শিল্পবর্জ্যে নদনদীতে মৃত্যুর ছায়া
Published: 25th, January 2025 GMT
গৃহবধূ ফাতেমা বেগমের বাড়ির অদূরেই ব্রহ্মপুত্র। বর্ষাকালে পানি চলে আসে একেবারে বাড়ির কাছাকাছি। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এই নদের পানির দুর্গন্ধে নাক চেপে রাখতে হয়। আফসোসের সুরে বৃহস্পতিবার এই গৃহবধূ বললেন, ‘এখন আর নাক চেপে ধরি না; দুর্গন্ধই স্বাভাবিক মনে হয়।’
ফাতেমা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের বশিরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। এ উপজেলার অধিকাংশ নদনদীর পানি এখন বিভিন্ন শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যের কারণে ভয়াবহ মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও শুকনো মৌসুমে বেশির ভাগ নদনদীর পানির রং আলকাতরার মতো কালো হয়ে যায়। এ কারণে উপজেলার লাখো মানুষের জীবনের পাশাপাশি কৃষি, জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয় ঘটছে। দূষিত পানির কারণে নদনদীতে এখন মাছ নেই। কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। পানির গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। তারা নদীতে বর্জ্য নিষ্কাশন বন্ধে দফায় দফায় আন্দোলন-সংগ্রাম করেও কোনো ফল পাননি। এখন সব ছেড়ে দিয়েছেন অদৃষ্টের হাতে।
অথচ ১০-১২ বছর আগেও নদীর পানি এমন দূষিত ছিল না বলে জানান নোয়াগাঁও ইউনিয়নের লাধুরচরের কৃষক জমির আলী। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকার ডাইং কারখানা থেকে রঙের অপরিশোধিত পানি ফেলে নদনদী নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। তারা শুধু ধানের ক্ষেতেই এ পানি ব্যবহার করেন। অন্য কোনো কাজে এ পানি নেন না। কোথাও কোথাও তো বর্ষাকালেও পানি কালো হয়ে থাকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনারগাঁ উপজেলা দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদের ২৭ কিলোমিটার অংশ। এতে প্রতিদিন মিশছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ৩৩ কোটি ঘনমিটার বর্জ্য মেশানো পানি, ২৭০ ঘনফুট বর্জ্য। এ ছাড়া নদের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের ৫ সহস্রাধিক খোলা পায়খানার মলমূত্রও সরাসরি মিশছে। ফলে আরও ৮৮৫ ঘনফুট পয়োবর্জ্য নদনদীতে যাচ্ছে। এতে করে পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠছে।
চরপাড়া গ্রামের আলমগীর হোসেন বলেন, এক সময় স্বচ্ছ পানি ছিল ব্রহ্মপুত্রে। এখন মনে হয় আলকাতরা। সেই সময়টি এখনও চোখ বন্ধ
করলেই মনে পড়ে। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সব কাজেই ব্রহ্মপুত্রের পানি ব্যবহার হতো। এখন দূষিত পানির কারণে ফসল উৎপাদনও কমে গেছে। আগে তিনি প্রতি বিঘায় ৪৫ মণ ধান পেতেন। এখন ২০ মণও পান না।
সরেজমিন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী মহজমপুর, গোবিন্দপুর, বশিরগাঁও, চরপাড়া, হরহরদী, মুছারচর, পঞ্চমীঘাট, অলিপুরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের দূষিত পানি দিয়ে শুধু কৃষিকাজ করা যাচ্ছে। গৃহস্থালি অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় না। কিছু জায়গায় এ পানিতেই শিশু-বৃদ্ধসহ নানা বয়সী মানুষকে গোসল করতে দেখা যায়। গোসল করানো হচ্ছে গবাদি পশুকেও। তীরবর্তী এলাকার
মানুষের মধ্যে খোসপাঁচড়াসহ পানিবাহিত নানা রোগ আক্রান্ত বাড়ছে।
