সামাজিক নিরাপত্তা স্বাস্থ্য শিক্ষা কৃষি পরিবেশে বড় ধাক্কা
Published: 27th, January 2025 GMT
স্বাধীনতার পর থেকে সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) থেকে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে বন্ধ করে দিয়েছেন সব অনুদান। এতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, জ্বালানি, জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ সামাজিক খাতে চলমান সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম স্থগিত করেছে ইউএসএআইডি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে গত বছর থেকে এক প্রকার চাপে দেশের মানুষ। গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্থনীতির ক্ষতগুলো ফুটে উঠতে শুরু করে, যা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এর মধ্যে ইউএসএআইডির কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতে বড় চাপে পড়তে পারে দেশ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী সব অংশীজনকে সব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ অথবা স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে ইউএসএআইডি। গত শনিবার পাঠানো চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। চিঠিতে অংশীদারদের ইউএসএআইডির অধীন সব চুক্তি, কার্যাদেশ, মঞ্জুরি, সহযোগিতামূলক চুক্তি কিংবা অন্য প্রকল্পের সব ধরনের কাজ বন্ধ, জব্দ বা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে অংশীদারদের তাদের জন্য বরাদ্দ খরচ কমাতে সব যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশ (উল্লিখিত নির্দেশনা বাতিল করার) লিখিত আকারে না পাওয়া পর্যন্ত অংশীজনকে কাজ আবার শুরু না করতে বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বজায় রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। এমন নির্দেশনার পর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এতে হুমকিতে পড়তে পারে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ খাতসহ সার্বিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। মার্কিন তহবিলপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্পের অংশীদার বাংলাদেশ। এর মধ্যে মার্কিন অনুদানপ্রাপ্ত অনেক এনজিও এবং সরকারি সংস্থা রয়েছে। তারা এ আদেশের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনিশ্চয়তায় পড়েছে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। এতে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্য খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ইউএসএআইডি সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করেছে। পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ইউএসএআইডির অর্থায়নে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। হঠাৎ করে কার্যক্রম স্থগিত করায় কর্মসূচিগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমদ এহসানুর রহমান সমকালকে বলেন, যক্ষ্মার সমস্যা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। গত এপ্রিলে বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য, ওয়ান হেলথ প্রকল্প চালু করেছিল ইউএসএআইডি। এ প্রকল্পের অধীনে পাঁচ বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্থাটির। এ ছাড়া স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ জরিপগুলো বাস্তবায়নে অর্থায়ন করে থাকে এই সংস্থা। চলমান এসব প্রকল্পের কার্যক্রম এখন বন্ধ থাকবে। সরকারি প্রকল্পগুলো সচল রাখতে না পারলে স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে ইউএসএআইডি এই ধরনের অর্থায়ন করে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ইউএসএআইডি কার্যক্রম বন্ধে নানা দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। যেমন– তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও সুরক্ষা এবং উন্নয়নে ৯০ শতাংশ প্রকল্প ইউএসএআইডির। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া শিক্ষায় অনেক প্রকল্প চলমান।
ইউএসএআইডি গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ২২ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা দেওয়ার চুক্তি করে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১-২০২৬ সালের জন্য বাংলাদেশ ও ইউএসএআইডির মধ্যে একটি নতুন ডিওএজি (ডেভেলপমেন্ট অবজেক্টিভ গ্রান্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) সই হয়। এর মাধ্যমে ইউএসএআইডি ৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পঞ্চম সংশোধনী পর্যন্ত ইউএসএআইডি সাড়ে ৪২ কোটি ডলার দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে সই হওয়া ‘অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত ও সম্পর্কিত সহায়তা’ চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন খাতে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি তহবিল দিয়েছে।
‘ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ডট গভ’ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে ২০২১ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালের ৪৯০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে ওয়াশিংটন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে মার্কিন সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০-এ ছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ইউএসএআইডির মাধ্যমে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সম্প্রসারণ ঘটানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নত করেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চা বেড়েছে। পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহিষ্ণুতা বাড়িয়েছে। নতুন এই আদেশের কারণে বাংলাদেশে এসব কর্মকাণ্ডে ধাক্কা লাগতে পারে।
দেশের স্বাস্থ্য খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর প্রভাবে মা ও শিশুমৃত্যুর উচ্চহার, ব্যাপক অপুষ্টি, যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব (টিবি) এবং ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সংস্থা বছরের পর বছর ধরে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রম, অপুষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিরোধসহ যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া সংস্থাটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সহজীকরণ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী অর্জনে অবদান রাখতে সহায়তা করেছে। দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত ওষুধ শিল্পের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশে অপুষ্টির মাত্রা বাড়ানো, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব এবং লাখ লাখ দুর্বল ব্যক্তিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিতেও (এসএমসি)। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বাস্থ্যপণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে পেত।
এইচআইভি/এইডসবিরোধী কর্মসূচি পিইপিএফএআরের অধীনে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে চালু হওয়া এ কর্মসূচি প্রায় ২৬ মিলিয়ন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য খাতে যে সহায়তা দেওয়া হতো, বাংলাদেশে তাও বন্ধ হতে পারে। এনজিওগুলোর উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউএসএআইডি বড় সহায়তা দিচ্ছে। এখন শত শত সংস্থার কর্মসূচি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ-আমেরিকা মৈত্রী প্রকল্পের পক্ষ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করা ১৮টি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) ২০২৪ অর্থবছরের জন্য অনুদান দিয়েছে ইউএসএআইডি। ব্র্যাক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অনুদানপ্রাপ্ত স্থানীয় এনজিওগুলো কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু অধিকার ও সুরক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ করছে। ইউএসএআইডির কার্যক্রম স্থগিতের কারণে এ রকম বহু কর্মসূচি হুমকির মুখে।
বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, প্রাণী, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করতে উন্নত গবেষণা কার্যক্রম ও উন্নত প্রযুক্তির বিষয়ে সহযোগিতা করছে ইউএসএআইডি। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা রূপান্তরে চালু থাকা প্রকল্পগুলো অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।
এ নিয়ে সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক সাকিব আলী বলেন, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সাময়িক, তিন মাসের জন্য। আসলে তাদের দেওয়া অর্থ বিভিন্ন দেশে সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কিনা এবং যৌক্তিক কিনা, তা মার্কিন নাগরিকদের দেখাতে চান।
তবে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তহবিল সংকট হতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো.
তবে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর গতকাল রোববার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) অর্থ সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বজায় রাখবে।
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশনের (বিএনএনআরসি) প্রধান নির্বাহী এ এইচ এম বজলুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন অংশীদার। এই তিন মাস বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহায়তা যাচাই করবে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর বোঝা যাবে কোন দেশে তার উন্নয়ন সহায়তা কতটুকু থাকবে, কতটুকু বাদ যাবে। আর তা থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি স্পষ্ট হবে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ইউএসএআইডির স্থগিতাদেশ সাময়িক। এই নির্দেশনা সারা পৃথিবীর জন্য। আমরা নির্দেশনার পর আজ (রোববার) বৈঠক করেছি। ইউএসএআইডি কৃষিতে কিছু প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে। বেশির ভাগ কারিগরি সহায়তা। কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করছি। আপাতত চূড়ান্ত নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নেব।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব শ প রকল প র দ র জন য ব যবস থ পর ব শ সহয গ এনজ ও বছর র সরক র ধরন র চলম ন
এছাড়াও পড়ুন:
পোস্ট-ট্রুথ দুনিয়া: কী দেখছেন আর কী বিশ্বাস করছেন?
সেদিন একজনের সঙ্গে আলাপ চলছিল। ধার্মিক মানুষ তিনি। ট্রাম্প প্রসঙ্গে এ–কথা সে–কথায় হঠাৎ বললেন, দেখেন, গাজায় ইউএসএআইডির মাধ্যমে ৫০ মিলিয়ন ডলারের কনডম পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের জন্মনিয়ন্ত্রণ। তারা যাতে সংখ্যায় না বাড়ে, যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
তাঁর সঙ্গে আরও দু–একজন যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও তাল মেলালেন। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এটি ভুল পাঠ। তিনি প্রমাণ দেখালেন হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিত উন্মুক্ত ব্রিফিংয়ে বলেছেন ৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের কনডম পাঠানোর কথা।
বললাম, জানি, এবং নিজেও ব্রিফিং দেখেছি। ৫০ মিলিয়ন ডলার অঙ্কটিই মিথ্যা। তাঁরাও মিথ্যা বলেন। পেছনের উদ্দেশ্য পরে বলব, বুঝবেন। আমার হাতেও প্রমাণ আছে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে এই খাতে এক ডলার দেওয়া হয়নি। ২০২৩ সালে মাত্র ৪৬ হাজার ডলার বরাদ্দ ছিল। তা–ও জর্ডান এবং পশ্চিম তীরের অগণিত অসংখ্য মানুষ, বিশেষত চালচুলোহীন শরণার্থীদের জন্য। সেগুলো কনডমও নয়, জন্মনিয়ন্ত্রণের ইনজেকশন এবং প্রোজেস্টিন-নির্ভর বড়ি। খুবই দরকারি ছিল মা ও শিশুর জীবন রক্ষার জন্য।
একদিকে অসুস্থ অপুষ্ট মায়েদের সন্তান ধারণে জীবনাশঙ্কা; অন্যদিকে আরও অপুষ্ট, অসুস্থ, বিকলাঙ্গ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা। ফলাফল, বিভীষিকাময় জীবন-যন্ত্রণা। সন্তানদের সুস্থ-সুন্দর, মানবিক ও স্বাভাবিক জীবন দিতে না পারা। আগে কনডম দেওয়া হতো এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়াসহ নানা রকম চর্ম ও যৌনব্যাধির মহামারি রোধ করার জন্য। এই সময়ে এসে এইডসবিরোধী জনসচেতনতা বেড়েছে। ওষুধ-চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েছে। ফলে মহামারির প্রকোপ কমেছে। তাই কনডম বিতরণের দরকারটিও কমেছে।
যাঁদের বুঝিয়ে বলছিলাম, তাঁরা বুঝতে চাইছেন মনে হলো না। উল্টো নমনীয় ভাষায় ইঙ্গিত করলেন আমি সম্ভবত এনজিওপন্থী বা ইউএসএআইডির সুবিধাভোগী বলে এসব কথাবার্তা বলছি। জানালাম শিক্ষকতার বাইরে আমি অন্য কিছুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টও নই, সত্য বলতে দ্বিধান্বিতও নই।
হঠাৎই মনে হলো ইউটিউবে কোনো একজন ইসলামি বক্তার ওয়াজেও এ ধরনের অদ্ভুত জনমিতি-জ্ঞানবহির্ভূত ধারণা প্রচার দেখেছিলাম। সেই সময়ও ভাবছিলাম, আমাদের হাতে হাতে মুঠোফোনে-ট্যাবে তথ্যের মহাসমুদ্রে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। কিন্তু তথ্যকে কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়, কজনই–বা জানি! আম-মার্কিনদের এক বড় অংশও জানে না। আলাপি ভদ্রলোকের আদলে তারাও বিশ্বাস করে, তৃতীয় বিশ্ব টিকেই আছে মার্কিন দান-খয়রাতের কারণে।
সত্য-উত্তর যুগ বা পোস্ট-ট্রুথ দুনিয়ার ছল বোঝা আসলেই দরকার। একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব সাংবাদিকদের মতো খোঁচাখুঁচিপ্রবণ মানুষদের সামনে বসিয়ে চোখে চোখ রেখে নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলতে পারছেন কেন? কারণ, নির্জলা মিথ্যাকে বিশ্বাস করার মতো সহজ–সরল মানুষের সংখ্যা চিরকালই অগণিত। তাঁরা আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। তারা বিশ্বাসও করবে, সম্মতিও উৎপাদন করবে এভাবে—না, না, আমাদের কষ্টের টাকায় ট্যাক্স দিই, সেই টাকা অন্য দেশে অকাজে খরচ করা যাবে না।
ট্রাম্পের ঘোষণায় বিদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সাহায্য–সহযোগিতা বন্ধ হয়ে গেছে। ইউএসএআইডিতে আতঙ্ক আর আতঙ্ক। ট্রাম্পের অন্যতম অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক ইলন মাস্ক বলেই বসেছেন, সংস্থাটি অপরাধী সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় হয়েছে এটি বন্ধ করে দেওয়ার।
আসলে খলের ছলের অভাব হয় না। ঈশপের গল্পের নেকড়ের ছুঁতো খোঁজার মতো একটি বড়সড় ছুঁতো দরকার ছিল। আগে ইউএসএআইডি যেভাবে ও যত রকম উপায়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার কাজে লাগত, এখন সেসব উপায়ের সব বিকল্প মিলে গেছে। ফলে সংস্থাটি না থাকলেও কিছু মার্কিন স্বার্থের কিছু যাবে আসবে না।
