বাল্যবিয়ে: শরীর ও মনের ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি
Published: 25th, January 2025 GMT
শারমিন আক্তারের (ছদ্মনাম) বর্তমান বয়স ২১ বছর। থাকেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের খরশণ্ডা নামক একটি গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে চাইলেও পারেননি। মেয়ে সমাজের চোখে অনেক বড় হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়িতে ঘটক পাঠানো হয়। শারমিনের মা-বাবার ইচ্ছা একমাত্র মেয়েকে খুব ভালো ঘরে বিয়ে দেবেন। ১৩ বছর বয়সে স্থানীয় মসজিদের এক ইমামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এক মাস না যেতেই শারমিনের ঘর ভাঙে। এক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচ্ছেদ হয় শারমিনের। কিছুদিন পরই তাকে বিয়ে দেওয়া হয় আরেকজনের সঙ্গে; যার আগে তিন বছরের সংসারে বিচ্ছেদ হয়েছে। ভালোই চলছিল শারমিনের সংসার। নতুন বউকে কেউ নতুন বউ বলে না, সবাই ডাকে ‘আনিসুলের (ছদ্মনাম) দ্বিতীয় বউ’ বলে। সংসারের কাজে ভুল হলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগের বিয়ে নিয়ে খোঁটা দেয়। বিয়ের দুই বছরের মাথায় শারমিনের কন্যাসন্তান হয়। মা হওয়ার অনুভূতি বুঝে ওঠার আগেই শারমিনের কাঁধে চাপে দায়িত্বের বোঝা। স্বামী ঢাকায় কাজ করেন। বাড়িতে আসেন কম। শ্বশুরবাড়ি থেকে বারবার মোটরসাইকেল, ঘরের বিভিন্ন আসবাবের আবদার আসতে থাকে। তা না দিলে শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই নেই। মেয়ের সুখের সংসারের জন্য তাঁর বাবা সাধ্যের বাইরেও অনেক কিছু পাঠান। অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে প্রায়ই শারমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেখা দেয় রক্তশূন্যতা আর অনিয়মিত ঋতুস্রাব। শারীরিক অসুস্থতার প্রভাব পড়ে মনেও। মানসিক দুশ্চিন্তা শুরু হয়।
বাল্যবিয়ের কারণ সম্পর্কে ডুমুরিয়ার এক অভিভাবক জানান, মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যেখানে ছেলেকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করতে হয় না। অথচ বিয়ে দিয়ে আরও সমস্যায় পড়া লাগে। মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে সুখে থাকার জন্য বিভিন্ন জিনিস দিতে হয়, জামাইয়ের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে, সবকিছু দেওয়ার পরও মেয়েকে সুখী দেখা যায় না। মেয়েকে পড়ালেখা সেখানোর ইচ্ছা থাকলেও পারা যায় না সমাজের চাপে। মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে, এখন বিয়ে না দিলে আর বিয়ে হবে না– এ কথা শুনতে শুনতে অনেক অভিভাবক মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। আর্থিক সচ্ছলতা না থাকাও বাল্যবিয়ের একটা বড় কারণ।
জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জীবিতদের মধ্যে ৬৪ কোটি মেয়ে ও নারীর শৈশবে বিয়ে হয়েছে এবং প্রতি বছর ১ দশমিক ২ কোটি কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে শৈশবে বিয়ে হওয়া ২০-২৪ বছর বয়সী নারীর হার ২১ থেকে ১৯-এ নেমে এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূল করার এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বৈশ্বিক হারে ২০ গুণ দ্রুত হ্রাস ঘটাতে হবে। ইউএনএফপিএ’র ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে; এশিয়ায় এটিই সর্বোচ্চ। দেশে বাল্যবিয়ের শীর্ষে রয়েছে খুলনা বিভাগ, শীর্ষ জেলা সাতক্ষীরা।
মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান বলেন, ‘১০ থেকে ১৯ বছর বয়সে মানসিক বিকাশ অন্যরকমভাবে হয়। এ সময় শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়। বাল্যবিয়ের কারণে কিশোরীদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। মানসিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, পাশাপাশি যৌন সম্পর্ক নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে অনেক কিশোরী বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়। তাছাড়া সামাজিকভাবে তাদের অনেক ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন বাচ্চা নেওয়ার জন্য পরিবারের চাপ। অল্প বয়সে বাচ্চা নিতে গেলে অনেক মায়ের পাশাপাশি অনাগত সন্তান পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এ জন্য মেজাজ খিটখিটে, অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। সামাজিক সম্পর্ক প্রতিস্থাপনে বাধাগ্রস্ত হয়। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে না। পারিবারিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতেও সমস্যায় পড়ে।
ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা রোকন আহম্মেদ দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সিলেটের কিছু এলাকায়। জানান, সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি। বাল্যবিয়ের ভয়াল চিত্র কিশোরীর যে শারীরিক, মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে, তা শিক্ষা, আত্মবিশ্বাসসহ সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
যে বয়সে দুরন্ত কৈশোরে ছুটে বেড়ানোর কথা, সে সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলে ওই কিশোর বা কিশোরীর স্বাভাবিক চলা ব্যাহত হয়। নারীর মা হওয়ার চাপ এবং পুরুষের সংসার চালানোর সামাজিক চাপে কৈশোরের আনন্দ মাটি হয়ে যায়। অল্প বয়সী মেয়েটি বিয়ে মেনে নিয়ে সব সমস্যা সামাল দিয়ে সংসার নিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ে, তেমনি ছেলেটি দায়িত্ব নিতে হিমশিম খায়। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় পারিবারিক বিরোধ; যা থেকে আমরা বিচ্ছেদও দেখি। মানসিক, শারীরিক, সামাজিক সমস্যার ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হয়। এ সময় এমনকি অনেকে আত্মহত্যার পথেও পা বাড়ায়।
কিশোরী বয়সে মা হলে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকে। শরীর সন্তান ধারণের জন্য পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে অনেকের জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে; পাশাপাশি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থেকে কিশোরী মায়ের বন্ধ্যত্ব, জরায়ু ক্যান্সারের আশঙ্কাও থাকে বেশি। v
লেখক: উন্নয়ন কর্মী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বছর বয়স হওয় র র বয়স সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
ঠিকাদার বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে ২ প্রকৌশলীকে হুমকির অভিযোগ
খুলনা নগরীর খানজাহান আলী থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা সোহাগের বিরুদ্ধে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দুই প্রকৌশলীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কুয়েটের একটি ভবনের ছাদের ওয়াটারপ্রুফিংয়ের কাজে ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে লাভ আরও বেশি নির্ধারণের কথা বলেছিলেন ওই ঠিকাদার। এ নিয়ে প্রকৌশলীদের তিনি হুমকি দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ প্রেক্ষাপটে কুয়েটের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) শেখ আবু হায়াত ও নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) মো. গোলাম কিবরিয়া সোমবার কুয়েট উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করে নিরাপত্তা চেয়েছেন।
সূত্র জানায়, কুয়েটের ১৩ নম্বর ভবনের ছাদের ওপর ওয়াটারপ্রুফিংয়ের কাজ নিয়েছেন মোল্লা সোহাগ। কাজটি কয়েকদিন আগে শুরু হয়। গত রোববার বিকেল ৩টার দিকে ঠিকাদার সোহাগ প্রথমে নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়ার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী এ বি এম মামুনুর রশিদ এবং অন্য নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ আবু হায়াতকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হুমকি দেন। গালাগাল করতে নিষেধ করলে তিনি গোলাম কিবরিয়াকেও গালাগাল ও হুমকি দেন। পরে তিনি একই পরিচয় দিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ আবু হায়াতকে ফোনে গালাগাল ও হুমকি দেন।
উপাচার্যের কাছে দুই নির্বাহী প্রকৌশলী লিখিত অভিযোগে বলেন, ওয়াটারপ্রুফিংয়ের কাজের দর প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের প্রকৌশলীরা বাজারদরের সঙ্গে সরকারি নিয়মে ভ্যাট, আইটি ও ১০ শতাংশ প্রফিট বা লাভ (পূর্বনির্ধারিত) যুক্ত করে নির্ধারণ করেন। ঠিকাদার সোহাগ ১০ শতাংশ লাভ কেন যুক্ত করে দর নির্ধারণ করা হয়েছে, তাঁকে আরও বেশি লাভ দিতে হবে বলে ফোনে প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়াকে জানান। এ কথা বলার পর প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু কোনো কথা না শুনে ফোনে প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া ও শেখ আবু হায়াতকে গালাগাল ও মারধরের হুমকি দেন সোহাগ। এ অবস্থায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ আবু হায়াত বলেন, রোববার বিকেল ৩টার কিছু আগে খানজাহান আলী থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয়ে আমাকে ফোন দিয়ে বলে– ‘তুই চেয়ারের পরে বসে সবাইরে ১০ লাখ ২০ লাখ টাকার কাজ দিস। আমাকে দিছিস টেন পারসেন্ট লাভে।’ এই বলে আমাকে যাচ্ছেতাই বলে গালাগাল করেন। পাঁচ মিনিট পর ফোন দিয়ে আমাকে দেখে ছাড়বেন, আমার বাড়ি আক্রমণ করবেন, ফুলবাড়িগেটে গেলে আমাকে দেখে নেবেন– এসব বলে হিুমকি দেন।
নিজের সাংগঠনিক পরিচয় ও প্রকৌশলীকে ফোন দেওয়ার কথা স্বীকার করেন মোল্লা সোহাগ। তবে কোনো ধরনের ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন। মোল্লা সোহাগ বলেন, আমার নেতার অর্ডার আছে– আমি কোনো জায়গায় কোনো টেন্ডারেও যাই না, কোনো ঠিকাদারিতেও নেই। আমার কোনো কাজ কুয়েটে চলে না। আমার ট্রেড লাইসেন্সই নেই, কাজ পরের কথা। আমি তাদের (প্রকৌশলী) ফোন দিয়েছিলাম, কথা হয়েছে, তবে কোনো হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়নি।
কোনো কাজ চলছে না, তাহলে প্রকৌশলীদের কার হয়ে ফোন দিয়েছিলেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা আবু হায়াত ও গোলাম কিবরিয়াকে ফোন দিলে ভালোভাবে জানতে পারবেন।’