জমির সংকটের দেশে বিশেষ কোটায় প্লট!
Published: 26th, January 2025 GMT
সংরক্ষিত কোটার অপব্যবহার করে রাজউকের প্লট বরাদ্দের ঘটনা নতুন নয়। তবে বিগত সরকারের আমলে তা সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এতেও সন্দেহ নেই। হাসিনা সরকার পতনের পর রাজউকের তিনটি প্রকল্পে অনিয়ম করে প্লট বরাদ্দের ঘটনাগুলো থেকেই সামনে আসছে। হালে একটি সহযোগী দৈনিকে প্রতিবেদন আসার আগেও জানা গিয়েছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারভুক্তরা নিয়েছেন ১০ কাঠার ছয়টি প্লট। তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এটা করা হয় বলে মামলাও হয়েছে। নিতান্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বিতরণেও তারা ছিলেন ‘উদারহস্ত’। মন্ত্রী-এমপি থেকে নিয়ে পেশাজীবীদের মধ্যে গত সাড়ে ১৫ বছরে এভাবে প্লট বরাদ্দের কিছু ঘটনা আগেও সামনে আসে এবং সমালোচিত হয়। তারপরও এ ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মেনে চলার কোনো প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়নি। হাসিনা সরকার পতনের পর এসব খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট একটি কমিটি করে দিয়েছেন। এতে আশা করা যায়, এর একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমরা পাব।
রাজউকের সিংহভাগ প্লট অবশ্য বরাদ্দ হয় লটারির মাধ্যমে। প্লটের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি থাকায় এ পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে দীর্ঘদিন। লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ নিয়েও অভিযোগ কম নেই। তবে কোটায় প্লট বরাদ্দ নিয়েই সমালোচনা বেশি। এ ধরনের কোটা থাকলে এবং সরকারের প্রধান নির্বাহীর এ ক্ষেত্রে একক নির্ধারক ভূমিকা থাকলে ক্ষমতাটির অপব্যবহার হবেই– এমন মত রয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিকভাবে অনুগত ব্যক্তি, এমনকি তাঁর পোষ্যদের মাঝে বেপরোয়াভাবে প্লট বরাদ্দের যেসব খবর মিলছে, তাতে ওই মত জোরদার হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত বিধিমালার বিশেষ ধারাটি বাতিল করেছে। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা হালে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখন থেকে কেবল লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ করা হবে।
এ দেশে মানুষের তুলনায় জমি অনেক বেশি রয়েছে, তা কিন্তু নয়। ঘটনা বরং উল্টো। যেসব জরুরি কাজে জমি ব্যবহৃত হয়, সেগুলো সম্পাদনে টানাটানি চলছে বরং। কৃষিজমি চলে যাচ্ছে আবাসন, শিল্প; এমনকি ছোট-বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও উপকূলীয় জমি হারাচ্ছি আমরা। নদীভাঙনেও মানুষ হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। তাদের ন্যূনতম থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বরং নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত। এতে মনোনিবেশের বদলে নগর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের নামে কাদের কল্যাণে সরকার বেশি নিয়োজিত, সে প্রশ্নও এ প্রসঙ্গে উঠতে পারে।
রাজউক বা এ ধরনের সংস্থা অবশ্য পরাধীনকাল থেকেই সক্রিয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও তার ভূমিকা কী হওয়া উচিত– সে প্রশ্ন উঠতে পারে। রাজধানীর আশপাশ থেকে কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন করে এক শ্রেণির হাতে তুলে দেওয়ার ভেতর দিয়ে কী লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে– উঠতে পারে সে প্রশ্নও। নামমাত্র দামে অধিগ্রহণের নামে যাদের কার্যত উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্লট বরাদ্দে সংস্থাটির অনীহার কথাও কিন্তু কম জানা যায় না। উত্তরোত্তর বেশি আগ্রহ বরং দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাবান ও সম্পদশালীদের মধ্যে প্লট বরাদ্দে। রাজনৈতিকভাবে অনুগতদের দ্রুত বিত্তশালীতে পরিণত করতেও এ অস্ত্র বেশি করে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয় জীবনে তাদের ‘অসামান্য অবদান’-এর নামেই আবার করা হচ্ছে এটা, যা কার্যত ভয়াবহ অনাচার।
রাজউকের প্লট বরাদ্দের বিধিমালায় বিশেষত সংরক্ষিত কোটায় সময়ে সময়ে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তাতে খারাপ উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট। নব্বইয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পরও একেকটি সরকার পাল্লা দিয়ে নিজেদের ‘পল্লি’ গড়ে তুলেছে রাজধানীর প্রান্তে। এ নিয়ে তখনও কম প্রতিবেদন হয়নি। সমালোচনা তীব্র হয়ে উঠলে এ ধরনের প্লট বরাদ্দে কিছু সংশোধনী আনা হলেও প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। এ ধারাতেই অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো প্লট বরাদ্দেও বিগত সরকার ছাড়িয়ে গেছে সব সীমা। শর্ত ভঙ্গসহ জালিয়াতির প্রবণতাও তীব্র হয়ে উঠেছে বিশেষ কোটায় প্লট বরাদ্দে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীতে বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট থাকা সত্ত্বেও প্লট পাওয়া; একই পরিবারভুক্ত একাধিক ব্যক্তির নামে প্লট বরাদ্দ; একই ব্যক্তির নামে একাধিক প্লট ইত্যাদি।
মন্ত্রী-এমপি, দলীয় নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীসহ যাদের নামে প্লট বরাদ্দ হয়েছে, তাদের সিংহভাগ আবার সম্পদশালী। তারা আরও পাওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি। সরকার তাদের ‘পুরস্কৃত’ করতে আরও ব্যগ্র। জনগণের অর্থসম্পদ লুটের এ আরেক প্রক্রিয়া, যা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারও দূরে থাকতে পারেনি।
বিগত তিনটি ভুয়া নির্বাচনের আগে-পরেও বিশেষ কোটায় রাজউকের প্লট বরাদ্দে কিছু প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনা ঘটে। এতে মূলত সচিব পর্যায়ের লোকদের তুষ্ট করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষের মাঝে তাদের ‘অসামান্য অবদান’-এর কথা বলে প্লট বরাদ্দের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার। রাষ্ট্রে আনুগত্য ও তোষামোদির সংস্কৃতি বিস্তারে এ ধরনের পদক্ষেপের প্রভাব এখন স্বভাবতই বেশি করে আলোচিত হচ্ছে। এটাও লক্ষ্য করব, শুধু প্লট বরাদ্দে নয়; একই গোষ্ঠী মনোনয়ন, পদোন্নতি, ব্যবসা, ঋণ ও করের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা লাভ করেছে। সে জন্য এ প্রশ্নটি বেশি করে আলোচিত হচ্ছে– প্লটসহ কোনো ক্ষেত্রেই ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রদানের সুযোগ রাখা সংগত কিনা। বিগত শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিম্নপদস্থ লোকজনও রাজউকের প্লট পেয়েছে এ বোধগম্য কারণেই। এদের কতজনের প্লট এখন সরকার ক্ষমতাবলে ফিরিয়ে নিতে পারবে– সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। শর্ত বা নিয়মনীতি ভঙ্গের স্পষ্ট প্রমাণ না মিললে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কঠিন। অনিয়ম করে পাওয়া প্লট দ্রুত বেচে দিয়ে সে অর্থ অন্য কাজেও ব্যবহার করে ফেলেছে অনেকে। তা উদ্ধার হবে কীভাবে?
রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে এক শ্রেণির মানুষের ‘অসামান্য অবদান’ থাকে বৈকি। তার যথাযথ মূল্যায়ন আর স্বীকৃতিও প্রয়োজন। সে জন্য কাউকে এক খণ্ড জমিই উপহারস্বরূপ দিতে হবে– এমন কোনো কথা নেই। সে জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে কার কাছ থেকে? জমি অধিগ্রহণের এমন ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করতেও নয়। বহু মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যই আসলে দেওয়া হয়েছে এ ক্ষমতা। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় অর্থে রাজউকের গোটা ‘প্লট বাণিজ্য’ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। এত দিন ধরে চললেও এটা এখন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন নয় কি? এর বদলে প্রতিষ্ঠানটি বরং হয়ে উঠতে পারে পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার কাজে বিধিবদ্ধ নজরদারি প্রতিষ্ঠান। আবাসন ব্যবসা করুক বেসরকারি খাত আর তাতে থাকুক রাজউকের দক্ষ নজরদারি। এ ধরনের সংস্কারের দাবি জোরদার হোক সামনে; নির্বাচিত সরকারের আমলে। অন্তত তারা আর ফিরিয়ে না আনুক রাজউকের প্লট বরাদ্দে ‘সংরক্ষিত কোটা’। লটারিতে বরাদ্দের ব্যবস্থা থাকলেও এ ক্ষেত্রে অধিগ্রহণ ও জমির দাম নির্ধারণে বাজারের চলতি দর হোক ভালোভাবে বিবেচিত। জমির সংকটের দেশে প্লটের বদলে ফ্ল্যাট বানিয়ে বরাদ্দ করাও হতে পারে গ্রহণযোগ্য বিকল্প।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র এ ধরন র মন ত র ব যবস ক ষমত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সামারিক শক্তিতে মিয়ানমারের চেয়ে ২ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ
চলতি বছর সামরিক শক্তির দিক থেকে মিয়ানমারের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি সপ্তাহে সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার প্রকাশিত সূচকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক বাজেট। সেনাবাহিনীর আকার, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর শক্তিকেও বিবেচনা করা হয়েছে সমীক্ষায়।
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এরপরে পরে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। পরমাণু শক্তিধর হলেও পাকিস্তানের অবস্থান ১২ নম্বরে। তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৩৫তম অবস্থানে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে উত্তর কোরিয়া ও আর্জেন্টিনা। আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৬ কোটি ৬১ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে মোট সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৭ হাজার ৪০০ সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ২৫ হাজার ১০০ সেনা।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ৭৫ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। মিয়ানমারের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। মিয়ানমারের রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে ২০ হাজার। দেশটির বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৫ হাজার সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ১৬ হাজার সেনা।
ঢাকা/শাহেদ