এলাকাবাসী জানায়, উপজেলার মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চল, চৈতী কম্পোজিট, গ্যাস্টন ব্যাটারি কারখানা, বেঙ্গল, টাইগার সিমেন্ট, ফ্রেশ, বসুন্ধরা পেপার মিল ও বিভিন্ন সিমেন্ট কারখানাসহ নদীর তীরবর্তী স্থানে গড়ে উঠেছে তিন শতাধিক শিল্পকারখানা। এসব কারখানার বর্জ্য সরাসরি মারীখালি নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদে মিশছে। এ ছাড়াও পাশের আড়াইহাজার উপজেলার বিভিন্ন ডাইংয়ের রঙের পানি ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলা হচ্ছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি বিভিন্ন সময়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ও দূষিত বর্জ্য পানিতে ফেলার প্রতিবাদে মানববন্ধন, স্মারকলিপি ও আন্দোলন করেছে। এতেও কোনো লাভ হয়নি। মূলত শিল্পমালিকদের প্রভাবের কারণে কোনোকিছু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি বলেন, সোনারগাঁ
অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত নদনদীর পানি ব্যবহারের পুরোপুরি অনুপযোগী। এ জন্য বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা দায়ী। তাদের প্রভাবের কারণে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মোহাম্মদ হোসাইনের ভাষ্য, মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চৈতী কম্পোজিট থেকে দুটি খালের মাধ্যমে দূষিত বর্জ্য ফেলে নদীর পানি দূষিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি আড়াইহাজার উপজেলার প্রায় দেড় হাজার ডাইং কারখানা থেকে রাসায়নিক ও রং মেশানো পানি সরাসরি নদে ফেলা হচ্ছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মেঘনা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) কার্তিক চন্দ্র দাসের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও ধরেননি। খুদে বার্তা দিলেও সাড়া দেননি। চৈতী কম্পোজিটের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) মো.
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ তারেকের ভাষ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্যে এসিডের পরিমাণ বেশি। যে কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপক। ওই পানি ব্যবহারের কারণে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বর্জ্য মেশানো পানির ব্যবহার রোধ করতে না পারলে একসময় এসব এলাকায় কৃষিতে বিপর্যয় ঘটবে।
দূষিত বর্জ্যে ডিমওয়ালা মাছ মারা যাচ্ছে জানিয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার বলেন, এ কারণে উৎপাদন নেই। ব্রহ্মপুত্র, মারীখালি, পঙ্খীরাজ খালে এখন আর মাছ নেই। পানিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মনোঅক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ দাবি করেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলার বিষয়টি প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষিত করার প্রমাণ পাওয়া গেলেই তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র র উপজ ল র পর ব শ
এছাড়াও পড়ুন:
সময়ে এক ফোঁড় দিন
বরিশাল তথা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদনদীর পানি লবণাক্ত হইবার যেই চিত্র মঙ্গলবার সমকালের এক প্রতিবেদনে তুলিয়া ধরা হইয়াছে, উহা উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে উদ্ধৃত বরিশাল মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্য বলিতেছে, সেচের জন্য উপযুক্ত নদীর প্রতি মিটার পানিতে শূন্য দশমিক ৭ ডিএস এবং প্রতি মিটার মাটিতে ২ ডিএসের কম লবণাক্ততা থাকিতে হয়। কিন্তু ইনস্টিটিউটের সম্প্রতি পরিচালিত গবেষণায় দক্ষিণাঞ্চলের নদীর পানিতে সর্বোচ্চ ১৫ হইতে ২০ ডিএস পার মিটার এবং মাটিতে সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস পার মিটার লবণাক্ততা পাওয়া গিয়াছে। উপরন্তু, এক দশক পূর্বেও শুষ্ক মৌসুম তথা নভেম্বর হইতে এপ্রিল অবধি সমুদ্র-সংলগ্ন