সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, হবিগঞ্জের লাখাইয়ে জলমহালের দখল নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুই নেতার লোকজনের মধ্যে রাতের আঁধারে টর্চ জ্বালিয়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ অর্ধশতাধিক আহত (সমকাল, ৯ জানুয়ারি ২০২৪)। আপাতদৃষ্টিতে খবরটিকে ‘চাঞ্চল্যকর’ মনে হতে পারে; কিন্তু জলমহাল নিয়ে সংঘর্ষ, খুনোখুনিও বিরল নয়। 

কাগজে-কলমে যদিও ‘প্রকৃত’ জেলেদের জলমহাল ইজারা দেওয়ার কথা রয়েছে; এ জন্য যদিও ‘মৎস্যজীবী সমিতি’ গঠন এবং নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে; বাস্তবে জলমহালের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কাছেই থাকে। প্রকৃত জেলেরা সেখানে বড়জোর ‘শ্রমিক’ মাত্র। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই মৎস্যজীবী সমিতির নামে ইজারার টাকা পরিশোধ করেন। পরে ওই সব মৎস্যজীবীকে ব্যবহার করে মাছ ধরে বা চাষ করে থাকেন। 

এ ধরনের ‘অনিয়ম’ রোধে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সব আবেদনপত্র অনলাইনে গৃহীত হবে। অথচ এটি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, যদি ‘প্রকৃত মৎস্যজীবীরা’ অনলাইনে আবেদনই করতে পারবেন, তাহলে অফলাইনেও আবেদন করতে অসুবিধা কী? জলমহাল ইজারার বিষয়টি কি এক-দুই দিনের বিষয় যে, ‘চুপিসারে’ অনলাইনে আবেদন করলেই সব কাজ শেষ? যে প্রভাবশালীরা ভয়ভীতি দেখিয়ে ইজারায় কারসাজি করেন, অনলাইন আবেদনে ইজারা পেয়ে অফলাইনে তাদের এড়িয়ে মৎস্যজীবীরা জলমহালে নামতে পারবেন? বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এটি বিশ্বাসযোগ্য?

ইজারার নামে আসলে কী ঘটে, সেটি ফুটে উঠেছিল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে– ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় হাওরের বিল-জলমহাল ইজারা নিয়েছে। এখন এসব ইজারা বাতিল করতে হবে। আওয়ামী লীগ যে টাকা দিয়ে ইজারা নিয়েছে, সে টাকা আমরা দিয়ে দেব, প্রয়োজনে আরও ১০ পার্সেন্ট বেশি দেব। তবুও এলাকার সাধারণ মানুষকে জলমহালের মাছ ধরার অধিকার দিতে হবে। আওয়ামী লীগের লোকজন পাটিবাঁধ দিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ মারে আর গরিব জেলে ও সাধারণ মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে’ (মানবজমিন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।

ফজলুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েও যোগ করা যেতে পারে যে, শুধু আওয়ামী লীগ নয়; যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন তারাই এসব জলমহাল নিয়ন্ত্রণ করেছে। সাধারণ জেলেরা, তাঁরই ভাষায়, শুধু ‘চেয়ে চেয়ে দেখেছে’। যেমন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর এখন বেশির ভাগ জলমহাল বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীর দখলে চলে গেছে। কোথাও কোথাও এ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষ বা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধও দেখা দিচ্ছে।

প্রশ্নটা কেবল জলমহালগুলো ‘প্রকৃত’ জেলের ইজারাপ্রাপ্তি নিয়ে নয়; কোন জলাভূমিকে ‘জলমহাল’ ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হচ্ছে, সেটিও। দেখা যাচ্ছে, জেলা প্রশাসন কাঁচা পয়সার লোভে বা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপে প্রবহমান নদীকেও জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দিয়ে থাকে। জলমহাল ব্যবস্থার উপদ্রবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ যে ঐতিহ্য মেনে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে নিজের হাতে মাছ ধরে খাবে, সেই সুযোগও প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। 

অথচ জলমহাল নীতিমালা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুযায়ী, দেশে দুই ধরনের জলমহাল রয়েছে; বদ্ধ বা অবক্ষয়িত ও উন্মুক্ত জলমহাল। এর মধ্যে খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর, বিল, ঝিল, বাঁওড় বদ্ধ জলমহাল এবং নদী ও খাল উন্মুক্ত জলমহাল হিসেবে চিহ্নিত। দেশের ‘প্রকৃত’ জেলেদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে সেই ১৯৯৫ সালেই নদী, খাল ও উন্মুক্ত শ্রেণির সব জলমহালের ইজারা প্রদান প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এখনও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে যে, প্রবহমান নদী বা খালকে বদ্ধ বা অবক্ষয়িত জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়। 

যেমন, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে প্রবাহিত চকিরপশার নদীকে ‘বিল’ ঘোষণা করে বছরের পর বছর ইজারার নামে দখলদারিত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেছেন, উল্টো প্রভাবশালী দখলদারদের হুমকি-ধমকি, এমনকি শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। জেলা প্রশাসন হয় গোপনে মদদ দিয়েছে, না হয় প্রকাশ্যে ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়েছে।  
কথিত জলমহাল ইজারা নিয়ে সরকারিভাবেই কী তুঘলকি কাণ্ডকারখানা চলতে পারে, এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ অবশ্য পাবনা জেলা প্রশাসনের। গত বছর জানুয়ারি মাসে পাবনা জেলা প্রশাসনের জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি ৯টি উপজেলার যে ৬৩টি জলমহাল তিন বছরের ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়, সেগুলোর ৩১টিই প্রবহমান নদীর অংশ। যে ১০টি নদীর অংশবিশেষ ‘জলমহাল’ ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রমত্ত পদ্মা ছাড়াও ইছামতী, আত্রাই, চন্দ্রাবতী, বড়াল, চিকনাই, গুমানি, গোহালা, কাগেশ্বরী ও রুকনাই নদী রয়েছে।

ব্যক্তিগত আক্ষেপের বিষয়, বড়াল নদী রক্ষায় ওই অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলন করে আসছে, তার সঙ্গে আমারও সামান্য সম্পৃক্ততা রয়েছে। ২০১০ সালে নদীটি নিয়ে ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ এবং ‘রিভারাইন পিপল’ যৌথভাবে যে গবেষণা করেছিল, সেখানে প্রাঞ্জল ভাষায় বলা হয়েছিল যে, প্রবহমান বড়াল নদীকে জলমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়ার মতো বেআইনি কাজ করা যাবে না।
আমার না হয় সামান্য আক্ষেপ, বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমানের আরও কেমন অনুভূতি হওয়ার কথা? বলতে গেলে পুরোটা জীবন তিনি ব্যয় করেছেন বড়াল রক্ষার আন্দোলনে। এর আগেও মিজান ভাই আন্দোলন করে বড়ালের ইজারা বাতিল করেছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন যেন নাছোড়বান্দা! কারণ জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দিতে পারলেই ঘোষিত রাজস্ব যেমন তেমন, অঘোষিত পথে লাভেই লাভ!

ওই ১০ নদীর তালিকায় ইছামতী ইজারা দেওয়ার বিষয়য়টি আরও মহাকাব্যিক। ২০২৩ সালের অক্টোবরেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি তথা একনেক ‘পাবনা জেলার ইছামতী নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ’ প্রকল্পে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কাজও শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন নদীটির এক অংশ ইজারার জন্য ওয়েবসাইটে তোলে!
প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, সবচেয়ে সহজ ও সংগত সমাধান হচ্ছে, জলমহাল ইজারাপ্রথা বাতিল। জলমহাল ইজারা দিয়ে সরকার যে হস্তী-অশ্ব তুল্য রাজস্ব পায়, এমন নয়। যেমন ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ১৩৪টি জলমহাল ইজারা দিয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ১১৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার টাকা। অথচ ওই অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। 

অপরদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মৎস্যজীবীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ১৫৪ জন; বলা বাহুল্য, সাধারণত খানাপ্রতি একজন ধরে। যে কারণে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে ১ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল।
এটি স্পষ্ট, জাতীয় বাজেটের তুলনায় জলমহাল থেকে পাওয়া রাজস্ব সরকারের কাছে নস্যিও নয়! এই কমবেশি ১০০ কোটি টাকা রাজস্বের জন্য ৭ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের দেশে ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা জিম্মি করার কী অর্থ থাকতে পারে? দুর্নীতিবাজ আমলা, টাউট রাজনীতিক, বাটপার সমাজপতিদের রমরমা অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া? অথচ, জলমহাল প্রথা বাতিলের একটি সিদ্ধান্তে কোটি জেলের জীবন বদলে যেতে পারে।

শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.

com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ বড় ল র র জন য মৎস য ব এনপ সরক র আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

দেবীগঞ্জে দেয়ালে দেয়ালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে লেখা হয়েছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।

শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) সকাল থেকে পৌরসভার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে এই লেখা সাধারণ মানুষের নজরে আসে। তবে, কারা এই স্লোগান লিখেছেন, তা কেউ দেখেননি।

পৌরসভার শহীদ আব্দুল মান্নান সড়ক সংলগ্ন উপজেলা পরিষদ চত্বর, নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের দেয়ালে লাল, কালো ও নীল রঙের কালি দিয়ে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় শেখ হাসিনা’ এবং ‘শেখ হাসিনা তুমি আস্থা’- এমন স্লোগান লেখা হয়েছে।

এদিকে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অফিসিয়াল পেজ থেকে আজ দুপুর ১টায় দেবীগঞ্জের বিভিন্ন দেয়ালে লেখা স্লোগানের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করা হয়। এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।

দেবীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান সুমন বলেন, ‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনকে জানানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাতের আঁধারে দেয়ালে দেয়ালে ‘জয় বাংলা’ লিখছে তারা। উপজেলা ছাত্রদলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সজাগ রয়েছে।"

প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চগড় জেলা সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বলেন, ‍“গত ৫ আগস্টের পর শুধু দেবীগঞ্জ নয়, পুরো পঞ্চগড়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেবীগঞ্জ, বোদা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে এসব দেওয়াল লিখন লক্ষ্য করা গেলেও প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা নেই। এসব লেখা ’২৪ বিপ্লবের চেতনাকে ম্লান করার চেষ্টা করছে। যা রুখতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রশাসনের প্রতি আহ্বান- তাদের (ছাত্রলীগ নেতাকর্মী) দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক। তাদের অপতৎপরতা রুখে দিতে পঞ্চগড় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।”

দেবীগঞ্জ থানার ওসি সোয়েল রানা মোবাইলে বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে আসছে। এখনি কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। বিষয়টি দেখছি আমরা।”

ঢাকা/নাঈম/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