দেশব্যাপী অনেকের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমরা আজ সকালে এক জাতি হিসেবে ঐক্যের জন্য প্রার্থনা করতে জড়ো হয়েছি। এর উদ্দেশ্য কোনো চুক্তি নয়, কিংবা রাজনৈতিক ব্যাপারও নয়। বরং এমন ঐক্যের ডাক দিয়েছি, যা বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বৈচিত্র্যকে সুরক্ষা দেয়। এটি এমন ঐক্য, যা সবার কল্যাণে কাজ করে। 

আমি একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি। আমি বিশ্বাস করি, এ দেশে ঐক্য সম্ভব, তবে পুরোপুরি নয়। কারণ আমরা পরিপূর্ণভাবে শুদ্ধ মানুষ নই এবং আমাদের ঐক্যও অপূর্ণ। আমাদের বিশ্বাস অব্যাহত রাখতে এবং আদর্শকে উপলব্ধি করার জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদর্শ মানুষের সহজাত সাম্য ও মর্যাদার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। 
ঐক্যের প্রথম ভিত্তি প্রত্যেক মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদাকে সম্মান করা, যা এখানে প্রতিনিধিত্বকারী সব ধরনের বিশ্বাসকে সব মানুষের জন্মগত অধিকার বলে বিশ্বাস করে। জনপরিসরের আলোচনায় একে অপরের মর্যাদাকে সম্মান করার অর্থ হলো যাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য রয়েছে, তাদের উপহাস না করা, ছোট করে না দেখা কিংবা সম্মানের সঙ্গে ফারাকের ব্যাপারগুলো নিয়ে বিতর্ক করা। যখনই সম্ভব সব পক্ষের জন্য সাধারণ ভিত্তি খুঁজে বের করা। যদি সাধারণ ভিত্তি সম্ভব না হয়, তাহলেও আমরা নিজেদের বিশ্বাসের ব্যাপারে সৎ থাকব এবং কোনো রকম বিদ্বেষ বা অবজ্ঞা পোষণ করব না। এটাই মর্যাদার ভিত্তি। 

একতার দ্বিতীয় ভিত্তি হলো ব্যক্তিগত কথোপকথন ও প্রকাশ্য বক্তৃতায় সততা বজায় রাখা। আমরা যদি সৎ হতে ইচ্ছুক না হই, তাহলে ঐক্যের জন্য প্রার্থনা করে কোনো লাভ নেই। কারণ আমাদের কাজগুলো এ প্রার্থনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমরা কিছু সময়ের জন্য কতিপয় লোকের মধ্যে ঐক্যের মিথ্যা অনুভূতি বোধ করতে পারি, কিন্তু আমাদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমাদের যে দৃঢ়, বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন তা সেখানে নেই। 

ন্যায্য কথা বলতে গেলে, সব সময় সত্য কোথায় তা আমাদের জানা থাকে না। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলেও বর্তমানে সত্যের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। যখন আমরা জানি সত্য কী, তখন সত্য কথা বলা আমাদের দায়িত্ব, এমনকি বিশেষ করে যখন তা করতে গিয়ে আমাদের মূল্যও দিতে হয়।
ঐক্যের তৃতীয় ভিত্তি নম্রতা, যা আমাদের সবার প্রয়োজন। কারণ আমরা সবাই ভ্রান্ত মানুষ। আমরা ভুল করি। আমরা এমন কিছু বলি এবং করি যা আমাদের আফসোসের কারণ হয়। আমরা অনেক কিছু দেখি না এবং আমাদের পক্ষপাত রয়েছে। যখন আমরা নিজেদের নিঃসন্দেহে পুরোপুরি সঠিক দাবি করি এবং অন্যকে ভুল সাব্যস্ত করি, তখনই আমরা সম্ভবত নিজেদের ও অন্যদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠি। কারণ, তখন আমরা নিজেদের ভালো মানুষ বনাম খারাপ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করি, যেখানে দু’পক্ষের মধ্যে মাত্র কয়েক ধাপ দূরত্ব থাকে। 

সত্য হলো আমরা ভালো-মন্দ মিলিয়ে সবাই মানুষ। আলেকজান্ডার সলঝেনিতসিন সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, ‘ভালো ও মন্দকে আলাদা করার রেখাটি রাষ্ট্র, শ্রেণি বা রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে চিহ্নিত হয় না, বরং প্রত্যেক মানুষের হৃদয় থেকে সব মানুষের হৃদয়ের মধ্যে বিরাজ করে।’ আমরা যত বেশি এটি উপলব্ধি করব, তত বেশি নিজেদের মধ্যে নম্রতার বিস্তৃতি ঘটবে এবং আমাদের ফারাকের ব্যাপারে একে অপরের প্রতি উদার হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে আমরা যতটা উপলব্ধি করি তার চেয়ে বেশি আমরা অবয়বে একে অপরের মতো এবং আমরা একে অপরের কাজে দরকার হই।

বিশেষ কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজনে ঐক্যের জন্য প্রার্থনা করা তুলনামূলক সহজ। যখন আমরা জনসাধারণের ক্ষেত্রে বাস্তব পার্থক্যগুলো বিবেচনায় নিয়ে মোকাবিলা করি, তখন এটি উপলব্ধি করা অনেক কঠিন। কিন্তু ঐক্য ছাড়াই আমরা বালুর ওপর আমাদের জাতির ঘর তৈরি করছি। ঐক্যের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হওয়ার মানে বৈচিত্র্যকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং মতানৈক্য অতিক্রম করা। এ জাতীয় ঐক্যের জন্য মর্যাদা, সততা ও নম্রতার দৃঢ় ভিত্তি দরকার, যার মাধ্যমে আমরা বর্তমান সময়ে আমাদের আদর্শ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে পারি। 