তিন-চারটি নদীতে লবণপানি পৌঁছাইত। বর্তমানে সেই নদীর সংখ্যা ২০। বিশেষ করিয়া বর্ষা মৌসুমে প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত না হওয়া, তৎসহিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতু স্বাভাবিক আচরণ হারাইবার কারণে সংকট তীব্র হইয়াছে। নদনদীর পানিতে লবণ বৃদ্ধি পাইলে স্বাভাবিকভাবেই উহার প্রভাব পড়ে মাটিতে এবং মাটির লবণাক্ততার নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করিলে উহা ফসল উৎপাদনে প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায়। ইহার প্রতিফলস্বরূপ দক্ষিণাঞ্চলের অর্ধেকের বেশি ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হইবার কারণে খাদ্য উৎপাদন লইয়া শঙ্কা তৈয়ার হইয়াছে।
বলা বাহুল্য, এই সংকট কেবল বরিশালেই নহে; দেশের অন্যত্র বিরাজমান। ইতোপূর্বে সমকালেই প্রকাশিত একাধিক সংবাদ অনুসারে, খুলনা অঞ্চলের অধিকাংশ নদী লবণাক্ততার কবলে পড়িয়াছে। চট্টগ্রামসহ অন্য উপকূলীয় জেলাসমূহেও অনুরূপ সংকটে ভুগিতেছেন কৃষকরা। লবণাক্ততার কারণে দেশের অনেক জমি পতিত এবং এক ফসলি থাকিয়া যাইতেছে। এই সংকট জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তাকে যে হুমকির মুখে ফেলিতেছে, ইহা বুঝিতে বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই। নদীর পানি লবণাক্ত হইবার ফলে ফসল শুধু নয়; সামগ্রিক পরিবেশ-প্রতিবেশও বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিশেষত মিঠাপানির জীববৈচিত্র্যের জন্য লবণ হুমকিস্বরূপ। লবণের আগ্রাসনে মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়িয়া থাকে। এমনকি স্বাস্থ্যের জন্যও এই পানি বিপদ ডাকিয়া আনিতে পারে। লবণাক্ত পানি পান করিলে ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। নিঃসন্দেহে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তবে নির্বিচার দখল-দূষণের শিকার এবং সীমান্তের অপর পার্শ্বে বাঁধ দিয়া নদনদীর স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত করাও ইহার জন্য কম দায়ী নহে।
এই সংকট কাটাইয়া উঠিতে পদক্ষেপ লওয়া জরুরি বলিয়া আমরা মনে করি। অস্বীকার করা যাইবে না, জলবায়ুর বাস্তবতায় নদনদীর লবণাক্ততা বিশেষ করিয়া শুষ্ক মৌসুমে শূন্যে নামাইয়া আনা কঠিন হইবে। তবে দখল-দূষণ বন্ধ এবং আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সরকারের পক্ষ হইতে যথাযথ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া আমরা মনে করি। লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে দেশের কৃষি বিভাগের তৎপরতাও জরুরি। লবণসহিষ্ণু প্রযুক্তি ও ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং উহার ব্যবহার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। আমরা জানি, ইতোমধ্যে কৃষি বিভাগ এই লক্ষ্যে কাজ করিতেছে। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে অতিদ্রুত উদ্যোগ না গ্রহণ করিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইতে পারে। আমরা জানি, লবণাক্ত অঞ্চলে কৃষির অপেক্ষাকৃত নূতন প্রযুক্তি সর্জন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে জমি কাটিয়া উঁচু করিয়া চাষাবাদে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা সুফল পাইয়াছেন। কৃষি বিভাগ এই ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও নির্দেশনা দিয়া কৃষকদের পাশে অবস্থান করিতে পারে। মনে রাখিতে হইবে, লবণাক্ততার কারণে ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট হইবার পরিণাম শুধু খাদ্য সংকটই সৃষ্টি করিবে না; উপকূলীয় অঞ্চল হইতে নগরমুখী অভিবাসন সমস্যাও গভীরতর করিয়া তুলিবে।