কলম্বিয়া থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা সব পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে কলম্বিয়াও।

সোমবার (২৭ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কার করতে শুরু করেছেন। বিমানে তুলে তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে নিজ নিজ দেশে।

আরো পড়ুন:

‘রোহিঙ্গা সহায়তা চলবে’, ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

আমরা গ্রিনল্যান্ড পেতে যাচ্ছি: ট্রাম্প

রবিবার (২৬ জানুয়ারি) এমনই দুটি মার্কিন বিমানকে কলম্বিয়া অবতরণ করতে দেয়নি। যার জেরে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। 

ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে কলম্বিয়া থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে, যা এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হবে।”

ট্রাম্পের এই হুমকির প্রতিক্রিয়ায় কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা সব পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পাল্টা ঘোষণা দিয়েছেন। 

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি কলম্বিয়ার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্য ও সমর্থকদের ওপর ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা’, তাৎক্ষণিক ‘ভিসা প্রত্যাহার’ ও ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করবেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কলম্বিয়ার সব নাগরিক ও সীমান্তে তাদের পণ্যে নজরদারি বাড়াবেন। 

ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে আরো লিখেছেন, “এই পদক্ষেপগুলো কেবল শুরু। যে অপরাধীদের তারা যুক্তরাষ্ট্রে ঠেলে দিয়েছে, তাদের ফেরত নিতে তাদের আইনগত দায়িত্ব আমরা কলোম্বিয়ান সরকারকে লঙ্ঘন করতে দেবো না।”

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক্স-এ একটি পোস্টে বলেছেন, “প্রতিটি জাতির দায়িত্ব হলো তাদের নাগরিকদের যারা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন তাদের দ্রুততার সঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়া।” 

রুবিও আরেকটি পোস্টে বলেছেন, কলম্বিয়ার নাগরিকদের আপাতত আর মার্কিন ভিসা দেওয়া হবে না। তিনি কলম্বিয়ায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে ভিসা প্রদান স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। 

এদিকে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো এক্স-এ একটি দীর্ঘ পোস্টে উল্লেখ বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন না, কারণ এটি ‘একটু বিরক্তিকর।’

পেট্রো বলেন, “আমার দেশ মিশরীয় ফারাওদের সময়ে কাজ করা স্বর্ণকার ও চিরিবিকেতে বিশ্বের প্রথম শিল্পীদের দ্বারা গঠিত। আপনি কখনই আমাদের শাসন করতে পারবেন না।” 

পেট্রো এর আগে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি অভিবাসী বহনকারী মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিমান নামতে দেননি এই বার্তা দেওয়ার জন্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ‘কলম্বিয়ান অভিবাসীদের অপরাধী হিসাবে বিবেচনা করতে পারে না’।

এক্স পোস্টে তিনি বলেন, “আমি অভিবাসীদের এমন একটি দেশে থাকতে দিতে পারি না যে দেশ তাদের চায় না; কিন্তু যদি সেই দেশ তাদের ফেরত পাঠায়, তবে তা তাদের ও আমাদের দেশের জন্য মর্যাদা এবং সম্মানের সঙ্গে হতে হবে।”

কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট তার পোস্টে একটি নিউজের ভিডিও জুড়ে দেন, যেখানে ব্রাজিলে পাঠানো অভিবাসীদের বিমান বন্দরের টারম্যাকে ডাণ্ডা-বেড়ি পরিহিত অবস্থায় হাঁটতে দেখা যায়।

পেট্রোর বক্তব্যে, “শরণার্থীরা দুষ্কৃতকারী নন। একজন মানুষের যে সম্মান প্রাপ্য, তাদের সাথে সেরকম সম্মানের সাথে আচরণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সে কাজ করেনি, তা-ই আমি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিমান ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।”

পেট্রো জানিয়েছেন, কলম্বিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়া শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের সেনাবাহিনীর বিমান নয়, বেসামরিক বিমানে পাঠাতে হবে। তাদের সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের মতো ব্যবহার করা যাবে না।

এদিকে ট্রাম্পের শুল্ক পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন ডেমোক্র্যাটিক আইন প্রণেতা। নিউ ইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ সতর্ক করে বলেছেন, শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। 

