নদী ও খালের চরে ৩ কোটি টাকার সবজি
Published: 25th, January 2025 GMT
ফটিকছড়ি উপজেলার ওপর দিয়ে হালদা নদী, ধুরুং, সর্তা, লেলাং, গজারিয়া, ফটিকছড়ি, হারুয়ালছড়ি খালসহ ছোট বড় অনেক খাল, ছড়া প্রবাহিত হয়েছে। এসব নদী ও খালের চরের শত শত হেক্টর উর্বর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষাবাদ করা হয়েছে। এ যেন নদী ও খালের চরে সবজির মহাসমারোহ।
ফটিকছড়ি সদর থেকে নাজিরহাট পৌর সদর পর্যন্ত হালদা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ৮/১০টি ছোট বড় চর। ফটিকছড়ি সদরের সুন্দরপুর, একখুলিয়া, নাইচ্যারঘাট ও ব্রাহ্মণহাট, নাজিরহাট, কুম্ভারপাড়া, ধুরুং খালের চরে এখন কোটি টাকার সবজি চাষ হচ্ছে। এতে এলাকার শত শত কৃষকের মুখে ফুটেছে আনন্দের হাসি।
একসময় চরগুলোতে জনবসতি ছিল। বিভিন্ন সময়ে বন্যায় হালদা ধুরুং ভাঙনে এসব বিলীন হয়। ভাঙাগড়ায় এসব এলাকায় ক্রমাগত চর জেগে ওঠে। বসত-ভিটা হারিয়ে একসময় যারা নিঃস্ব হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন পর জেগে ওঠা ওই চরগুলো তাদের এখন আশার সম্বল। দেড় দশক ধরে এসব চরে সবজি আবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছে অন্তত কয়েকশ পরিবার।
নাজিরহাট পৌরসভার দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ শরীফ উদ্দিন জানান, চরের প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১০ টন সবজি উৎপাদিত হয়; যার বাজার মূল্য প্রায় দুই লাখ টাকা। সে হিসেবে ১৫০ হেক্টর জমিতে দেড় হাজার টন সবজি উৎপাদিত হয়; যার বাজার মূল্য তিন কোটি টাকারও বেশি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবছর বন্যায় হালদার অনেক জমি তলিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এতে কিছু স্থানে প্রচুর পলি জমে। পলিযুক্ত দো-আঁশ মাটি সবজি চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এতে কৃষক বেশ লাভবান হন, ফসলও ভালো হয়। আমরাও কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকের উপকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
একখুলিয়া গ্রামের কৃষক আকবার আলী বলেন, ‘চরে সবজি চাষে খরচ খুবই কম। সারের তেমন প্রয়োজন হয় না। লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরা সবজি চাষে বেশি বিনিয়োগ করেন। সবজি হিসেবে ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, মুলা, বরবটি, বেগুন, শিম, টমেটো, পেঁয়াজ, মিষ্টি আলু, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতার চাষ হয়।’
সুন্দরপুর এলাকার কৃষক দুলাল জানান, প্রতি হেক্টরে ৩০ কেজি ইউরিয়া, ২০ কেজি ফসফেট এবং ৫ কেজি নাইট্রোজেন সার দিতে হয়। অনেকে জৈবসার মিশিয়ে জমিতে বীজ বপন করেন।
নাইচ্যারঘাট এলাকার উপকারভোগী মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন জানান, ১ একর জমিতে ১৩০ মণ সবজি পেয়েছেন; যার বাজার মূল্য দেড় লাখ টাকা। জমিতে তেমন সার প্রয়োগ করতে হয়নি। আরও প্রচুর সবজি পাবেন বলে আশা তাঁর। এখানকার সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাট-বাজারেও সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিবিরহাট বাজারের সবজি ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম জানান, প্রতি সপ্তাহে কাঞ্চননগর এলাকা থেকে তিনি প্রায় এক-দেড় লাখ টাকার সবজি কিনে বাজারে বিক্রি করেন। এতে আশার চেয়ে বেশ লাভও হয় তার।
চেঙ্গেরকুল গ্রামের আবু আহমদ বলেন, ধুরুং খালের চরে আমার এক একর জমি রয়েছে। এতে বেগুনের চাষ করেছি। প্রতি সপ্তাহে ৪-৫ মণ বেগুন পাই। এতে তার আয় হয় ৫-৬ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত লাখ টাকার বিক্রি করেছি। আরও আয় হবে।
নাজিরহাট এলাকার করিম উদ্দিন বলেন, একসময় কাজ ছিল না। এখন কাজের অভাব নেই। বরং এলাকার অনেক বেকারেরা কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। পাশের গ্রামের অনেকে সবজিক্ষেতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এটি বড় আশার খবর।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্ত মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকার কৃষিবান্ধব। তাদের প্রয়োজনে কৃষিঋণের পাশাপাশি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করা রয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সবজ এল ক র ক ক র সবজ
