বঞ্চনা আর বৈষম্যের এক জ্বলন্ত নজির এ দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয়ভাবেই বৈষম্যের শিকার মাদ্রাসা ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। স্বাধীনতার পর থেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধের অন্যতম চর্চা ও লালনকারী শিক্ষার মাধ্যম মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অবহেলিত-উপেক্ষিত। চব্বিশের সফল জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা-মাদ্রাসা শিক্ষার্থী-দিনমজুর-কুলি-রিকশাচালক-শিশু-কিশোরের জীবনের বিনিময়ে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের এই সময়েও এই শিক্ষা ব্যবস্থার একই অবস্থা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে এসেও বঞ্চিত-চরম বৈষম্যের শিকার মাদ্রাসা শিক্ষক সমাজ আজ রক্তাক্ত-লাঞ্ছিত। এই রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের অবসান হওয়া জরুরি।   


রাষ্ট্রীয়ভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বৈষম্যের একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান এখানে উল্লেখ করছি। ব্যানবেইসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষা ধারার প্রাথমিক শিক্ষাস্তর পরবর্তী নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, স্কুল ও কলেজ, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, ডিগ্রি (পাস) কলেজ, ডিগ্রি (সম্মান) কলেজ ও মাস্টার্স স্তরের কলেজসহ মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩৬৫৪টি। এর মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৩২৮টি। বেসরকারি ২২৩২৬টি। অপরদিকে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাসহ মোট মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯২৬৮টি। এর মধ্যে মাত্র তিনটি কামিল স্তরের মাদ্রাসা সরকারি। যেখানে জেনারেল খাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান ১৩২৮টি। মাস্টার্স স্তরের সরকারি কলেজই আছে ৬১টি। 
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয়করণের দাবিতে বিগত কয়েক দিন ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মাদ্রাসার শিক্ষকরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় রোববার (২৬ জানুয়ারি) তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিতে গেলে মাদ্রাসার নারী-পুরুষ শিক্ষকরা পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন। নারী শিক্ষকসহ ছয়জন শিক্ষক আহত হয়েছেন। শিক্ষকদের প্রতি এই ন্যক্কারজনক হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং দোষীদের শাস্তিরও দাবি জানাচ্ছি।     


আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, অনেকের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি এক ধরনের ঘৃণাভাব বিদ্যমান। তারা সবসময় মাদ্রাসাবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের তারা সবসময় অবমূল্যায়ন করে। সম্ভবত ২০০৩ কিংবা ২০০৪ সালের দিকের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। সে সময় ইরান সরকারের অর্থায়নে সে দেশের দূতাবাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক ভবন তৈরি করে দিতে চেয়েছিল। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। সেই ভবনে শুধু ফার্সি বিভাগই থাকবে এমন কোনো শর্তের কথা জানা যায়নি। ভবনটি তৈরি হলে ফার্সিসহ অন্যান্য বিভাগের এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরও ভালো কাজের ব্যবস্থাও করতে পারত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি আমি সে সময় একটি জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। এ জন্য এ নিয়ে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত অনেক ভিতরের খবরই আমার জানা ছিল। আমার মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সুশীল নামধারী শিক্ষক আর কয়েকটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের কিছু শিক্ষার্থী  আওয়াজ তুলল, এই ভবন তৈরি করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘মাদ্রাসা’ হয়ে যাবে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভরে যাবে। ভবন আর তৈরি হলো না। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যেন ভর্তি হতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন সময়ে নানা রকম অযৌক্তিক ও বেআইননি শর্ত জুড়ে দেওয়ার ঘটনাও আমরা সবাই জানি।

আরেকটি ঘটনার কথা বলি। ঘটনাটি বর্তমানে আমার কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার শেষ ধাপ ভাইভা বোর্ড  (যদিও ভাইভাতে কোনো নম্বর নেই এবং ভর্তির ক্ষেত্রে ভাইভা বোর্ডের সদস্যদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা ছাড়া আর কোনো ক্ষমতাও নেই)। ভাইভা শেষে বিভাগে  এসে আমার একজন সম্মানিত সহকর্মী বললেন, ‘এ বার মাদ্রাসার ছাত্র দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভরে যাবে। ভাইভাতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের।’  এই কথা শোনার পর প্রকাশ্যেই সবার সামনেই আমি আমার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম– এবার কি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আলাদা প্রশ্নপত্র’ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে নাকি? নাকি একই প্রশ্নপত্র দিয়ে সবারই (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-ইংরেজি মাধ্যম) ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে? যদি এই একই প্রশ্নপত্র দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করে, তাহলে বুঝতে হবে প্রকৃতপক্ষে তারা অবশ্যই মেধাবী। এসব ছাড়াও চাকরির ভাইভাতেও মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকরি প্রার্থীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন না করে তাদের প্রতি বিরূপ আচরণের কথাও আমরা শুনতে পাই। এর মাধ্যমে এই শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ, সংকোচন কিংবা ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। বর্তমান অরাজনৈতিক-এলিট সরকারের আমলেও বিভিন্ন নিয়োগে এমনটি ঘটছে বলে আমরা জানতে পারছি। 


শেষ কথা হচ্ছে, আমরা একটি শান্তিময় সমাজ চাই। সমাজে নৈরাজ্য, বিভাজন ও বৈষম্য চাই না। এটি সব ক্ষেত্রে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। কারণ, এখান থেকেই শিশুরা সাম্যের-ন্যায়বিচারের শিক্ষা অর্জন করবে। তাই আমরা মাদ্রাসার শিক্ষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি। ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের দাবিগুলো– (১) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নিবন্ধন স্থগিতাদেশ ২০০৮ প্রত্যাহার করা, (২) রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত কোডবিহীন মাদ্রাসাগুলো বোর্ড কর্তৃক কোড নম্বরে অন্তর্ভুক্তকরণ, (৩) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার আলাদা নীতিমালা,  (৪) পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি, বেতন-ভাতা নীতিমালা-২০২৫ অনুমোদন, (৫) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো অফিস সহায়ক নিয়োগের ব্যবস্থা করা ও (৬) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি খোলার অনুমোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ। এসব দাবির কোনটি অনায্য? তাদের নায্য দাবি মেনে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। শুধু ইবতেদায়ি নয়, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে যে চরম বৈষম্য বিগত বছরগুলোতে হয়ে আসছে সেসব দূর করার প্রয়োজনীয় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। 


 ড.

শাফিউল ইসলাম: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস থ সরক র র পর ক ষ

এছাড়াও পড়ুন:

সাতকানিয়ায় ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে নিহত ২, গুলিবিদ্ধ ৪ বাসিন্দা

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে দুই যুবক নিহত হয়েছেন। এর আগে ওই যুবকদের গুলিতে স্থানীয় চার বাসিন্দা আহত হন। সোমবার রাতে সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

নিহত যুবকদের পরিচয় তাৎক্ষণিক নিশ্চিত করতে পারেননি পুলিশ। গুলিবিদ্দ স্থানীয় চার বাসিন্দা হলেন ওবায়দুল হক (২২), মামুনুর রশিদ (৪৫), নাসির উদ্দিন (৩৮) ও আব্বাস উদ্দিন (৩৮)। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, আটটি গুলির খোসা এবং একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করেছে।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার রাত সাড়ে নয়টা থেকে দশটার মধ্যে চারটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে একদল যুবক ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। এ সময় স্থানীয় মসজিদে ডাকাত পড়েছে এমন প্রচারের পর লোকজন জড়ো হয়ে অটোরিকশায় করে আসা দুই যুবককে আটক করে পিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই দুই যুবক নিহত হন।

এক যুবকের লাশের পাশ থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুই যুবককে আটকের আগে গুলির ঘটনায় আহত চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দলসহ সাতকানিয়া থানা পুলিশের সদস্যরা।

সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডাকাত সন্দেহে মসজিদের মাইকে প্রচারের পর স্থানীয় বাসিন্দাদের পিটুনিতে দুই যুবক নিহত হয়েছেন। এখনো ওই দুই যুবকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