তিনি বলেন, “ট্রাম্প মূলত মুদ্রাস্ফীতিকে শ্রমিক শ্রেণীর আমেরিকানদের জন্য আরো খারাপ করে তোলার চেষ্টা করছেন, ভালো নয়। তিনি নিজের এবং কোটিপতি শ্রেণীর পকেট ভরছেন।”

অন্যদিকে, কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টও তার দেশে বিরোধীদলের তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছেন।  

ডানপন্থি ডেমোক্রেটিক সেন্টার পার্টির ব্যানারে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ইভান ডুকে বলেছেন, “তার প্রতিদ্বন্দ্বী আলোচনার চেষ্টা না করেই মার্কিন সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ‘ভয়ানক দায়িত্বহীনতার’ একটি কাজ করেছেন।”

এক্স-এ একটি পোস্টে ইভান ডুকে বলেন, “মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপের পদক্ষেপটি কলম্বিয়া ও এর নাগরিকদের ভোগান্তি বাড়াবে। পেট্রো সরকার দেশকে মার্কিন বিরোধী বক্তব্যের ঊর্ধ্বে রাখা ও নির্বাসিত কলম্বিয়ানদের গ্রহণের জন্য দ্রুত প্রোটোকল প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এমন পরিস্থিতি এড়ানো উচিত যা কাঠামোগতভাবে আমাদের অর্থনীতি ও আমাদের নাগরিকদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।”

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি অফিসের মতে, ২০২২ সালে কলম্বিয়ায় মার্কিন রপ্তানি ছিল ২৮.

৭ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আমদানি ছিল ২৪.৮ বিলিয়ন ডলার।

কলম্বিয়া থেকে মার্কিন আমদানির শীর্ষে রয়েছে অপরিশোধিত তেল, কফি, কাটা ফুল এবং সোনা, অন্যদিকে কলম্বিয়া প্রচুর পরিমাণে মার্কিন পেট্রোল, ভুট্টা এবং সয়াবিন আমদানি করে।

ট্রাম্পের অভিবাসন কঠোর ব্যবস্থা ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ১ কোটি ১০ লাখ থেকে ১৪ লাখ অবৈধ অভিবাসীর সিংহভাগের উৎস।

শনিবার ব্রাজিল ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিবাসীদের ‘অপমানজনক আচরণ’ করার অভিযোগ করেছে। কারণ একটি বেসামরিক বিমানে করে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো সময় হাতকড়া পরানো হয়েছিল বলে জানা গেছে।

ঢাকা/ফিরোজ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর শ ল ক আর প র শ শ ল ক আর প কলম ব য় র কলম ব য র জন য আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি

প্রতিবছর সারা বিশ্বে ১ মার্চ আন্তর্জাতিক বৈষম্যবিহীন দিবস হিসেবে পালিত হয়। অর্থাৎ সেদিন নতুন করে উচ্চারিত হয় যে সারা বিশ্ব যেন শূন্য-বৈষম্যের বিশ্ব হয়। অসমতা বা বৈষম্যের আলোচনায় বারবার উঠে আসে অর্থনৈতিক অসমতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য। তাই আয়ের বৈষম্য কিংবা সম্পদের অসমতা নিয়ে সবাই সোচ্চার।

একইভাবে, ফলাফলের অসমতা নিয়ে যত কথা হয়, সুযোগের বৈষম্য নিয়ে তত কথা হয় না। অসমতা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান অঙ্গনে প্রতিফলিত হতে পারে—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক অঙ্গনে। বৈষম্য ঘটে ঘরে, বাইরে, দেশজ পরিপ্রেক্ষিতে, আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে অসমতা কিংবা বৈষম্য শুধু শুদ্ধ অর্থনৈতিক বিষয়ই নয়, এর একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রিকতাও আছে। আসলে বৈষম্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার লঙ্ঘন, সামাজিক ন্যায্যতার দলন ও অন্যায্য পক্ষপাত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বৈষম্য অত্যন্ত গভীর—সত্যটি অতীত ও নিকট অতীতে বারবারই পরিলক্ষিত হয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক আলোচনা বা বিতর্কের জায়গাটি সরকারি দল কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে দখল করে রাখে ও বিরোধী দলের সব কর্মকাণ্ড নিষ্পেষিত হয়। প্রহসনমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেওয়া হয় না এবং সেই জায়গায় সরকারি দল একচ্ছত্রভাবে বিরাজ করে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা যদি বলি, তাহলে সেখানে যেকোনো রকমের বিকল্প মতকে শায়েস্তা করেছে ক্ষমতাসীন দল। জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা, অন্যান্য পেশাজীবী, সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে।

