দেশেই বড় পরিসরে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির উদ্যোগ
Published: 27th, January 2025 GMT
আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশেই বড় পরিসরে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ জন্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। তারা ২০১৮ সালের নীতিমালা বাস্তবায়ন ও নমনীয় সুদে ঋণ চান।
গত ১৮ নভেম্বর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে এমন লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছেন উপদেষ্টা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন তারা।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) এবং রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত রিএজেন্ট উৎপাদনে জৈব ও অজৈব ক্ষুদ্র অণু উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। মূলত চীন, ভারত ও কোরিয়া থেকে এগুলো আনা হয়। এতে বছরে খরচ প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। দেশে বড় পরিসরে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন শুরু হলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি অন্তত ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। একই সঙ্গে সাশ্রয়ী মূল্যে বিশ্বমানের কাঁচামাল পাবে দেশ।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে অন্তত ১১টি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান বর্তমানে এপিআই উৎপাদন করছে। এই খাতে বিনিয়োগ বাড়লে দেশের অন্তত ৫০ শতাংশ চাহিদা স্থানীয়ভাবে মেটানো সম্ভব। ২০১৭ সালে স্থানীয় উৎপাদকরা ৪১টি এপিআই মলিকিউল এবং রিএজেন্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এপিআই স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহিত করে আমদানিনির্ভরতা কমানো এবং রপ্তানির উদ্দেশ্যে এই প্রণোদনার ঘোষণা করে সরকার। ২০১৮ সালে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করা হয়। এতে ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল উৎপাদনকারীকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত আয়কর রেয়াত সুবিধা দেওয়া হয়। তবে এই সুবিধা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নানা শর্ত জুড়ে দেয়। শর্তের জালে আটকে যায় প্রণোদনা সুবিধা। ২০১৮ নীতিমালা হলেও এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০২১ সালের শেষে।
এনবিআর বলছে, যেসব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে এপিআই ও গবেষণাগারের রিএজেন্ট উৎপাদন করছে, তাদের জন্যও ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে কর রেয়াত প্রযোজ্য হবে। গত সোমবার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর জানায়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০৩২ পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধা উপভোগ করার জন্য উৎপাদনকারীকে প্রতি বছর অন্তত ৫টি এপিআই ও গবেষণাগার রিএজেন্ট উৎপাদন করতে হবে। ৫টির কম এপিআই বা রিএজেন্ট উৎপাদন হলে সুবিধা মিলবে না।
দেশে ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল তৈরিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সভাপতি এস এম সাইফুর রহমান সমকালকে বলেন, ২০১৮ সালের ওষুধ নীতি অনুসারে বাংলাদেশে নিবন্ধিত এপিআই ও ল্যাবরেটরি বিকারক উৎপাদকদের রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রদান ও স্বল্প শর্তে ঋণ দেওয়া হলে বিকাশ হবে এই শিল্পের। এ ছাড়া উৎপাদনে ক্রয় বিক্রি ভ্যাট ২০৩২ সাল পর্যন্ত মওকুফ করতে হবে। এপিআই মলিকিউল ও রিএজেন্ট উৎপাদকদের তাদের বার্ষিক মুনাফার কমপক্ষে ১ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে; যাতে পর্যায়ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংযুক্তি বাড়ে।
গণস্বাস্থ্য বেসিক কেমিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম জামালউদ্দিন বলেন, চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন করা হয়। তবে এর ৯৫ শতাংশ কাঁচামাল বাইরে থেকে আনতে হয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলে খরচ কমবে এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সক্ষমতা বাড়বে।
নিপ কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, চীন ও ভারত সরকার স্বল্প সুদে ঋণ দেয়। গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়। ভারত সরকার ৬২টি প্রয়োজনীয় ওষুধের কাঁচামাল দেশে তৈরি বাধ্যবাধকতা করেছে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। চীনেরও এমন অনেক উদ্যোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্র অনেক পিছিয়ে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এক সময়ের বনদস্যুর ‘বয়ানে’ সুন্দরবনে দস্যুতার দিনগুলো
সুন্দরবনে দস্যুতায় টাকা ছিল। কিন্তু সে অবৈধ টাকা নিজেরা উপভোগ করতে পারতেন না। বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যুঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াত, এক ঘণ্টা শান্তির ঘুমও হতো না। মোটেও সুখ ছিল না। দস্যুতার জগতে গিয়ে নিজের প্রাপ্তি বলতে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ডাকাত শব্দটি। স্ত্রী-সন্তানদেরও চলতে হতো মাথা নিচু করে। কথাগুলো একসময়ের বনদস্যু আল-আমীনের।
আল-আমীন বলেন, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তিনি ভালোই আছেন। আর কখনো ওই অন্ধকার পথে পা বাড়াতে চান না তিনি। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা খোড়লকাঠি বাজারসংলগ্ন কয়রা নদীর তীরে। ছোট বাজারটিকে সুন্দরবন থেকে আলাদা করেছে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদী।
নদীর ওপারের সুন্দরবনের ত্রাস ছিলেন আল-আমীন। তিনি বলেন, তখন শরীফ বাহিনী ছিল বড় দস্যুদল। সেই দলে যোগ দিয়ে ডাকাত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে এলাকায় নাম ছড়িয়ে গেলে বাড়ি ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা সুন্দরবনের মধ্যে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। র্যাব আর কোস্টগার্ডের অভিযানের ভয়ে বনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটত তাঁদের।
আল-আমীনের বলতে থাকেন, ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল তাঁর গণ্ডি। বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হতে চাইতেন, তবে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সুযোগ আসে। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। দস্যুনেতা শরীফ না চাইলেও তাঁকে কৌশলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাঁরা দলের ১৭ জন সদস্য ১৭টি অস্ত্র আর ২ হাজার ৫০০ গুলিসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
দস্যুজীবন যাঁরা একবার দেখেছেন, তাঁরা না খেয়ে থাকলেও আর দস্যুতায় ফিরতে চান না—এমনটাই দাবি আল-আমীনের। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গল্প গল্পে তিনি বলেন, ডাঙায় থাকা মাছ ব্যবসায়ীরা ডাকাতদের বাজার, বন্দুক, গুলি সবই সাপ্লাই দিতেন। সব জিনিসের দাম নিতেন তিন থেকে চার গুণ বেশি।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র, ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সব শেষ দস্যুদল হিসেবে আত্মসমর্পণ করে শরীফ বাহিনী। সেদিনই প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। তবে দস্যুনেতা শরীফ গত বছরের ৫ আগস্টের পর আবার সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন বলে তাঁর একসময়ের সাথীদের ভাষ্য।
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম। তিনি বলেন, দলনেতা শরীফের পুরো নাম করিম শরীফ। কয়রার আল-আমীন ছিল বাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। শরীফ প্রথমে আত্মসমর্পণে রাজি থাকলেও পরে বেঁকে বসেন। অন্যরা আত্মসমর্পণ করেন। তবে শরীফ এখন পুনরায় সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন।
কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম আবদুল মালেক বলেন, বনের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কমে আসায় সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। এভাবে দস্যুতা চলতে থাকলে বনজীবীদের জীবিকা, সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায় ও পর্যটন হুমকির মুখে পড়বে; বিপন্ন হবে বন্য প্রাণী আর প্রাণবৈচিত্র্য। দস্যুতা দমনে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।