অধিকার চাইতে গিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকরা কেন লাঞ্ছিত?
Published: 27th, January 2025 GMT
বঞ্চনা আর বৈষম্যের এক জ্বলন্ত নজির এ দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয়ভাবেই বৈষম্যের শিকার মাদ্রাসা ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। স্বাধীনতার পর থেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধের অন্যতম চর্চা ও লালনকারী শিক্ষার মাধ্যম মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অবহেলিত-উপেক্ষিত। চব্বিশের সফল জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা-মাদ্রাসা শিক্ষার্থী-দিনমজুর-কুলি-রিকশাচালক-শিশু-কিশোরের জীবনের বিনিময়ে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের এই সময়েও এই শিক্ষা ব্যবস্থার একই অবস্থা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে এসেও বঞ্চিত-চরম বৈষম্যের শিকার মাদ্রাসা শিক্ষক সমাজ আজ রক্তাক্ত-লাঞ্ছিত। এই রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের অবসান হওয়া জরুরি।
রাষ্ট্রীয়ভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বৈষম্যের একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান এখানে উল্লেখ করছি। ব্যানবেইসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষা ধারার প্রাথমিক শিক্ষাস্তর পরবর্তী নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, স্কুল ও কলেজ, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, ডিগ্রি (পাস) কলেজ, ডিগ্রি (সম্মান) কলেজ ও মাস্টার্স স্তরের কলেজসহ মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩৬৫৪টি। এর মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৩২৮টি। বেসরকারি ২২৩২৬টি। অপরদিকে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাসহ মোট মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯২৬৮টি। এর মধ্যে মাত্র তিনটি কামিল স্তরের মাদ্রাসা সরকারি। যেখানে জেনারেল খাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান ১৩২৮টি। মাস্টার্স স্তরের সরকারি কলেজই আছে ৬১টি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয়করণের দাবিতে বিগত কয়েক দিন ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মাদ্রাসার শিক্ষকরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় রোববার (২৬ জানুয়ারি) তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিতে গেলে মাদ্রাসার নারী-পুরুষ শিক্ষকরা পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন। নারী শিক্ষকসহ ছয়জন শিক্ষক আহত হয়েছেন। শিক্ষকদের প্রতি এই ন্যক্কারজনক হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং দোষীদের শাস্তিরও দাবি জানাচ্ছি।
আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, অনেকের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি এক ধরনের ঘৃণাভাব বিদ্যমান। তারা সবসময় মাদ্রাসাবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের তারা সবসময় অবমূল্যায়ন করে। সম্ভবত ২০০৩ কিংবা ২০০৪ সালের দিকের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। সে সময় ইরান সরকারের অর্থায়নে সে দেশের দূতাবাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক ভবন তৈরি করে দিতে চেয়েছিল। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। সেই ভবনে শুধু ফার্সি বিভাগই থাকবে এমন কোনো শর্তের কথা জানা যায়নি। ভবনটি তৈরি হলে ফার্সিসহ অন্যান্য বিভাগের এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরও ভালো কাজের ব্যবস্থাও করতে পারত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি আমি সে সময় একটি জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। এ জন্য এ নিয়ে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত অনেক ভিতরের খবরই আমার জানা ছিল। আমার মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সুশীল নামধারী শিক্ষক আর কয়েকটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের কিছু শিক্ষার্থী আওয়াজ তুলল, এই ভবন তৈরি করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘মাদ্রাসা’ হয়ে যাবে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভরে যাবে। ভবন আর তৈরি হলো না। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যেন ভর্তি হতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন সময়ে নানা রকম অযৌক্তিক ও বেআইননি শর্ত জুড়ে দেওয়ার ঘটনাও আমরা সবাই জানি।