এছাড়াও পড়ুন:
এক সময়ের বনদস্যুর ‘বয়ানে’ সুন্দরবনে দস্যুতার দিনগুলো
সুন্দরবনে দস্যুতায় টাকা ছিল। কিন্তু সে অবৈধ টাকা নিজেরা উপভোগ করতে পারতেন না। বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যুঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াত, এক ঘণ্টা শান্তির ঘুমও হতো না। মোটেও সুখ ছিল না। দস্যুতার জগতে গিয়ে নিজের প্রাপ্তি বলতে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ডাকাত শব্দটি। স্ত্রী-সন্তানদেরও চলতে হতো মাথা নিচু করে। কথাগুলো একসময়ের বনদস্যু আল-আমীনের।
আল-আমীন বলেন, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তিনি ভালোই আছেন। আর কখনো ওই অন্ধকার পথে পা বাড়াতে চান না তিনি। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা খোড়লকাঠি বাজারসংলগ্ন কয়রা নদীর তীরে। ছোট বাজারটিকে সুন্দরবন থেকে আলাদা করেছে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদী।
নদীর ওপারের সুন্দরবনের ত্রাস ছিলেন আল-আমীন। তিনি বলেন, তখন শরীফ বাহিনী ছিল বড় দস্যুদল। সেই দলে যোগ দিয়ে ডাকাত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে এলাকায় নাম ছড়িয়ে গেলে বাড়ি ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা সুন্দরবনের মধ্যে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। র্যাব আর কোস্টগার্ডের অভিযানের ভয়ে বনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটত তাঁদের।
আল-আমীনের বলতে থাকেন, ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল তাঁর গণ্ডি। বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হতে চাইতেন, তবে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সুযোগ আসে। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। দস্যুনেতা শরীফ না চাইলেও তাঁকে কৌশলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাঁরা দলের ১৭ জন সদস্য ১৭টি অস্ত্র আর ২ হাজার ৫০০ গুলিসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
দস্যুজীবন যাঁরা একবার দেখেছেন, তাঁরা না খেয়ে থাকলেও আর দস্যুতায় ফিরতে চান না—এমনটাই দাবি আল-আমীনের। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গল্প গল্পে তিনি বলেন, ডাঙায় থাকা মাছ ব্যবসায়ীরা ডাকাতদের বাজার, বন্দুক, গুলি সবই সাপ্লাই দিতেন। সব জিনিসের দাম নিতেন তিন থেকে চার গুণ বেশি।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র, ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সব শেষ দস্যুদল হিসেবে আত্মসমর্পণ করে শরীফ বাহিনী। সেদিনই প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। তবে দস্যুনেতা শরীফ গত বছরের ৫ আগস্টের পর আবার সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন বলে তাঁর একসময়ের সাথীদের ভাষ্য।
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম। তিনি বলেন, দলনেতা শরীফের পুরো নাম করিম শরীফ। কয়রার আল-আমীন ছিল বাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। শরীফ প্রথমে আত্মসমর্পণে রাজি থাকলেও পরে বেঁকে বসেন। অন্যরা আত্মসমর্পণ করেন। তবে শরীফ এখন পুনরায় সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন।
কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম আবদুল মালেক বলেন, বনের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কমে আসায় সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। এভাবে দস্যুতা চলতে থাকলে বনজীবীদের জীবিকা, সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায় ও পর্যটন হুমকির মুখে পড়বে; বিপন্ন হবে বন্য প্রাণী আর প্রাণবৈচিত্র্য। দস্যুতা দমনে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।