ভিন্নতর মত, অন্য রকমের দৃষ্টিভঙ্গি, কোনোরকমের সমালোচনাই সহ্য করা হতো না।
দেশের নীতিমালা নির্ধারণে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। সেখানে বিত্ত ও ক্ষমতার পক্ষপাত ছিল সুস্পষ্ট। দরিদ্র, প্রান্তিক গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যাশা এবং চাওয়া-পাওয়া কখনো ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।

নানান সময়ে লোকদেখানো অংশগ্রহণমূলক আলাপ-আলোচনার একটা ভাব তৈরী করা হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো কার্যকর কোনো জন–অংশগ্রহণ ছিল না। নারী জনগোষ্ঠী নানান সময়ে কথা বলেছেন বটে, কিন্তু কখনোই তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

দেশের যে জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক অঙ্গনের কণ্ঠস্বরের ক্ষেত্রে প্রান্তিক সীমায় রেখে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা হচ্ছেন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। তাঁদের আমরা সব সময় দেশের ভবিষ্যৎ করে রেখে দিয়েছি, তাঁদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি। তরুণ সমাজের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আমরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতাকে আমাদের সমাজ বিবর্তন ও সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারিনি। তরুণ-শক্তির এ অপচয় বৈষম্যের এক বিশাল নেতিবাচক ফলাফল।

সামাজিক দিক থেকে ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, আশরাফ-আতরাফের বৈষম্য আমাদের সমাজে আজও বিদ্যমান। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধায় বঞ্চিত। তারা বঞ্চিত সম্পদে, ঋণ সুবিধায়, তথ্যপ্রযুক্তি সেবায়। এ কারণে কর্মনিয়োজন ও আয়ের দিক থেকেও তারা বঞ্চণার শিকার হয়।

পরিবেশ-নাজুক অঞ্চলে যেসব প্রান্তিক মানুষের বাস, তাঁরাও ক্রমবর্ধমান অসমতার শিকার হন। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যকার নিম্নবর্ণের মানুষেরা এবং আশরাফ-আতরাফদের মধ্যে আতরাফেরা সামাজিক বৈষম্যমূলক একটি স্থানে অবস্থান করেন। সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশে নগর ও পল্লির মধ্যকার বৈষম্যের কথা সুবিদিত।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতার প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে? রাজনৈতিক অঙ্গনে মানুষকে একটি জায়গায় বড় সুযোগ দিত হবে, তাঁরা বলবেন কোন কোন অর্থনৈতিক অসমতার প্রতিকার তাঁরা চান। এটা বলার জায়গা ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের থাকতে হবে।

সমাজ অঙ্গনে ধর্মীয় বৈষম্যের কথা বারবার নানান আলোচনায় উঠে এসেছে। নানান সময়ে নানান ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের নিরাপত্তার অভাবের কথা উল্লেখ করেছে, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্যাহত করার অভিযোগও উঠেছে। এসবই বৈষম্যমূলক আচরণ। কারণ, ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিকেরই সমান অধিকার।

সামাজিক অঙ্গনে অসমতা শুধু সামষ্টিক পর্যায়েই বিরাজ করে না, একধরনের বৈষম্য ব্যষ্টিক ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। যেমন পরিবারের মধ্যে নারীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, খাদ্যগ্রহণ, মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আর্থিক স্বাবলম্বনের ক্ষেত্রে একটি লক্ষ্যণীয় বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়। বয়োকনিষ্ঠদের মতামতও পরিবারের মধ্যে উপেক্ষিত হয়। কর্মক্ষেত্রেও ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যে নানান মাত্রিকতার বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়।

সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বহু বৈষম্য লক্ষণীয়। নগর সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্র ও সরকার প্রায়ই যতটা উদ্‌গ্রীব থাকে, গ্রামীণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহ অনেক সময়ে ততটা পরিলক্ষিত হয় না। বহু ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিল্প ও সংস্কৃতিকে মূল ধারায় প্রবিষ্ট করার জন্য একটি অনধিকার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তেমনিভাবে যেসব অঞ্চলে

