রাজশাহী সুগার মিলে চিনির দাম বেশি চাওয়ার প্রতিবাদ করায় দুই কর্মচারী রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ওই ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে সুগার মিলের প্রশাসনিক ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছেন ‘এলাকার কিছু ছেলে’। এ সময় মারফুল ইসলাম দুলাল নামে এক ওজনদারকে পিটিয়ে আহত করেন তারা।

সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে ঘটনাটি ঘটে।

আহত রফিকুল ও মারফুল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি।

আরো পড়ুন:

মৌলভীবাজারে ‘ভারতীয়দের কোপে’ বাংলাদেশির ‍মৃত্যু

গোপালগঞ্জে সমন্বয়কদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা

আহত রফিকুলের অভিযোগ, রেশন বিতরণের দায়িত্বে থাকা করনিক শাহীনুর রহমান এবং ওজনদার মারফুল ইসলাম দুলাল তাকে মারধর করেছেন। 

রফিকুল জানান, এক বস্তা (৫০ কেজি) চিনির দাম ৬ হাজার ২০০ টাকা। তিনি চিনি নিতে গেলে সাড়ে ৬ হাজার টাকা চাওয়া হয়। তিনি প্রতিবাদ করলে শাহীনুর ও মারফুল বাকবিতণ্ডা শুরু করেন। একপর্যায়ে তাকে মারধর করা হয়। এতে তার চোখের নিচে জখম হয়। রফিকুল চিনিকল থেকে বের হয়ে বাসায় চলে যান। এ সময় তাকে রক্তাক্ত দেখে এলাকার ছেলেরা চিনিকলে হামলা চালায়। 

রফিকুল দাবি করেন, তিনি নিজে হামলার সময় যাননি। আহত হওয়ায় চিকিৎসার জন্য তিনি রামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। 

রেশন করনিক শাহীনুর রহমান জানান, দুপুর ১২টার দিকে রফিকুল ইসলাম রেশনের এক মণ চিনি নিতে আসেন। এ সময় তার কাছে চিনির দাম ছাড়াও বস্তার দাম বাবদ আরো ২০ টাকা চাইলে তর্কবিতর্ক শুরু করেন। এর জেরে রফিকুল ফোন করে তার নিজ এলাকা শ্যামপুরের লোকজনকে ডাকেন। কিছুক্ষণ পর অন্তত ১০ থেকে ১২ জন এসে প্রশাসন ভবনে হামলা করে। এ সময় রেশন করনিক শাহীনুর ও ওজনদার মারফুলকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে শাহিনুর সেখান থেকে পালিয়ে গেলেও দুলালকে জখম করে ওই ব্যক্তিরা। এ সময় পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। 

রাজশাহী চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ন কবীর বলেন, “হামলাকারীরা তিনতলা প্রশাসন ভবনের প্রতিটি ফ্লোরেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কক্ষ ভাঙচুর করেছে। চেয়ার, টেবিল ও টেবিলের কাঁচ ভাঙচুর করেছে। সাতটি কম্পিউটার ও প্রিন্টার ভেঙে ফেলা হয়েছে। চিনি বিক্রির কিছু টাকাও লুট হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা দ্রুতই থানায় একটা অভিযোগ দায়ের করব।”

তিনি আরো বলেন, “কেন এমন ঘটনা ঘটেছে সেটা এখনই বলতে পারছি না। পুলিশ এসেছে, তদন্ত করছে।”

রাজশাহীর কাটাখালী থানার ওসি আবদুল মতিন বলেন, “আমরা এখনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। হামলার খবর শুনেই আমরা এসেছি। প্রাথমিক তদন্ত চলছে। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ঢাকা/কেয়া/মাসুদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ল ইসল ম র কর ছ এ সময়

এছাড়াও পড়ুন:

নৈঃশব্দ্যের টংকার

নৈঃশব্দ্য একপ্রকার বাঁশের বাঁশি। কখনও মধ্যমাঠে খাঁখাঁ দুপুরে রাখাল বাজায়। বাঁশির ভেতরে যে নৈঃশব্দ্য বিরাজ করে তার মুখরন্ধ্রে ঠোঁট লাগিয়ে, স্বররন্ধ্র ও গর্ভরন্ধ্রের ওপরে আঙুল বিছিয়ে যে সুর সৃষ্টি করে বাঁশরিয়া, তা তো নৈঃশব্দ্য থেকেই! 