মারিয়ান এডগার বুড্ডে: ওয়াশিংটোর এপিস্কোপাল বিশপ; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অপর র

এছাড়াও পড়ুন:

মঞ্চে বলয় ভাঙার লড়াই

থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নতুন নাটক ‘বলয়’-এর উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়ে গেল গত ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। নাটকটির পাণ্ডুলিপি, পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন মোকাদ্দেম মোরশেদ। নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়নকালে হলের লবিতে একটি ইনস্টলেশন দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। ‘বলয়’ নাটকটি এগিয়ে গেছে মূলত তিনটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে। এঁরা হলেন– রাজনীতিক, বিজ্ঞানচিন্তক ও ধর্মতাত্ত্বিক। তারা গেছেন মনোবিশ্লেষকের কাছে কাউন্সিলিংয়ের জন্য। কারণ, তাদের উপলব্ধি, তারা একটি বলয়ের মধ্যে আটকে গেছেন । হাঁপিয়ে উঠেছেন তারা, বলয় থেকে মুক্ত হতে চান। 

বিজ্ঞান-ধর্ম-রাজনীতির কথা, যুক্তির পিঠে যুক্তি, যুক্তি খণ্ডন, আস্থা-অনাস্থা অনুভবের কথা, তারা ফিরে যান তাদের আপন সত্তায়। নিজের সঙ্গেই নিজের কথোপকথন। নাট্যকারের ভাষায় এটি অন্তর্দ্বন্দ্বের নাটক। একটি চক্র, একটি বলয় ঘিরে রেখেছে আমাদের প্রত্যেককে। সামাজিক বলয়, রাজনীতির বলয়, ধর্মীয় বলয়, যুক্তি-অযুক্তির বলয়, ক্ষমতার বলয়, শোষণের বলয়, শাসকের বলয়। বলয়বৃত্তে ছটফট করা প্রাণ ছুটে যেতে চায়, মুক্ত হতে চায়; হয়তো ছুটে যায়ও কিন্তু পড়ে যায় আরেক বলয়ে। 

সংলাপই এ নাটকের প্রাণ। চমৎকার অর্থপূর্ণ সংলাপগুলো দর্শককে নাড়া দিয়ে যায়, জাগিয়ে তোলে কিছু প্রশ্ন অথবা অনুসন্ধানের ইচ্ছা। এ কনটেম্পোরারি অন্তর্দ্বন্দ্বের নাটকটি যেন নিজেকেই নিজে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দেয় নানান অসংগতি, অযুক্তির বলয়ে আমাদের বসবাস। গল্পের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সেট, আলো, আবহ, অভিনয় দক্ষতা এবং সর্বোপরি ডিরেক্টোরিয়াল ওয়ার্ক নাটকটিকে অর্থবহ করে তুলেছে। বলয় নাটকটিকে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রযোজনা বলা যেতে পারে। রাজনীতিক বিজ্ঞানচিন্তক ধর্মতাত্ত্বিক চরিত্রে যথাক্রমে– সেলিম মাহবুব, স্বাধীন শাহ্, রেজাউল আমিন সুজনের দুর্দান্ত অভিনয় দর্শকদের নজর কেড়েছে। মনোবিশ্লেষক চরিত্রে নাহিদ সুলতানা লেমন উতরে গেছেন। দর্শনার্থী এবং অমৃতা চরিত্রে রূপদানকারী রানা সিকদার ও মাহমুদা সুলতানা ভাবনার অভিনয় উপস্থাপনের আরও সুযোগ আছে বলে মনে হয়। আরেকটি ইন্টারেস্টিং চরিত্র মানসিক রোগী, তিনি একজন পিটিএসডি। যে চরিত্র আমজনতার পক্ষে কথা বলে, তাঁর কথাই যেন আমজনতার কথা। চরিত্রের রূপদানকারী হাসনাত প্রদীপ তাঁর অভিনয়শৈলী দিয়ে দর্শকের নজর কেড়েছেন। 

নাট্যকার, নির্দেশক মোকাদ্দেম মোরশেদ বলেন, রাজনৈতিক বলয়সহ সামগ্রিক পারিপার্শ্বিক বলয়ের একটা স্থানান্তর ঘটেছে। এক বলয় থেকে অন্য বলয়ে আমরা স্থানান্তরিত হয়েছি। বলয় কিন্তু রয়েই গেছে। বলয় থেকে বলয়ে গমন অথবা আটকেপড়া বলয়ে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের স্পন্দন, অনুকূলে বা প্রতিকূলে মুক্তিহীন বলয়বন্দি বহমান এই জীবন– এ উপলব্ধিই ‘বলয়’ নাটকের চিন্তা সূত্র। এতে আছে চরিত্রের স্ববিরোধী অবস্থান; নিজেকেই নিজে বিশ্লেষণ করার একটি ইচ্ছা। দলের ৪০তম প্রযোজনাটির আবহ পরিকল্পনায় সেলিম মাহবুব, আলোক পরিকল্পনায় সুদীপ চক্রবর্তী। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক এবং প্রযোজনা অধিকর্তা কামরুজ্জামান মিল্লাত বলেন, এস এম সোলায়মানের ভাব ও আদর্শে প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল সব সময় নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষের কথা মানুষের সামনে বলেছে। নাটক বলয়-এ মানবজীবনের সংকটকে চিনে নিয়ে সম্ভাবনার দুয়ার খোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত। থিয়েটার আর্ট ইউনিটকে অভিনন্দন চমৎকার একটি প্রযোজনা উপহার দেওয়ার জন্য, বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় মৌলিক নাটকের যাত্রা অব্যাহত থাকুক।   

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মঞ্চে বলয় ভাঙার লড়াই