও রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি গণমুখী হয়, তাহলে ঈশ্বরদীর মাটি ও মানুষের জন্য আরও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। 

সমকাল: অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ফরহাদ মজহার: আমার মতো নগণ্য মানুষের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য আপনাকে ও সমকালকে ধন্যবাদ।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গঠনতন ত র ব যবস থ জনগণ র র র জন ক ত কর পর ব শ র জন য ক জ কর ন র জন আওয় ম অপর ধ ব এনপ আগস ট ক ষমত সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

হামাস যে কারণে আত্মসমর্পণ করবে না

ফিলিস্তিনের গাজা। একে আপনি যেভাবেই ডাকুন না কেন–গণহত্যা কেন্দ্র, রক্ত ঝরানোর এক অনন্ত চক্র, যন্ত্রণা ও মৃত্যুকূপ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির কিংবা ইসরায়েলের বড় অংশ একে যেভাবে দেখছে অর্থাৎ একে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষাও করতে পারেন। তেল আবিবের অ্যাশকেনাজি ইহুদিরা পশ্চিমা বুদ্বুদে বাস করে, সকালে ক্যাপুচিনোতে চুমুক দেয় আর তাদের যোগব্যায়ামের শিক্ষকের কথা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। অথচ অদূরেই ঘটছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, যা স্রেব্রেনিৎসা বা রুয়ান্ডার পর বিশ্বে দেখা যায়নি। একটা বিষয় তারা কেউই যেন বুঝতে পারছে না–হামাস আত্মসমর্পণ করবে না। হয়তো ধারণা করা হয়েছিল, গাজা থেকে হামাসের নেতারা এক সময়ের ফাতাহর মতো অর্থ নিয়ে পালাবেন। কিন্তু ১৮ মাসের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং দুই মাসের অনাহারের পরও তা না ঘটায় এটি স্পষ্ট–ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর শত্রুকে কতটা কম বোঝেন!
ইসরায়েলের সর্বশেষ ‘প্রস্তাব’ ছিল মূলত আত্মসমর্পণের আহ্বান। সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ৪৫ দিনের জন্য খাদ্য ও পানি সরবরাহ এবং হামাসকে নিরস্ত্র করার দাবি জানিয়েছিল ইসরায়েল। হামাসের জবাব ছিল: তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত, যদি বিনিময়ে কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি হুদনা বা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। মানে তারা আর নতুন টানেল খনন করবে না, অস্ত্র উন্নত করবে না এবং গাজার শাসনব্যবস্থা অন্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করবে। হামাস শুরুতেই তারা যে দুটি শর্ত দিয়েছিল, সেগুলো থেকে একচুলও সরেনি: তারা নিরস্ত্র হবে না এবং তাদের দাবি, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে যাক এবং এই যুদ্ধের পুরোপুরি অবসান ঘটুক।
আত্মসমর্পণ করবে না হামাস
হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না, তার অনেক কারণ রয়েছে। দিনরাত তারা এবং গাজার জনগণ যে দুর্দশা ভোগ করছে, তারপরও তারা পিছু হটছে না। মার্চে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার পর দেড় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। হামাসের প্রথম সারির নেতৃত্ব, বেসামরিক সরকার, পুলিশ বাহিনী এবং প্রায় সব হাসপাতাল শেষ হয়ে গেছে। রাফাহ শহর ধ্বংস করা হচ্ছে। তবুও নির্বাসনে যাওয়ার জন্য তাদের বিপুল অর্থ প্রস্তাব করলেও, তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রয়াত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত হয়তো অনেক আগেই নির্বাসনে চলে যেতেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন ১৯৮২ সালে পশ্চিম বৈরুতে পিএলও বাহিনী ঘেরাও হওয়ার পর। ফাতাহও এতক্ষণে বিদেশে পাড়ি জমাত। কিন্তু এই উদাহরণ হামাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেন?
প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা এবং সহিংসতা দেশটিকে যেমন চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, তেমনি গাজার ধ্বংসস্তূপ ফিলিস্তিনি সংগ্রামকেও ভিন্ন রূপ দিয়েছে। গাজা এখন সব ফিলিস্তিনির কাছে পবিত্র ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এই যুদ্ধে গাজার এমন কোনো পরিবার নেই, যাদের স্বজন শহীদ হয়নি বা যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়নি। হামাস বা অন্য কোনো প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে এই জনগণ থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। সমষ্টিগত কষ্ট যত বাড়ছে ততই তাদের নিজেদের ভূমিতে টিকে থাকার ইচ্ছাশক্তিও বাড়ছে; যেমনটা নিরস্ত্র দক্ষিণ হেবরনের কৃষকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন। আরও একটি বিষয়, ইসরায়েলের নির্দয় আচরণের কারণেই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রেরণা জন্মেছে। 
ইসরায়েলের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’
ইসরায়েল শুধু জমি বা নিয়ন্ত্রণই চায় না। তারা সব সময় আরও বেশি চায়। তাদের ধর্ম অঞ্চলের অন্য সব ধর্মের ওপর আধিপত্য বিস্তার না করা পর্যন্ত তারা থামে না। এমনকি ইস্টার সানডেতে খ্রিষ্টানরাও মুসলমানদের মতোই এই আচরণের শিকার হয়। তাদের বসতি স্থাপনের কাজ যুদ্ধের সময়ের তুলনায় শান্তির সময়েই আরও বাড়ে। যেমন অসলো চুক্তির পর তারা পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন করে।  