নৈঃশব্দ্যই শব্দের ভেতরে টংকার মারে। কীভাবে? নৈঃশব্দ্য না থাকলে শব্দ কী করে শব্দ করত? জগৎজুড়ে নৈঃশব্দ্যের মহড়া চলছে– এই মহড়া শব্দ করেই হয়। নৈঃশব্দ্যের প্রাথমিক অনুবাদের জন্য যদি একটি মেটাফর ধার করে বলি, তাহলে বলা যায়– নৈঃশব্দ্য আর শব্দ পিঠেপিঠি সহোদর কিংবা সহোদরা। এও বলা যায়, নৈঃশব্দ্য ঘরের বন্ধ কপাটের মতন। বন্ধ থাকলে অভ্যন্তরে শত রকমের নৈঃশব্দ্য জড়ো হতে থাকে। যেখানে গুম আছে, খুন আছে, গোঙানি আছে, হতাশা আছে, বেদনা আছে, গুমোট বাতাস থির হয়ে আছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলি স্লোগানের অপেক্ষায় তীব্র হয়ে আছে। আবার এই নৈঃশব্দ্যের ভেতরে আহত ডানার পাখিরা কপাট-খাঁচায় বন্দি হয়ে আছে। কপাট খুলতে গেলেই শব্দের ঔরস থেকে এইসব নৈঃশব্দ্য বেরিয়ে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে; নৈঃশব্দ্য তখন শব্দ হয়, কথা কয়– গুমের বিরুদ্ধে, খুনের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ করে, রুখে দাঁড়ায়, চোখ রাঙিয়ে শাসায়। আহত ডানার পাখিদের শুশ্রূষা করে। 
নৈঃশব্দ্য খণ্ড খণ্ড পাথর, মিছিলের মতো জড়ো হতে থাকে। পাথরগুলি ছুড়ে মারলেই শব্দ করে ওঠে। যেন মিছিলের মুখগুলি স্লোগান তোলে– ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি? এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি’ (সুকান্ত ভট্টাচার্য)। কিংবা কবি রকিব লিখনের পঙ্‌ক্তির মতো– ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ/ যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবেই বাংলাদেশ।’ নৈঃশব্দ্যে রচিত এই যে কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা যখন গণমানুষের মুখে শব্দ করে ওঠে, তখনই নৈঃশব্দ্য অনূদিত হয়– মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে। 
নৈঃশব্দ্য একপ্রকার বাঁশের বাঁশি। কখনও মধ্যমাঠে খাঁখাঁ দুপুরে রাখাল বাজায়। বাঁশির ভেতরে যে নৈঃশব্দ্য বিরাজ করে তার মুখরন্ধ্রে ঠোঁট লাগিয়ে, স্বররন্ধ্র ও গর্ভরন্ধ্রের ওপরে আঙুল বিছিয়ে যে সুর সৃষ্টি করে বাঁশরিয়া, তা তো নৈঃশব্দ্য থেকেই! অসংখ্য শব্দের ভেতরে যখন কোনো শব্দই আর কানে আসে না, তখন শহরের বুক চিড়ে ভেসে আসা কোনো এক অচিন বাঁশরিয়ার বাঁশির সুর আমাদের তছনছ করে দেয়– প্রাণের ভিতরে নৈঃশব্দ্য শব্দ করে বেজে ওঠে– কখনও মুগ্ধ হই, কখনও করুণ হই। 
নৈঃশব্দ্যের রূপ কত প্রকারের তা অনুবাদ করতে হলে বহু যুগের, বহু দেশের, বহু ভাষার, বহু বেদনার, বহু বন্দিশালার অভ্যন্তরে ঢুকে, বহু প্রাণীর আলজিভের ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করতে হবে। না হলে এই অধরাকে নৈঃশব্দ্যকে ছোঁয়া যাবে না। তাহলে এও বলা যায়, নৈঃশব্দ্য এমন এক অধরাও বটে!
কখনও মনে হয় নৈঃশব্দ্য হচ্ছে পিঠমোড়া বান দিয়ে রৌদ্রে ফেলে রাখা এক সিঁধেল চোর, যে পুকুরচোরাদের জন্য তীব্র এক প্রতিবাদ! যাদের অধিকাংশ চিরকাল ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। ছোট অপরাধের জন্য বড় রকমের শাস্তির এই নির্মম দৃশ্য যখন এক কিশোর ভোরবেলা তার বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে এই সিঁধেল চোরকে বেধড়ক পেটাতে দেখে হুহু করে– সেই কিশোরের বেদনার ভাষা অনুবাদ করতে গেলে নৈঃশব্দ্যের কাছেই পরম আশ্রয় নিতে হয়।
দেয়ালে শতবর্ষের এক পেন্ডুলাম ঘড়ির পাশে টিক্‌ টিক্‌ করে ডেকে ওঠা লেজকাটা টিকটিকিটির ভিতরেও রয়েছে অসীম নৈঃশব্দ্য। থেমে থাকা ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে টিকটিকিটা ডেকে ডেকে কয়– ‘থেমে থাকা দেয়ালের ঘড়ি/ চল্‌ সময়ের সাথে লড়ি।’
মেঝেতে পড়ে থাকা নৈঃশব্দ্য যেন একটা হারমোনিয়াম। যার সাদা রিডের ভেতর উঁচু হয়ে থাকা করুণ কালো রিডগুলি প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে আছে। কোনো এক শিল্পীর হাতের আঙুলগুলি তার দেহে প্রয়োজনমতো স্পর্শ দেবে আর টুপটাপ ঝরে পড়বে নৈঃশব্দ্য– সংগীতের বহুমাত্রিক সুরে। কেউ তাকে বলবে– সা রে গা মা পা, কেউ তাকে বলবে মা পা ধা নি সা।

