রক্তাক্ত সীমান্ত পেরিয়ে কি বন্ধুত্ব হয়?
Published: 26th, January 2025 GMT
বাংলাদেশের সব সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দাবি করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এটি এক ধরনের দাবি হলেও জনগণের কাছে এটি ছিল প্রত্যাশা। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চেয়ে এসেছি।
ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী। আমাদের মানচিত্রের তিন দিক ঘিরেই ভারত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবদান কখনোই আমারা অস্বীকার করি না। কিন্তু শুধু মধুর অতীত নিয়ে কোনো সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে না। যে কোনো সম্পর্কে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করতে হয়। সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে হলে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। অথচ গত ৫৩ বছরে ভারতের দিক থেকে দেখা গেছে এর বিপরীত চিত্র।
স্বাধীনতার পাঁচ বছর পরেই পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে মওলানা ভাসানীকে লংমার্চ করতে হয়েছিল। আজও অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে আমরা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারিনি। তিস্তা নিয়ে কথা হচ্ছে বহু বছর। শুষ্ক মৌসুমে পানি না পাওয়া, ভরা মৌসুমে বানের পানি ছেড়ে দেওয়া যেন সাধারণ বাস্তবতা। এ ছাড়া ভারসাম্যহীন বাণিজ্য চুক্তি দুই দেশের ঐতিহাসিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দাবিকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
দুই দেশের সম্পর্কের পারদ যতে উষ্ণ বা শীতলই থাকুক; সীমান্তে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মাঝে বিরাজ করছে শীতলতম সম্পর্ক। এর মধ্যে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাস্তবত হচ্ছে, গত ১৬ বছরে দুই সরকারপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক উচ্চতায় পৌঁছালেও দুই দেশের জনগণের মাঝে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়নি, বরং তা তলানিতে ঠেকেছে। তিন তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ ও অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের সুযোগ নিয়েছে। এর ফলে ধীরে ধীরে ভারত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র থেকে বড় দাদাসুলভ এক প্রতিবেশীতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি তারই অংশ। অবশ্য বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি কখনোই খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। প্রতিবছর এখানে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।
অথচ সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশে প্রায়শ তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত পতাকা বৈঠকও হয়। একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বারবার। কিন্তু সীমান্তে হত্যা বন্ধ হচ্ছে না, বরং উত্তেজনা বাড়ছেই।
এদিকে এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচারও হয় না। এজন্য বিএসএফকে জবাবদিহির আওতায় আনা যায়নি। ফলে হত্যাকাণ্ড আরও বাড়ছে। সীমান্তে এত হত্যাকাণ্ডের নজির বিশ্বে বিরল। সীমান্তে এভাবে নিরীহ বেসামরিক লোকদের হত্যা করা নিশ্চিতভাবেই ফৌজদারি অপরাধ। ভারতের ফৌজদারি আইন তো বটেই, আন্তর্জাতিক আইনেও এগুলো অপরাধ। কেউ সীমান্ত লঙ্ঘন করলে তাকে গ্রেপ্তার বা পুশব্যাকের সুযোগ আছে। কিন্তু নিরীহ মানুষকে এভাবে সরাসরি গুলি করে হত্যার নজির বিশ্বের কোথাও নেই।
সীমান্তে বিএসএফের বর্বরতার নজির হয়ে আছে ফেলানী। ওই কিশোরীকে হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৪ বছর হয়ে গেল; আজও বাংলাদেশ ফেলানী হত্যার বিচার পায়নি। ফেলানী হত্যার জন্য দায়ী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের বিচার তো ভারত করেইনি, উপরন্ত তাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। বিষয়টি পরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। যদিও সেখানে ফেলানীর মামলার শুনানি অজ্ঞাত কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।
বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়; দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২২-২৩ সালে এ দু্ই দেশের মধ্যে প্রায় ১৫.
বিদ্যমান সীমান্ত হত্যার সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে ভারত কর্তৃক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ। বিজিবি সব জায়গায় এর প্রতিবাদ করেছে। এর ফলে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ স্থগিত রেখেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বলেছেন, ভারত বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ীই বেড়া নির্মাণ করছে। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী নো ম্যানস ল্যান্ডের ১৫০ গজের ভেতরে কোনো পক্ষই স্থায়ী কোনো স্থাপনা বা বেড়া নির্মাণ করতে পারবে না। তাহলে প্রশ্ন, বিগত সরকার ভারতের সঙ্গে কী চুক্তি করেছে? বাংলাদেশ কি ভারতকে ১৫০ গজের মধ্যে বেড়া নির্মাণের জন্য সম্মতি দিয়েছে? যদি তা-ই হয়, তবে বর্তমান সরকারকে এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে।
আমরা ভারতের সঙ্গে অবশ্যই সুসম্পর্ক চাই। পারস্পরিক স্বার্থকে উপেক্ষা করে কোনো সুসম্পর্কই টেকসই হতে পারে না। কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ‘কোনো একক রাজনৈতিক দল’ বা একটি সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ‘বাংলাদেশের জনগণ’-এর সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় ভারত। আমরাও সেটা বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু রক্তাক্ত সীমান্ত পার হয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কীভাবে হতে পারে?
শুধু সীমান্তে শান্তি নয়; বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তথা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও উন্নয়নের জন্যই ভারতকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাম্য ও সমতা দুটোই দরকার। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও এর বিকল্প নেই।
এরশাদুল আলম প্রিন্স: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ নিয়ে অমর্ত্য সেনের বক্তব্য নিয়ে যা বলছেন জামায়াতের আমির
ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। আজ সোমবার নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই প্রতিক্রিয়া জানান তিনি।
ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইকে একটি সাক্ষাৎকার দেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। গতকাল রোববার ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। এতে তিনি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের চ্যালেঞ্জ, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়সহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন।
নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া ওই পোস্টে জামায়াতের আমির বলেন, ‘ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অনাকাঙ্ক্ষিত নাক গলানোর মতো কথা বলেছেন। জানি না তাঁর বিবেক কোথায়? বাংলাদেশকে সহনশীলতার সবক দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি যে দেশে এবং সমাজে বসবাস করেন, সেই সমাজের আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করুন।’
শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জনগণ টানা সাড়ে ১৫ বছর সেক্যুলারিজমের (ধর্মনিরপেক্ষতা) নামে চরম ভন্ডামি প্রত্যক্ষ করেছে। তিনি পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে খোলামেলা ওকালতি করছেন, যা বিস্ময়কর, অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয়।
পোস্টে জামায়াতের আমির বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে যা বলেছেন, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা থেকে বলতে চেয়েছেন। বাস্তবতা পুরোটাই উল্টো।’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘সংখ্যালঘু বলে তিনি (অমর্ত্য সেন) যাঁদের চিহ্নিত করেছেন, সেসব ভাই-বোনদের ওপর নির্যাতনকারী দানবের নাম হচ্ছে আওয়ামী লীগ। সাহস থাকলে তা বলে দিন। পারবেন না। কারণ, আপনারা সীমাবদ্ধ সুশীল।’
জামায়াতের আমির বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সময়-অসময়ে নাক গলানো দেশপ্রেমিক জনগণ একেবারেই পছন্দ করেন না।