সামনে আমাদের একটা যুদ্ধের মাঠের নামতে হবে: সিইসি
Published: 26th, January 2025 GMT
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, আমরা ডিসেম্বরকে টার্গেট করে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। এ জন্য অক্টোবরের মধ্যেই মাঠ পর্যায়ের সব কাজ শেষ করার চেষ্টা করব। আশা করি, এটা শেষ হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হলে অনেক স্বাধীনতা দিতে হবে এবং কিছু প্রস্তাব মানতে হবে। আমাদের সামনে একটা যুদ্ধের মাঠের নামতে হবে, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
আজ রোববার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন কার্যালয় রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি- আর এফইডি আয়োজিত মত বিনিময়সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সিইসি বলেন, পার্লামেন্টের স্থায়ী কমিটির হাতে নির্বাচন কমিশনের কোনো কাজ গেলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে। স্থায়ী কমিটির কাছে নির্ভরশীল হতে চাই না। এ সংক্রান্ত সুপারিশ বাতিল করতে হবে। পার্লামেন্টারি স্টান্ডিং কমিটির মুখাপেক্ষী হলে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হবে। ভোটার হালনাগাদ এবং সীমানা নির্ধারণের জন্য ইসির বাইরে অন্য কারও হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন কমিশনকে কুইক ফেস করা যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে এখনই কোনো ধরনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। রুলস অফ গেমস কিভাবে হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাব এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে পাইনি। সীমানা পুনঃনির্ধারণ নিয়ে কোনো ফয়সালা হয়নি। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ঠিক করতে হবে। সুতরাং অনেক কিছুই আইনের কারণে আটকে আছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সব সময় স্বাধীন। আমাদের চেয়ে বেশি কেউ স্বাধীন নয়। তারপরেও একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে কিছু আইন সংশোধন করতে হবে।
এ এম নাসির উদ্দিন বলেন, অতীতে মে জুন মাসে, অর্থাৎ বর্ষাকালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এমনটা আমি দেখি নাই। নির্বাচন কমিশনকে অন্তত দুই মাস আগে জানাতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন করতে হলে অক্টোবরেই সিডিউল ঘোষণা করতে হবে। আমি চাচ্ছি সব আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করতে। সেজন্য অন্তত কিছুদিন সময়ের প্রয়োজন।
তিনি বলেন, নির্বাচন-সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন থেকে অনেক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এগুলো সব বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ক্ষমতা খর্ব হবে। জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেক হানাহানি ও বিশৃঙ্খলা হয়। শতভাগ মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। জনগণ সচেতন হলে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে হানাহানি বিশৃঙ্খলা ও কাজ চুপে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সিইসি বলেন, আমরা ওই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব, যেদিন পর্যন্ত শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যাদের নিবন্ধন থাকবে তারাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। কে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিতে পারবেন বা পারবেন না, সেটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত নয়, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত।
তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, আমরা ডিসেম্বরকে টার্গেট করে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। এ জন্য অক্টোবরের মধ্যেই মাঠ পর্যায়ের সব কাজ শেষ করার চেষ্টা করব। আশা করি, এটা শেষ হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হলে অনেক স্বাধীনতা দিতে হবে এবং কিছু প্রস্তাব মানতে হবে। আমাদের সামনে একটা যুদ্ধের মাঠের নামতে হবে, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন করত
এছাড়াও পড়ুন:
বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না।
এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি