শারমিন আক্তারের (ছদ্মনাম) বর্তমান বয়স ২১ বছর। থাকেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের খরশণ্ডা নামক একটি গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে চাইলেও পারেননি। মেয়ে সমাজের চোখে অনেক বড় হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়িতে ঘটক পাঠানো হয়। শারমিনের মা-বাবার ইচ্ছা একমাত্র মেয়েকে খুব ভালো ঘরে বিয়ে দেবেন। ১৩ বছর বয়সে স্থানীয় মসজিদের এক ইমামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এক মাস না যেতেই শারমিনের ঘর ভাঙে। এক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচ্ছেদ হয় শারমিনের। কিছুদিন পরই তাকে বিয়ে দেওয়া হয় আরেকজনের সঙ্গে; যার আগে তিন বছরের সংসারে বিচ্ছেদ হয়েছে। ভালোই চলছিল শারমিনের সংসার। নতুন বউকে কেউ নতুন বউ বলে না, সবাই ডাকে ‘আনিসুলের (ছদ্মনাম) দ্বিতীয় বউ’ বলে। সংসারের কাজে ভুল হলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগের বিয়ে নিয়ে খোঁটা দেয়। বিয়ের দুই বছরের মাথায় শারমিনের কন্যাসন্তান হয়। মা হওয়ার অনুভূতি বুঝে ওঠার আগেই শারমিনের কাঁধে চাপে দায়িত্বের বোঝা। স্বামী ঢাকায় কাজ করেন। বাড়িতে আসেন কম। শ্বশুরবাড়ি থেকে বারবার মোটরসাইকেল, ঘরের বিভিন্ন আসবাবের আবদার আসতে থাকে। তা না দিলে শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই নেই। মেয়ের সুখের সংসারের জন্য তাঁর বাবা সাধ্যের বাইরেও অনেক কিছু পাঠান। অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে প্রায়ই শারমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেখা দেয় রক্তশূন্যতা আর অনিয়মিত ঋতুস্রাব। শারীরিক অসুস্থতার প্রভাব পড়ে মনেও। মানসিক দুশ্চিন্তা শুরু হয়।
বাল্যবিয়ের কারণ সম্পর্কে ডুমুরিয়ার এক অভিভাবক জানান, মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যেখানে ছেলেকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করতে হয় না। অথচ বিয়ে দিয়ে আরও সমস্যায় পড়া লাগে। মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে সুখে থাকার জন্য বিভিন্ন জিনিস দিতে হয়, জামাইয়ের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে, সবকিছু দেওয়ার পরও মেয়েকে সুখী দেখা যায় না। মেয়েকে পড়ালেখা সেখানোর ইচ্ছা থাকলেও পারা যায় না সমাজের চাপে। মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে, এখন বিয়ে না দিলে আর বিয়ে হবে না– এ কথা শুনতে শুনতে অনেক অভিভাবক মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। আর্থিক সচ্ছলতা না থাকাও বাল্যবিয়ের একটা বড় কারণ।
জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জীবিতদের মধ্যে ৬৪ কোটি মেয়ে ও নারীর শৈশবে বিয়ে হয়েছে এবং প্রতি বছর ১ দশমিক ২ কোটি কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে শৈশবে বিয়ে হওয়া ২০-২৪ বছর বয়সী নারীর হার ২১ থেকে ১৯-এ নেমে এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূল করার এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বৈশ্বিক হারে ২০ গুণ দ্রুত হ্রাস ঘটাতে হবে। ইউএনএফপিএ’র ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে; এশিয়ায় এটিই সর্বোচ্চ। দেশে বাল্যবিয়ের শীর্ষে রয়েছে খুলনা বিভাগ, শীর্ষ জেলা সাতক্ষীরা।
মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান বলেন, ‘১০ থেকে ১৯ বছর বয়সে মানসিক বিকাশ অন্যরকমভাবে হয়। এ সময় শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়। বাল্যবিয়ের কারণে কিশোরীদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। মানসিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, পাশাপাশি যৌন সম্পর্ক নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে অনেক কিশোরী বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়। তাছাড়া সামাজিকভাবে তাদের অনেক ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন বাচ্চা নেওয়ার জন্য পরিবারের চাপ। অল্প বয়সে বাচ্চা নিতে গেলে অনেক মায়ের পাশাপাশি অনাগত সন্তান পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এ জন্য মেজাজ খিটখিটে, অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। সামাজিক সম্পর্ক প্রতিস্থাপনে বাধাগ্রস্ত হয়। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে না। পারিবারিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতেও সমস্যায় পড়ে।

ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা রোকন আহম্মেদ দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সিলেটের কিছু এলাকায়। জানান, সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি। বাল্যবিয়ের ভয়াল চিত্র কিশোরীর যে শারীরিক, মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে, তা শিক্ষা, আত্মবিশ্বাসসহ সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
যে বয়সে দুরন্ত কৈশোরে ছুটে বেড়ানোর কথা, সে সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলে ওই কিশোর বা কিশোরীর স্বাভাবিক চলা ব্যাহত হয়। নারীর মা হওয়ার চাপ এবং পুরুষের সংসার চালানোর সামাজিক চাপে কৈশোরের আনন্দ মাটি হয়ে যায়। অল্প বয়সী মেয়েটি বিয়ে মেনে নিয়ে সব সমস্যা সামাল দিয়ে সংসার নিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ে, তেমনি ছেলেটি দায়িত্ব নিতে হিমশিম খায়। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় পারিবারিক বিরোধ; যা থেকে আমরা বিচ্ছেদও দেখি। মানসিক, শারীরিক, সামাজিক সমস্যার ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হয়। এ সময় এমনকি অনেকে আত্মহত্যার পথেও পা বাড়ায়। 
কিশোরী বয়সে মা হলে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকে। শরীর সন্তান ধারণের জন্য পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে অনেকের জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে; পাশাপাশি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থেকে কিশোরী মায়ের বন্ধ্যত্ব, জরায়ু ক্যান্সারের আশঙ্কাও থাকে বেশি। v
লেখক: উন্নয়ন কর্মী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বছর বয়স হওয় র র বয়স সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

বইমেলা উপলক্ষে ঢাবিতে যানবাহন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা শিথিল

অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে বহিরাগত যানবাহন প্রবেশের ক্ষেত্রে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) ঢাবির জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ এ বইমেলায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে তাদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে প্রবেশপথগুলোতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে যে বিধি-নিষেধ থাকে, তা অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে শিথিল করা হলো। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো ব্যারিকেড রাখবে না।

তবে, ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এ প্রবেশপথগুলোতে সুশৃঙ্খলভাবে যানবাহন প্রবেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যানবাহনগুলো সুশৃঙ্খলভাবে পার্কিং করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক দল এবং প্রক্টরিয়াল মোবাইল সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা ট্রাফিক বিভাগকে এ ব্যাপারে সার্বিক সহায়তা করবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

ঢাকা/সৌরভ/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