এসব গোষ্ঠী বসবাস করে থাকে, সেখানকার শিক্ষালয়ে শিক্ষা প্রদান সেসব গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় না হয়ে বাংলা মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এ–ও লক্ষ করা গেছে যে ওই সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য রাষ্ট্রীয় সাহায্য, সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। এসব মিলিয়েই একটি সাংস্কৃতিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে তাঁদের পরিপ্রেক্ষিতে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একটি সমাজকে সমৃদ্ধ ও বেগবান করে।

বাংলাদেশের সমাজে মানসিক বৈষম্যের কথাও বহুজন বলেছেন। আমাদের সমাজে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধীগোষ্ঠীকে হীন বলে মনে করা হয় এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। তাদের অবস্থাকে আমরা সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দিয়ে দেখি না, তাদের বিষয়গুলো আমরা সঠিকভাবে বিবেচনা করি না।

তেমনিভাবে মানুষের প্রতি আচরণে আমরা বৈষম্যমূলক আচরণ করি। আমরা বহু সময়ে মানুষের ন্যূনতম সম্মানটুকু মানুষকে দিই না, যদি সেই মানুষটি হয় দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ। এটাও মানসিক বৈষম্যের একটি মাত্রিকতা।

একটি সমাজের অর্থনৈতিক অসমতাও শুধু একটি শুদ্ধ অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, অসমতা সমাজের ক্ষমতা-সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আসলে, সমাজের অর্থনৈতিক অসমতা এবং ক্ষমতা-সম্পর্ক পরস্পর পরস্পরকে জোরালো করে। অর্থনৈতিক সম্পদের ভিন্নতা সমাজে ধনী এবং দরিদ্র্য এ প্রান্তিক মানুষের এই অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক বিত্তবান ও ক্ষমতাশীল মানুষদের আরও বিত্ত গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

এই প্রক্রিয়ায় পুরো ব্যাপারটিই রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ী একটি স্থান করে নেয়, যার ফলে রাষ্ট্র নিজেই একটি স্বার্থান্বেষী মহলে পরিণত হয়। এর ফলে, দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠী আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারা রাজনৈতিক বলয়ে, সামাজিক গতিময়তায় এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় আরও বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়ে। এমনকি আইনের চোখেও তারা সুবিচার পায় না।

সুতরাং এ অবস্থায় মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায্যতা বিষয়টি শুধু কথার কথায় পর্যবসিত হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতা নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন অসমতা মানবাধিকার ও মানব–মর্যাদার পরিপন্থী।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতার প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে? রাজনৈতিক অঙ্গনে মানুষকে একটি জায়গায় বড় সুযোগ দিত হবে, তাঁরা বলবেন কোন কোন অর্থনৈতিক অসমতার প্রতিকার তাঁরা চান। এটা বলার জায়গা ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের থাকতে হবে। আসলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শুধু যে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে তা–ই নয়, সেই সঙ্গে অসমতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণকেও তাঁরা প্রভাবিত করতে পারবে।

যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক সেবার বলয়ে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর যে শুধু এসব সেবার প্রসারণ ঘটাবে তা–ই নয়, সেই সঙ্গে এসব সেবা সুযোগের গুণগত মান যে ভালো হয়, তা নিশ্চিত করা যাবে। ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরাও উন্নতমানের সামাজিক সুযোগ পাবেন।

বৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হলে, সেটার একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিপ্রেক্ষিত থাকতে হবে, সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের একটা দায়িত্ব থাকা প্রয়োজন। আমাদের চেতনায় এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে, আমাদের আচার-আচরণে, আমাদের কর্মকাণ্ডে আমরা প্রত্যেকে যদি সমতার প্রতি শ্রদ্ধাবান হই, তাহলে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে সেটা একটি বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করবে। সেই সঙ্গে যুক্ত হতে হবে সমাজের কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্রের কার্যক্রমে।

সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আপনার আচরণ এমন হবে ভাবিনি: জামিলকে নূনা আফরোজ
  • সরকার জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মর্মবস্তু ধারণ করতে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে
  • ‘মাফিয়া বসদের মতো’ আচরণ করেছেন ট্রাম্প
  • ক্ষমতা অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • ক্ষমতার অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • রিয়াল মাদ্রিদকে বড় অঙ্কের জরিমানা উয়েফার
  • গার্দিওলার সঙ্গে সমর্থকদের বাজে আচরণে জরিমানা রিয়ালের
  • তরুণদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি