অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে মিলছে কি?
Published: 25th, January 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, আমাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। সংস্কারে ব্যর্থ হলে এ জাতি বহুধা পিছিয়ে যাবে। রাজনীতির ডান-বাম ধারার সবাই দোহার হয়ে একই কথা বলছেন। বাস্তবতা হলো, কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। অর্থনীতি যখন ডুবছে, বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজ তথা আয়-উপার্জনের পথ হারাচ্ছে, তখন দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও তথৈবচ। সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর সরকার বিশেষত ধর্মীয় ও সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়। তার জন্য আমার জাতিসত্তার বাইরের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে, আমার ভাষার বাইরের ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠীকে, আমার ধর্মের বাইরের ছোট ধর্মগোষ্ঠীকে এবং তাদের আচরণ, মতামতকে আমার সইতে পারার মতো মন তৈরি করতে হয়। অন্তত এর আগ পর্যন্ত জাতি, ভাষা, ধর্মের সব সংখ্যালঘুকে রাষ্ট্রীয় নিরঙ্কুশ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দরকার। সে জায়গায় আমি মনে করি, রাষ্ট্র নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই আজ অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন কিংবা বহুত্ববাদ চর্চার ওপর মহলের কথাগুলো নিছক কথার কথায় পরিণত হচ্ছে।
শুরুতে ভাস্কর্য ভাঙার কয়েক ডজন ঘটনার ক্ষেত্রে কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। ফলে মানুষ ভেবেছে ভাস্কর্যগুলোই বোধহয় স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ! আওয়ামী লুটেরারা মানুষের চিন্তার আড়ালে যেতে পেরেছে। ভাস্কর্য ভাঙার পরে আমরা মন্দির ও মাজার ভাঙতে দেখেছি। একের পর এক মন্দির ও মাজারে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। মানুষ অসহায় দৃষ্টিতে তা দেখেছে। দাবি তোলার পরও কোনো প্রতিকার মেলেনি। এ অবস্থায় মানুষ মনে করেছে সরকারেরই কোনো কোনো অংশ মুখে যতই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির কথা বলুক, কার্যত মনে বিদ্বেষই লালন করে। এ ধরনের অনেক ঘটনায় মামলা হয়েছে বটে, সরকারও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানান দিয়েছে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলেও তো বহু সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মামলা হয়েছিল, একটারও কি নিষ্পত্তি হয়েছে? ভুক্তভোগী সুবিচার পেয়েছে? এবারও যে ওইসব মামলা একই ভাগ্য বরণ করবে না, এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? প্রশাসনের তরফে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মিটিং যেমন আয়োজন করা হয়, তেমন করে মাসে একবার সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে ভিন্ন ধর্মের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বয়ান আসতে পারত। তা সম্ভবত তাদের চিন্তায়ও আসেনি।
ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য মানুষকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন ছিল। এমনকি মূর্তিপূজাও সংশ্লিষ্ট নাগরিকের অধিকার বলে প্রচার করা যেত। এই বয়ান একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত গেলে নিশ্চয়ই এর একটি ইতিবাচক ফল মিলতে পারত।
রাষ্ট্রের চোখে মসজিদ-মন্দির, গির্জা-প্যাগোডা কি মাজার সবই সমান। এটিই বহুত্ববাদ। এখানেই বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু বৈষম্য থাকতে পারবে না। এটি ঠিক, ওইসব ভাঙচুর, আক্রমণের সময়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিপর্যস্ত ছিল। যুক্তিগ্রাহ্য মানুষ মনে করেছিল, পুলিশে এখনও শৃঙ্খলা আসেনি, তাই এসব হচ্ছে। অল্প কিছুদিন পরেই এসব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু অগ্রসর চিন্তার মুসলিম ধর্মীয় দল মন্দির পাহারা দিয়েছে, তা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। পুলিশ ইতোমধ্যে তার দাঁত দেখাতে শুরু করেছে। অন্তত মজুরি-ভাতার ন্যায্য দাবিতে রাস্তায় নামা শ্রমিকদের এবং চাকরির দাবিতে মিছিলকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশকে সেই দাঁত বসাতে আমরা দেখেছি। এর মধ্যেও মন্দির-মাজারে হামলা হয়েছে, পুলিশ নির্বিকার ভূমিকা পালন করেছে।
এনসিটিভির নবম ও দশম শ্রেণির ব্যাকরণ বই নিয়ে শোরগোল হলো। বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ নামে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়া হলো ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ স্লোগান দিয়ে। এর প্রতিবাদ করায় পাহাড়ে নয়, খোদ রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু মতিঝিলে ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’র উগ্র ছাত্ররা ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার’ ওপর হামলা করল, তাদের রক্তে রাজপথ রাঙা হলো। আদিবাসী ছাত্ররা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গেল। সেখানেও বাধা এলো এবং হামলা হলো। আবার ওই ঘটনার প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা’ ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানসহ শত সহস্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে মিছিল বের করে দোয়েল চত্বর পার হলেই পুলিশ জলকামান আর লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখানেও ভুক্তভোগীরা কোনো প্রতিকার পেল না।
মজার ব্যাপার হলো, নিরীহ আদিবাসী শব্দ নিয়ে এই তুলকালাম কাণ্ড যখন চলছিল তখনই সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ যুক্ত করার প্রস্তাব এলো সরকার গঠিত কমিশন থেকে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বলাবলি করতে লাগল, কীসের বহুত্ববাদ? যে যায় লঙ্কা, সেই হয় রাবণ! হাসিনা স্বৈরাচারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কোনো পার্থক্য আছে কিনা, এই যখন মানুষ ভাবছে তখন বলুন তো, এই উগ্র বাঙালিত্ব আর ছাত্রলীগের বাঙালিত্বের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ছাত্রলীগের হকিস্টিক বাহিনী, হেলমেট বাহিনীর সঙ্গে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির মারধরের পার্থক্য কোথায়? শ্রমিকরা সারা মাস কাজ করার পর মজুরি না পেয়ে রাস্তায় নামলে আওয়ামী লীগ বলত ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’; এই সরকারও বলে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’– দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য রেখা স্পষ্ট করতে না পারলে যে এই ‘বহুত্ববাদ’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের’ চিন্তা শুধুই কথার কথায় রূপান্তরিত হবে, সে বোধ কি সরকারের আছে?
বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির দেশ। বর্তমান সময়ে বিশ্বায়নও একটি বাস্তবতা। প্রবাসী শ্রমিক শুধু মুসলিম দেশে কাজ পান না; ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন জাতির দেশেও তাঁকে কাজ খুঁজতে হয়। তাই বহুত্বের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিকল্প নেই।
জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ভ স কর য সরক র র মন দ র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে সুনামগঞ্জে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সোমবার সকাল থেকে কলেজের প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করছেন। এসময় রোববার তাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিচার্জের সুষ্ঠু বিচার দাবি করে স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা।
সোমবার দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়কে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেন তারা।
পর্যাপ্ত ক্লিনিক্যাল ক্লাস নিশ্চিত ও অবিলম্বে কলেজ হাসপাতাল চালুসহ বিভিন্ন দাবিতে চলমান আন্দোলনের সপ্তম দিনেও উত্তপ্ত ছিল এই মেডিকেল ক্যাম্পাস। মিছিল, স্লোগানে তারা তাদের অনিশ্চিত শিক্ষা জীবনের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছেন। গত ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও ক্লাস বর্জন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
বুধবার সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ, বৃহস্পতিবার শহরের আলফাত স্কয়ারে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, স্বাস্থ্যসেবা সচিব বরাবরে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার শান্তিগঞ্জ বাজারে মানববন্ধন ও জনসংযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
রোববার সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করার সময় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিচার্জ করে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয় তাদের।