আবার কেউ নৈঃশব্দ্যকে বাজাতে গাইবে সুরেন্দ্রনাথ রায়ের স্বপ্ন– গা গা রে সা সা, রে রে গা সা/ পা পা মা গা গা রে সা রে গা সা। হারমোনিয়ামের রিডের মধ্যে জমানো নৈঃশব্দ্য তখন হাওয়াই দ্বীপ থেকে আগৈলঝাড়ায় আসে, একলা বসে গায়– ‘প্রেম তুমি আমার জন্য কত কষ্ট সহিলে।’ হাওয়াই দ্বীপের নৈঃশব্দ্য তখন পৃথিবীর সমস্ত দেশে দেশে হাওয়াইন গিটারে স্টিল তারে শব্দ হয়ে ওঠে– মিড় দেয়, গান করে, ভালোবাসে, ভালোবাসায়। 
এখন একটা নৈঃশব্দ্যের গল্প বলে নৈঃশব্দ্যের এই সংক্ষিপ্ত অনুবাদের পরিসমাপ্তি টানি। তখন ১৯৮৮ সাল। উত্তর বরিশালের একটি থানা– আগৈলঝাড়া। সপ্তাহের একটি দিন শনিবার, মানে হাটবার নৈঃশব্দ্য যেন শব্দ করে ওঠে; সপ্তাহের অন্য ছয় দিন নৈঃশব্দ্যরা এখানে জড়ো হয় শনিবারের উদ্দেশ্যে। এই থানা বা উপজেলা যা-ই বলি, এর প্রতিটি ইউনিয়নের অধিবাসী তখন হাটবারের জন্য অপেক্ষা করত। কেউ যেত বেচতে, কেউ কিনতে। কোনো গৃহস্থ তার পালিত হাঁসজোড়া, কেউ তার পালিত মোরগজোড়া, কেউ তার ক্ষেতের টাটকা সবজি ইত্যাদি বিক্রি করে চাল-ডাল-নুন-তেল কিনে ঘরে ফিরত। কেউ শুধু কিনতে যেত, আবার কেউ বেচতে যেত– কেউ এমনি এমনিও যেত। কেনাবেচার এই হাটের কেন্দ্রস্থলে ছিল একটি বটগাছ। বটগাছটির নিকটপুবে ছিল একটি চৌচালা টিনের ঘর, বারান্দাসহ। এই ঘরে হাটবার আর সপ্তাহের অন্য দিনগুলো প্রায় সমান ছন্দে চলত। মানে এই ঘরে কোনো কেনাবেচা ছিল না। ছিল দেওয়া-নেওয়া। চৌচালা টিনের ওই ঘরে নৈঃশব্দ্যকে সঙ্গী করে বাস করতেন একজন অপরিমেয় মানুষ– সুরেন্দ্রনাথ রায়। তখন বয়স তাঁর আশির ঘরে। যতদূর শুনেছি, যৌবনে তিনি তাঁর সমবয়সী ফুপুকে (পিসি) ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেন। এবং দেশান্তরী হন। পরিবারচ্যুত ও সমাজচ্যুত হয়ে প্রথমে আরেক দেশে চলে যান। তারপর ইংল্যান্ড, জার্মানিসহ পৃথিবীর বহু দেশ পরিভ্রমণ করে প্রৌঢ় বয়সে একা ফিরে আসেন নিজগাঁয়– আগৈলঝাড়ায়। আমার দেখা তিনি এমনই একজন নৈঃশব্দ্য, যিনি যে কোনো নৈঃশব্দ্যের ভেতর টংকার দিতে পারতেন, ঝংকার তুলতে জানতেন। তাঁর ফিরে আসার নৈঃশব্দ্যটা বলি। সমাজচ্যুত হওয়ার দায়ে তিনি কাছের সবাইকে হারালেন এমন এক নৈঃশব্দ্যের ভেতর। হারিয়ে জীবনের সায়াহ্নে ফিরলেন একা বহু নৈঃশব্দ্যের শব্দকে সঙ্গে নিয়ে। তারের সব রকমের বাদ্যযন্ত্র তিনি বানাতে ও বাজাতে পারতেন। এ ছাড়া তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশিসহ সংগীতের বহু নৈঃশব্দ্য তিনি রচনা করতে পারতেন। এমনকি টাইপরাইটারও বানাতে পারতেন। শুনেছি ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের স্টেনোটাইপরাইটারের পদেও কাজ করেছেন। আপনারা, যারা তাঁর গল্প শুনেছেন বা কাছ থেকে দেখেছেনও, তারা হয়তো তাঁর সম্পর্কে আরও অধিক কিছু জেনে থাকবেন। ১৯৮৮ সালে আমি তাঁকে প্রথম কাছ থেকে দেখি। তাঁর সম্পর্কে একটি মিথ প্রচলিত ছিল– তিনি যখন মধ্যরাতে বেহালায় ছড় দিয়ে বাজাতেন, তখন নাকি বটবৃক্ষের পাতাও ঝরে পড়ত! বেদনার এমনই নৈঃশব্দ্য তিনি বেহালার দেহে বিস্তার করেছিলেন। তিনি একই সঙ্গে টাইপরাইটার, গিটার, হারমোনিয়াম, বেহালা, তবলা শেখাতেন। তবে তিনজন তিনজন করে। বেহালা হলে– তিনজন। তবলা হলে– তিনজন। বাঁশি হলে– তিনজন। তিনি একলা খাটে মাথার নিচে একটি বালিশ দিয়ে চিৎ হয়ে পায়ের ওপরে পা তুলে পা নাড়াতে নাড়াতে তাল দিতেন, আর বলতেন বাজাও। তালে ভুল হলে তার পা থেমে যেত এবং কিছুটা ব্যথিত হয়ে বলতেন– ‘কী বাজাচ্ছ?’ উঠে আবার তাল ধরে দিয়ে বিছানায় যেয়ে পূর্বের ভঙ্গিতে পায়ে তাল ধরতেন। এভাবে তিনি বাদ্যযন্ত্রের ভেতর দিয়ে নৈঃশব্দ্যকে শব্দ করে তুলতেন। আমি যখন প্রথম দিন একটি হাওয়াইন গিটার নিয়ে তার দুয়ারে যাই, অচেনা এই তরুণকে দেখে তেমন কিছুই বললেন না। আমি তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। কিছু বললেন না। নৈঃশব্দ্যের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই তিনি আমাকে বললেন– ‘ওটা কী?’ বললাম– ‘গিটার।’ তিনি জানতে চাইলেন– ‘গান শিখবে না গিটার?’ আমি বললাম– ‘গিটার।’ ‘ওই খালি চেয়ারটিতে বসো।’ চেয়ারে বসলাম। বললেন– ‘যা পারো তা বাজাও।’ আমি সা রে গা মা পা ধা নি সা– আরোহণ ও অবরোহণ করলাম। তারপর আমার গিটারটি হাতে নিলেন। এইবার আমি আরেক নৈঃশব্দ্যের দেখা পেলাম। যে দেখায় মনে হবে পৃথিবীর অমিয় সুধার স্বরলিপি বেজে উঠতে পারে তাঁর হাতে। তিনি একটা গান বাজালেন– 
“ওই    মালতীলতা দোলে
 পিয়ালতরুর কোলে পুব-হাওয়াতে।।
মোর    হৃদয়ে লাগে দোলা, ফিরি আপনভোলা–
মোর    ভাবনা কোথায় হারা  মেঘের মতন যায় চলে।।
জানি নে কোথায় জাগো  ওগো বন্ধু পরবাসী
কোন্‌     নিভৃত বাতায়নে।
সেথা     নিশীথের জল-ভরা কণ্ঠে
কোন্‌     বিরহিণীর বাণী  তোমারে কী যায় ব’লে।।”
গিটারটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই গানে মিড় খুব আছে, হাওয়াইনের প্রাণ মিড়।’ আমার মনে হলো তিনি আসলে নৈঃশব্দ্যের অনুবাদ করলেন মিড় দিয়ে। ফলে নৈঃশব্দ্যের আরেক অনুবাদ হতে পারে মিড়। এই মিড়ের ভেতর তিনি কি তাঁর সমবয়সী ফুপুকে ভালোবাসার অপরাধে নৈঃশব্দ্যকে বাজিয়ে তুলতেন একাকী ঘরে? যে নৈঃশব্দ্যের শব্দ সুর হয়– তার অনুবাদ কী হবে?
ধীরে ধীরে আমি তাঁর নৈঃশব্দ্যের ক্ষণিক সঙ্গী হয়ে উঠতে থাকলাম। তখন দৈনিক সংবাদ পত্রিকা একটা বিরাট ঘটনা। আমি ভাবলাম, এমন নৈঃশব্দ্যকে পত্রিকার পাতায় শব্দ করে তুলি। তাঁকে বললাম– ‘আপনাকে নিয়ে আমি দৈনিক সংবাদের পাতায় একটি ফিচার করতে চাই, আপনি কি আমাকে অনুমতি দেবেন?’ উত্তরে তিনি বললেন– ‘জীবনে সব কথা বলতে নেই। সবকিছুকে ফিচারও করতে নেই। গিটার শেখা আর গান শেখা এক নয়। গান শিখতে এলে আমি তোমাকে গিটার শেখাতাম না। ধরো, জীবনের এমন কিছু কথা আছে যা অব্যক্ত থাকা দরকার– সবকিছু ব্যক্ত হলে অব্যক্ত কিছু থাকে না আর। তখন তোমার আর কোনো কথাও থাকবে না, ব্যথাও থাকবে না। মানুষের জীবন ব্যথায় ভরা। তাই তো এই গিটারের তারে তারে ব্যথা, বরং এই ব্যথা-বেদনাকে বাজায়ে তোলো আনন্দে।’ নৈঃশব্দ্যেরও যে নৈঃশব্দ্য, সেখানে কেউ টংকার মারে, আমি তাঁর কাছে মিড়ে মিড়ে নৈঃশব্দ্যের সেই টংকার শিখেছিলাম। ফলে নৈঃশব্দ্য একটা মিড়– টংকার শেখার ব্যাপার। যে শিখে সে বলতে চা‌য়; যে শেখায়, সে বলে না। না বলা অপার।  
আমি তাঁর কাছে কয়েক মাস হাওয়াইন গিটার শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর হাতে আঁকা সেই গিটারের দেহ সংবলিত হাতের লেখা ও আঁকা এখনও আমার কাছে অবশিষ্ট আছে। আমি ছাড়া আর কেউ জানতেও পারবে না– তাঁর যারা ছাত্রছাত্রী ছিল, তাদের সঙ্গে আমার যে নৈঃশব্দ্যের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল– সেই নৈঃশব্দ্য এমনই যে আজ আর কারও মুখস্মৃতি মনেও করতে পারব না। ফলে নৈঃশব্দ্য এমনই এক বিস্মৃতি, যার মুখ মনেও পড়ে না কিন্তু তার জন্য বুকের গভীরে জমে থাকে দারুণ পিরিতি। 
আজ নৈঃশব্দ্যের এই অনুবাদ শেষ করি– এ মুহূর্তে ফিলিস্তিনের যে শিশুটির গায়ে বোমা মেরে উড়ে গেল ইসরায়েলের বোমারু বিমানের বৈমানিক– তার জন্য আমার রচিত নৈঃশব্দ্য হোক পাশবিক। চিরদিন কেউ বাঁচবে না। পৃথিবীর সমস্ত গোপন ও প্রকাশ্য হত্যা নৈঃশব্দ্যকে জানান দিক। বটতলার টিনের চৌচালা ঘরে একাকী বেহালা বাজানো লোকটার মতো তুমি আর কত নৈঃশব্দ্যে শব্দ ছড়াবে? প্রিয় নৈঃশব্দ্য, তুমি শব্দ করে বলো তো! 

সম্পর্কিত নিবন্ধ