বস্তুত ইসরায়েল কখনোই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে বিশ্বাসী ছিল না, কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং তাদের উত্তরসূরিদের মনে সব সময় শুধু একটি রাষ্ট্রের ধারণাই ছিল। ইতামার বেন গভির, বেজালেল স্মোত্রিচ এবং নেতানিয়াহু মিলে যা করছেন, তা হচ্ছে ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করা’; অর্থাৎ ডেভিড বেন গুরিয়ন যে ফিলিস্তিনিদের ‘ইসরায়েলের ভূমি’ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন, সেটা সম্পন্ন করা।
আজ যদি হামাস আত্মসমর্পণ করে, গাজাও আত্মসমর্পণ করে, সেটি হবে পুরো ফিলিস্তিনি আন্দোলনের আত্মসমর্পণ। এটি এ কারণে নয় যে, সব ফিলিস্তিনি ধর্মপ্রাণ বা ফাতাহ অজনপ্রিয়। বরং এ কারণে যে, প্রতিরোধই এখন দখলদারিত্ব অবসানের একমাত্র পথ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল গাজা, পশ্চিম তীর, জেরুজালেম এবং নিজ দেশের ভেতরের সব ফিলিস্তিনির ওপর যে দুর্ভোগ চাপিয়ে দিয়েছে, তার ব্যাপকতা এমন যে এখন হামাসের ভাগ্যই ফিলিস্তিনের ভাগ্য হয়ে গেছে।
তবে হামাস থেকে ফাতাহ আলাদা এ কারণে যে, হামাস একটি ধর্মীয় সংগঠন। এই যুদ্ধের সূচনা তারা করেছিল আল-আকসা মসজিদে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের অনুপ্রবেশের প্রতিক্রিয়ায়। গাজার ফিলিস্তিনিরা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে, সেটার অর্থ খোঁজার জন্য তারা নিজেদের ধর্মের দিকেই ফিরে যাচ্ছে।
কৌশলগত কারণ
হামাস যে লক্ষ্যে স্থির, এ সংগঠন যে দুর্নীতির বাইরে, তার পেছনের কারণ তাদের সম্মিলিত শৃঙ্খলা ও ইমান। বিষয়টি সবার ওপরই প্রভাব ফেলেছে।
রিফাত রাদওয়ান। ২৩ বছর বয়সী একজন প্যারামেডিক পেশাজীবী, যাঁর মৃত্যুর মুহূর্তের কথা তিনি রেকর্ড করেছেন। মৃত্যুর আগে আল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করছিলেন যেন তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত না পড়ার জন্য ক্ষমা পান। তিনি হয়তো খুব ধার্মিক ছিলেন না এবং স্পষ্টতই হামাসের সদস্যও ছিলেন না, কিন্তু মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে ক্ষমা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস কতটা গভীর ছিল। যদি কখনও গাজার ফিলিস্তিনিদের সাহস ও আত্মত্যাগের কোনো প্রতীক খোঁজা হয়, রাদওয়ানই ছিলেন সেই প্রতীক। মৃত্যুশয্যাতেও তিনি ইমানের পরিচয় দিয়েছেন। গাজার ইমানও তদ্রূপ ধ্বংস হবে না। হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না, তার আরও কিছু কৌশলগত কারণও রয়েছে। একটি সংগঠন হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ যাই হোক, যেমন তামিল টাইগার বা চেচেন বিদ্রোহীদের মতো অনেক বিদ্রোহী দল বড় সামরিক শক্তির দ্বারা নির্মূল হয়েছে আবার ইটিএর মতো দলও লক্ষ্য অর্জন না করেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারপরও হামাস বিশ্বাস করে, তারা ইতোমধ্যে তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছে। সেই লক্ষ্য ছিল–ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংগ্রামকে আবারও বিশ্বের মানবাধিকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বেড়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ৫৩ শতাংশ ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক মত পোষণ করে, যা ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
জনমতও হামাসের পক্ষে, যেখানে হেরেছে ইসরায়েল। বিশেষ করে সেই সব দেশে, যেখানে হামাস নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত, মানুষকে বলা হয়েছে তারা যেন হামাসকে সন্ত্রাসী হিসেবে ভাবে। কিন্তু মানুষ ক্রমেই সেই ধারণা থেকে সরে আসছে। এমনকি যদিও তারা ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে ভয়ংকর অপরাধ হিসেবেই দেখে।
যদি ইসরায়েল চায় এই যুদ্ধকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে শেষ করতে, তবে তারা নিশ্চিত থাকতে পারে–একই লক্ষ্য প্রতিটি ফিলিস্তিনির মনেও স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। নেতানিয়াহু যতদিন এই ব্যর্থ অভিযানে গাজায় এগিয়ে যাবেন, ততদিন ইউরোপের বড় দেশগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যেমন ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার দিকে আরও এগিয়ে যাবে। v

ডেভিড হার্স্ট: মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক; মিডল ইস্ট আই থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অজ্ঞাত স্থানে বসে পরিষদ চালান ৩ চেয়ারম্যান
  • ভবদহের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কী 
  • জনগণ সাফার করছে, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিন: জামায়াতের আমির
  • প্রস্তুত ইসি, উন্মুখ ভোটার, কী করবে সরকার?
  • হামাস যে কারণে আত্মসমর্পণ করবে না
  • পোপের মৃত্যুতে দেওয়া শোকবার্তা মুছে ফেলল ইসরায়েল
  • অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত চীন: রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন
  • ৩১ দফা বাস্তবায়নই হবে বিএনপির ওপর নির্যাতনের প্রতিশোধ: তারেক রহমান
  • প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সাবধান করলেন মির্জা আব্বাস
  • ঢাকার দুই সিটিকে এক করার প্রস্তাব