আরেকটি ঘটনার কথা বলি। ঘটনাটি বর্তমানে আমার কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার শেষ ধাপ ভাইভা বোর্ড (যদিও ভাইভাতে কোনো নম্বর নেই এবং ভর্তির ক্ষেত্রে ভাইভা বোর্ডের সদস্যদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা ছাড়া আর কোনো ক্ষমতাও নেই)। ভাইভা শেষে বিভাগে এসে আমার একজন সম্মানিত সহকর্মী বললেন, ‘এ বার মাদ্রাসার ছাত্র দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভরে যাবে। ভাইভাতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের।’ এই কথা শোনার পর প্রকাশ্যেই সবার সামনেই আমি আমার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম– এবার কি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আলাদা প্রশ্নপত্র’ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে নাকি? নাকি একই প্রশ্নপত্র দিয়ে সবারই (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-ইংরেজি মাধ্যম) ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে? যদি এই একই প্রশ্নপত্র দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করে, তাহলে বুঝতে হবে প্রকৃতপক্ষে তারা অবশ্যই মেধাবী। এসব ছাড়াও চাকরির ভাইভাতেও মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকরি প্রার্থীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন না করে তাদের প্রতি বিরূপ আচরণের কথাও আমরা শুনতে পাই। এর মাধ্যমে এই শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ, সংকোচন কিংবা ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। বর্তমান অরাজনৈতিক-এলিট সরকারের আমলেও বিভিন্ন নিয়োগে এমনটি ঘটছে বলে আমরা জানতে পারছি।
শেষ কথা হচ্ছে, আমরা একটি শান্তিময় সমাজ চাই। সমাজে নৈরাজ্য, বিভাজন ও বৈষম্য চাই না। এটি সব ক্ষেত্রে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। কারণ, এখান থেকেই শিশুরা সাম্যের-ন্যায়বিচারের শিক্ষা অর্জন করবে। তাই আমরা মাদ্রাসার শিক্ষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি। ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের দাবিগুলো– (১) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নিবন্ধন স্থগিতাদেশ ২০০৮ প্রত্যাহার করা, (২) রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত কোডবিহীন মাদ্রাসাগুলো বোর্ড কর্তৃক কোড নম্বরে অন্তর্ভুক্তকরণ, (৩) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার আলাদা নীতিমালা, (৪) পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি, বেতন-ভাতা নীতিমালা-২০২৫ অনুমোদন, (৫) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো অফিস সহায়ক নিয়োগের ব্যবস্থা করা ও (৬) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি খোলার অনুমোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ। এসব দাবির কোনটি অনায্য? তাদের নায্য দাবি মেনে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। শুধু ইবতেদায়ি নয়, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে যে চরম বৈষম্য বিগত বছরগুলোতে হয়ে আসছে সেসব দূর করার প্রয়োজনীয় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ড.
শাফিউল ইসলাম: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ সরক র র পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
দেবীগঞ্জে দেয়ালে দেয়ালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে লেখা হয়েছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) সকাল থেকে পৌরসভার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে এই লেখা সাধারণ মানুষের নজরে আসে। তবে, কারা এই স্লোগান লিখেছেন, তা কেউ দেখেননি।
পৌরসভার শহীদ আব্দুল মান্নান সড়ক সংলগ্ন উপজেলা পরিষদ চত্বর, নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের দেয়ালে লাল, কালো ও নীল রঙের কালি দিয়ে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় শেখ হাসিনা’ এবং ‘শেখ হাসিনা তুমি আস্থা’- এমন স্লোগান লেখা হয়েছে।
এদিকে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অফিসিয়াল পেজ থেকে আজ দুপুর ১টায় দেবীগঞ্জের বিভিন্ন দেয়ালে লেখা স্লোগানের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করা হয়। এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
দেবীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান সুমন বলেন, ‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনকে জানানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাতের আঁধারে দেয়ালে দেয়ালে ‘জয় বাংলা’ লিখছে তারা। উপজেলা ছাত্রদলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সজাগ রয়েছে।"
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চগড় জেলা সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বলেন, “গত ৫ আগস্টের পর শুধু দেবীগঞ্জ নয়, পুরো পঞ্চগড়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেবীগঞ্জ, বোদা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে এসব দেওয়াল লিখন লক্ষ্য করা গেলেও প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা নেই। এসব লেখা ’২৪ বিপ্লবের চেতনাকে ম্লান করার চেষ্টা করছে। যা রুখতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রশাসনের প্রতি আহ্বান- তাদের (ছাত্রলীগ নেতাকর্মী) দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক। তাদের অপতৎপরতা রুখে দিতে পঞ্চগড় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।”
দেবীগঞ্জ থানার ওসি সোয়েল রানা মোবাইলে বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে আসছে। এখনি কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। বিষয়টি দেখছি আমরা।”
ঢাকা/নাঈম/মাসুদ