ইউএসএআইডির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাই ছিল তৃতীয় বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় উন্নয়ন-সহায়তার মাধ্যম। কেন যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন ডলার খরচ করত অন্যের দেশের উন্নয়নে? একেবারেই নিঃস্বার্থভাবে দান-দক্ষিণার মাধ্যমে সওয়াব কামানোর জন্য? উত্তর ‘না’। তৃতীয় বিশ্বে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানোর জন্য? উত্তর, মোটেই না। আসলে এটা ছিল একধরনের ‘উইন-উইন’ বন্দোবস্ত। দুই পক্ষেরই যাতে লাভ হয়, সে রকম ব্যবস্থা। ব্যয় বরাদ্দের বড় অংশই আবার স্বদেশে ফেরত যেত মার্কিন কর্মকর্তা-কর্মচারী-পরামর্শকদের বেতন–ভাতা আকারে। মার্কিন নাগরিকদের কর্মসংস্থান হতো।
ইউএসএআইডির কার্যক্রমের কারণে সহায়তা পাওয়া দেশগুলোর সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পররাষ্ট্রনীতি—এককথায় সবকিছুই যুক্তরাষ্ট্রবান্ধব ও মুখাপেক্ষী হয়ে উঠত। গরিব দেশগুলোও সমানভাবে লাভবান হতো। দূরদূরান্তরে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সক্ষমতার অভাবটুকু ঘুচে যেতে মার্কিন উন্নয়ন-সহযোগিতার মাধ্যমে।
আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লাভ কী ছিল? লাভ অসংখ্য। এই স্বল্প পরিসরে শুধু মুখ্য এক-দুটি বিষয় আলাপ সম্ভব। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বই পর্যন্ত বিশ্বময় রাজনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধে মোকাবিলা। পঞ্চাশের দশক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়ছিল নানা দেশ। দেশগুলো যাতে সমাজতান্ত্রিক বলয়ে ঢুকে পড়তে না পারে, সে জন্য সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল প্রথম উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহায়তাই ছিল সেরা মারণাস্ত্র।
নব্বইয়ে সমাজতন্ত্রের পতনের পর দরকারটি মিইয়ে গেল। কিন্তু হুট করেই সাহায্য–সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া যাচ্ছিল না অনেক কারণে। বাজারে নব্য-উদার তত্ত্ব ছাড়া হলো ‘উন্মুক্ত বাজার’ অর্থনীতির। ‘প্রতিযোগিতায় আসো, নিজের পায়ে দাঁড়াও, নিজ সক্ষমতা বাড়াও, বাজার খুলে দাও’ তত্ত্ব। এদিকে আরও কয়েক বছর বা দশক অপেক্ষা করে দেখা দরকার ছিল সমাজতন্ত্রী ভাবধারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কি না। আস্তে আস্তে নিশ্চিত হওয়া গেল সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। চীনও নামেই সমাজতন্ত্রী, আদতে বাজার-অর্থনীতিমুখো।
তবু ইতিমধ্যে অসংখ্য দেশের সঙ্গে কয়েক দশকের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ও উন্নয়ন-সহযোগিতার সম্পর্ক ডালপালা শিকড় ছড়িয়ে এতটাই শক্তপোক্ত হয়েছে যে চাইলেই হুট করে পিঠ দেখিয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। হুটহাট উন্নয়ন-সহায়তা তুলে নিলে অবন্ধুসুলভ, অকূটনৈতিক এবং অভব্য অশোভন আচরণের মতোও দেখাত। তা ছাড়া অর্থনীতিতে চমক জাগানো দৌড়ে ছুটে চলছিল জাপান ও চীন। তারা নতুন ধরনের উন্নয়ন-সহযোগিতা দিতে উদার হাতে এগিয়ে আসছিল। কয়েক দশক পর এখন যেহেতু নিশ্চিত হওয়াই গেছে সমাজতন্ত্রও আর হুমকি নয়, চীন-জাপানের উন্নয়ন-সহযোগিতাও সমস্যা নয়, উন্নয়ন-সহায়তা বন্ধ করাই যেতে পারে।
আসলে তার চেয়েও বড় একটি উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের তথ্যভান্ডারের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’ ধরনের অবস্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। প্রয়োজন ছিল সারা বিশ্বের গ্রামগঞ্জের মানুষ, তাদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, শক্তি ও সামর্থ্যের ধরন, দুর্বলতা ও পশ্চাৎপদতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণী তথ্য জেনে ও সংরক্ষণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ রাখা। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকালে এবং আগে-পরে নানা রকম গবেষণা, প্রশিক্ষণ, নিয়মিত মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণযজ্ঞ চলত। প্রতিবেদন হতো। প্রতিবেদনগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের আনাচ-কানাচ বিষয়ক তথ্যের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য দিত।
তথ্য যার, ক্ষমতাও তার। মার্কিন পররাষ্ট্রবিষয়ক সিদ্ধান্ত ও নীতি নির্ধারণেও কাজে লাগত প্রতিবেদনগুলো। তাই উন্নয়ন সহায়তার নামে সশরীর জ্ঞানার্জনের পদ্ধতিটি সেকেলে ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। জিপিএস, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, এআই ইত্যাদি প্রযুক্তির ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যে বলীয়ান মার্কিন প্রশাসনের জন্য তথ্য পেতে এখন কি-বোর্ডের কয়েকটি খোঁচাই যথেষ্ট। সরাসরি লোকবল অর্থবল বিনিয়োগই বরং অপচয়।
আমার সঙ্গে বাহাসে নামা দুজন যেমন এই সুগভীর প্রেক্ষাপটটি বুঝতে চাননি, আম-মার্কিনরাও তেমনি বুঝতে চায় না। সত্য-উত্তরকালের ভয়াবহ বিপদটি এখানেই। তথ্যসমুদ্রে ছুড়ে দিয়ে যে কাউকেই দিকহারা করে দেওয়া যায়। এভাবেই মার্কিনদের বড় অংশকেও সহজেই বিশ্বাস করানো গেছে এত দিন উন্নয়নশীল দুনিয়া টিকে ছিলে তাদের করের টাকায়।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়